স্মৃতিরেখায় তারুণ্য একাত্তর

ড. এ এইচ এম আবু বকর | সোমবার , ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৯:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি রাজনৈতিক সংগ্রাম নয়, এটি ছিল একটি জাতির অস্তিত্বের লড়াই। সেই লড়াইয়ের প্রতিটি ধাপেই তরুণরা ছিল সামনের সারিতে। ড. গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া সংকলিত ও সম্পাদিত

স্মৃতি রেখায় তারুণ্য ৭১”

গ্রন্থটি হচ্ছে একাত্তরের সেইসব সাহসী তরুণদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতিচারণার এক হৃদয়স্পর্শী দলিল। গ্রন্থটি শুধুমাত্র অতীতের কথা নয়, এটি বেদনার, গৌরবের এবং এক নতুন সূর্যোদয়ের গল্প।

গ্রন্থটির প্রতিটি লেখায় তরুণদের অনন্য সাহস, প্রত্যয় এবং আত্মত্যাগের গভীর ছাপ রয়েছে। খান মিজান বীর প্রতীকের লেখায় কর্ণেল তাহেরের বীরত্বগাথা যেন পাঠকের সামনে এক জীবন্ত দৃশ্য হয়ে ওঠে। একটুকরো স্বাধীনতার জন্য তাদের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল শঙ্কা এবং অজানা ভবিষ্যতের সঙ্গে লড়াই করার এক মিশ্র অনুভূতি। ড. শিপ্রা রক্ষিত দস্তিদারের লেখায় উঠে আসে ২৫ মার্চের বিভীষিকার মাঝে এক তরুণ শিক্ষার্থীর জীবনের টালমাটাল চিত্র। তার আত্মজীবনী “অস্থির তরী” থেকে সংকলিত এই লেখা যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি তরুণতরুণীর সংগ্রাম ছিল বাংলাদেশের আত্মার গভীর থেকে উঠে আসা এক আর্তনাদ।

. বিমল গুহ তার “ধলপাহাড়ের আলো” গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধকালীন শরণার্থী জীবনের হৃদয়বিদারক বর্ণনা দিয়েছেন। শরণার্থী শিবিরে কাটানো দিনগুলো ছিল শুধুই দুঃখের নয়, বরং প্রত্যেকটি দিনের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। মোহীত উল আলম তাঁর লেখায় মুক্তিযুদ্ধের মানসিক দিকটি অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তার পিতার সাহসিকতা এবং দুই ভাইয়ের জীবন থেকে পাওয়া শক্তি যেন মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি পরিবারের এক নিদর্শন।

গ্রন্থটিতে শহর ও গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার চমৎকার সমন্বয় রয়েছে। সৈয়দ আবদুর রহমান, শেখর বড়ুয়া এবং খোরশেদ আলম চৌধুরী চট্টগ্রামের রণাঙ্গনের গল্পের মাধ্যমে পাঠকদের নিয়ে যান এক মহাকাব্যিক যুদ্ধে। প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি পরিবার যেন একেকটি দুর্গ। আবদুল মোতালেব দুলালের রামগতি থেকে ভারতে যাত্রা এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসার গল্প কেবল এক ব্যক্তির নয়, এটি প্রতিটি গ্রামীণ মুক্তিযোদ্ধার সংগ্রামের প্রতীক।

আশফাক চৌধুরীর লেখায় ঢাকার অগ্নিগর্ভ থেকে সিলেটের উদ্দেশে পঁচিশে মার্চের পর একটি পরিবারের প্রাণরক্ষার যে দুঃসাহসিক যাত্রা চিত্রিত হয়েছে, তা আমাদের চোখে জল এনে দেয়। প্রতিটি ধাপ ছিল বিপদে ভরা, প্রতিটি পদক্ষেপ যেন মৃত্যু থেকে এক ধাপ দূরে। তার এই হৃদয়বিদারক বিবরণ কেবল এক পরিবারের নয়, এটি বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারের মুক্তির আকাঙ্‌ক্ষার প্রতীক।

এই গ্রন্থের বিশেষত্ব হলো, এটি শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহ নয়, বরং এক জীবন্ত ইতিহাস। আবদুল জব্বার এবং খসরু চৌধুরীর লেখায় উঠে এসেছে সিলেট অঞ্চলে পাকবাহিনীর বর্বরতা এবং স্বজন হারানোর বেদনা। এই স্মৃতিগুলো আমাদের জানিয়ে দেয়, স্বাধীনতার জন্য কী ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়েছিল।

গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া নিজের উদ্যোগে পারিবারিক অর্থায়নে এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন, যা তার মুক্তিযুদ্ধের প্রতি গভীর ভালোবাসার নিদর্শন। এই প্রচেষ্টা কেবল তার একার নয়, এটি তার বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতার ফল। বিশেষভাবে, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মিজানুর রহমান এবং কামরুলের অবদানের কথা আলাদা করে উল্লেখ করা হয়েছে।

সংক্ষেপে বলতে হয় “স্মৃতি রেখায় তারুণ্য ’৭১” কেবল একটি গ্রন্থ নয়, এটি এক গভীর আবেগঘন দলিল। এটি শুধু অতীত নয়, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্যও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এই গ্রন্থ আমাদের শিখিয়ে দেয় কীভাবে একটি জাতি নিজের অস্তিত্বের জন্য লড়াই করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের তৃণমূল পর্যায়ের এই বর্ণনা নতুন প্রজন্মের কাছে এক শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দেবে। এই বইটি পড়া কেবল ইতিহাস জানা নয়, বরং একাত্তরের সেইসব তরুণদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন।

. গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া, সংকলিত, সম্পাদিত ও প্রকাশিত “স্মৃতি রেখায় তারুণ্য ’৭১”এর পরিবেশক চট্টগ্রামের কালধারা প্রকাশনী, প্রকাশকাল নভেম্বর ২০২৪, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৭২, মূল্য ৩৫০ টাকা।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধআন্তর্জাতিক থিয়েটার কর্মশালা ও আক্ষেপ মুক্তি