সদালাপী ও হাস্যোজ্জ্বল একজন প্রিয় মানুষ সুব্রত বড়ুয়া রনি। রনির সাথে পরিচয় ১৯৭২ সাল থেকে। আমাদের বন্ধু মহলে রনি ছিল সবার থেকে আলাদা। সবার খবরাখবর নেওয়া, যে-কোন প্রয়োজনে ছুটে আসা রনির ছিল স্বভাবজাত। এমন এক মানুষ আমাদের মাঝ থেকে চলে যাওয়াটা কোনোভাবেই মানতে পারি না। মাত্র কয়েক মাস আগে আমার প্রিয় ছোট ভাই মানিক চলে গেল। সেই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রনির চলে যাওয়া। রনি আর আমি একসাথে সুরেলা ও সোলস করেছি। আজ সেই স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলো মনে পড়ে বারবার।
সেন্ট মেরী’স স্কুল হলে একটি গানের অনুষ্ঠান, ১৯৭২
মাত্রই দেশ স্বাধীন হয়েছে। চারিদিকে তারুণ্যের উদ্দীপনা। সংস্কৃতি চর্চায় ভিন্ন স্বাদের ও ভিন্ন আঙ্গিক যুক্ত হয়েছে। তারমধ্যে একটি হলো পপ গান। আমিও আকৃষ্ট হই। কারণ, আমিও গানপাগল। পরিবারে সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ থাকায় আমিও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শিখি। সেই সময়ে আমি একোডিয়ান, বেনজু, গিটার বাজাতাম।
১৯৭২ সালের প্রথম দিকে এক বিকেলে সেন্টমেরিস স্কুলের হলে লাইটিনিংসের কনসার্ট। আমরাও বন্ধুরা মিলে উপভোগ করেছি প্রাণভরে। সেই অনুষ্ঠানে আমার বন্ধু মইনুল হক মইনুর মাধ্যমে পরিচয় হয় সাজেদ উল আলমের সাথে। সেও গান পাগল আরেক তরুণ। আলাপে মেতে উঠি আমরা অনুষ্ঠান শেষে। পরে আমার মোমিন রোডের বাসায় এলাম। সাজেদকে আমি বেনজু, গিটার বাজিয়ে শোনালাম। তারপর আমরা গেলাম কাজীর দেউরিস্থ সাজেদের বাসায়। সেখানে সাজেদও একোডিয়ান এবং গিটার বাজিয়ে শোনালো। আমার খুব ভালো লাগলো যে, আমার মতো আরেকজনকে পেলাম, যে বাদ্যযন্ত্র বাজানোয় আগ্রহী। কারণ, এতদিন আমি একলা বাজাতাম। সঙ্গী পেয়ে ভালো লাগলো। পরে সাজেদ ও আমি ঠিক করলাম – একটি ঙৎপযবংঃৎধ দল গড়ে তুলবো। সেই রাতেই সিদ্ধান্ত এবং এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা।
সেই রাতেই দেখতে শুরু করি বিশাল স্বপ্ন। একদিন আমরাও মঞ্চে গান করবো।
বাজনা বাজিয়ে পারস্পরিক আলাপ সেরে আমরা গেলাম সাজেদের বাবা সাহিত্যিক মাহবুব উল আলমের কাছে। চাচার কাছে আমাদের ইচ্ছের কথা বলি। আমাদের দলের জন্য একটি নাম দেওয়ার অনুরোধ করে সাজেদ।
তিনি সব শুনে, একটু ভেবে নাম দিলেন – ‘সুরেলা’। এভাবেই শুরু হলো আমাদের সংগীতের ভ্রমণযাত্রা। সেই যাত্রা আজও চলছে। ভাবলেই শিহরিত হয়ে উঠি আজও, সেই রাতের আমাদের প্রচন্ড আগ্রহ থেকে ‘সুরেলা’ সৃষ্টি এবং ১৯৭২ সালের শেষ দিকে গঠিত হয় ‘সোলস’। যা দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড দলগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেই সত্তর দশক থেকে যাত্রা শুরু করে সোলস আজও জনপ্রিয়।
আমাদের ঙৎপযবংঃৎধ দল সুরেলা
নামকরণ তো হলো। এবার আমরা নিয়মিত চর্চায় মেতে উঠলাম। আমি, সাজেদ, তৌহিদ ও এনায়েত- প্রথম দিকে সুরেলায় আমরা সবাই বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে চর্চা করতে থাকি। আমি তখন এম.ই.এস স্কুলে পড়ি। মনে আছে আজও, স্কুল থেকে ফিরেই ভাত খেয়ে চলে যেতাম কাজির দেউড়ি।
সপ্তাহে দুই /তিন দিন আমরা সাজেদের বাসায় মহড়া করতাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত করে বাসায় ফিরে পড়ার টেবিলে। এভাবেই চললো বেশ কিছুদিন। ১৯৭২ সালের জুন/জুলাই থেকে আমরা শুরু করলাম বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও পাড়ার অনুষ্ঠানে।
এর মাস দুয়েক পর একদিন সাজেদ রনিকে নিয়ে এলো। ওরা চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পড়ে। রনি তবলা ও কঙ্গো বাজাতো। সুরেলায় নতুনত্ব এনেছিল রনি। তবলা ও কঙ্গো বাজিয়ে দর্শক শ্রোতাদের মাঝে সাড়া তোলে। পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে বাংলা দেশাত্মবোধক, আধুনিক ও সিনেমার গানের সুর তুলে মঞ্চে পরিবেশন করতাম।
এরমধ্যে রনি আমাদের মোমিন রোডের বাসায় সপরিবারে ভাড়াটিয়া হিসেবে চলে আসলো। এতে আমার আরও সুবিধা হলো। অনেক সময় আমি রনিকে ডেকে নিতাম। রাতে একসাথে ঘুমাতাম। আর আমাদের চলতো নানান আলাপ।
আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যাওয়া
সুরেলায় আমাদের চর্চার মধ্যেই অনুভব করি, আমাদের আরও ভালো পারফর্ম করতে হলে ইলেকট্রনিক বাদ্যযন্ত্র প্রয়োজন। এতদিন আমরা ম্যানুয়েল বাদ্যযন্ত্র বাজাতাম। এই সময়ে সহায়তা করেছেন প্রয়াত সাংবাদিক মইনুল আলমের বন্ধু ওয়াদুদুল ইসলাম। তিনি আমাদের দুই দফায় লন্ডন ও ভারত থেকে বাদ্যযন্ত্র এনে দেন। এগুলো হলো – ড্রাম সেট, লিড গিটার, এমপ্লিফায়ার, রিদম গিটার, বেস গিটার।
যাই হোক, ইলেট্রনিক বাদ্যযন্ত্র আসার পর আমাদের সকলের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনা দেখা দেয়। শুরুতে আমাদের ঙৎপযবংঃৎধ গঠনের যে ভাবনা ছিল, তাকে আধুনিক রূপ দেওয়ার আরেক ভাবনা পেয়ে বসে। আর এসব নিয়ে সাজেদ, রনিসহ আমরা আলোচনা করতাম। একদিন বিকেলে রনি তপন চৌধুরীকে নিয়ে এলো ডিসি হিল পার্কে। সেখানেই এক বিকেলে তপন চৌধুরী গান গেয়ে শোনালো। তপন যোগ দিল। আমরা দলে গায়ক পেয়ে গেলাম। সুরেলা এখন পূর্ণাঙ্গ সংগীত দল। এভাবেই এগিয়ে চলে আমাদের।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই স্থপতি এবং স্বনামধন্য দৈনিক পূর্বকোণের প্রাক্তন সম্পাদক, মরহুম তসলিম উদ্দীন চৌধুরীকে। তিনি তখন আসকারদীঘি পাড়ে থাকতেন। তিনি নিজে আমাদের কর্ড দেখিয়ে দিতেন। এবং নিজে উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন ইংরেজি ম্যগাজিনে প্রকাশিত গিটারের কর্ড ও গিটারের নোট এনে দিতেন। আমি ও সাজেদ সেই অনুযায়ী চর্চা করতাম। তসলিম ভাই সেই ম্যাগাজিন ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সহায়তা করেছেন। তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
সুরেলা থেকে সোলস
যেহেতু আমরা সুরেলা নামের দল দিয়ে যাত্রা শুরু করি, সময়ের বিবর্তনে আবারও একে নতুনভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে ভাবতে থাকি। কারণ, এরমধ্যে আমরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠান করে জনপ্রিয়তা লাভ করেছি। দর্শক-শ্রোতাও আমাদের পরিবেশনা পছন্দ করে। তাই এবার নতুন আঙ্গিকে এগিয়ে চলার স্বপ্ন দেখছি। আমরা ঠিক করলাম নতুন নামকরণে নতুন ধারায় এগিয়ে যাওয়ার। এবার নতুন নামকরণ করা হয়- ‘সোলস’। সময়টা তখন ১৯৭২ সালের শেষের দিকে। এই সময়ে নতুনভাবে দল সাজাতে হয়। এরমধ্যে আমরা লক্ষ করি, বিভিন্ন হোটেল ও ক্লাবে অনুষ্ঠান করার সময়ে ইংরেজি গান করার অনুরোধ আসে। তখন তো গায়ক শুধু তপন। তাই একদিন রনি দুই তরুণকে নিয়ে এলো। তারা হলেন রুডি ও লরেঞ্জো। তারা খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী হওয়ার সুবাদে ইংরেজি গান গাইতে পারতেন। তপন চৌধুরী বাংলা গান গাইতো। আর রুডি ও লরেঞ্জো গান গাইতো। এইভাবে নতুন নামকরণে সোলস প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে লাইনআপ ছিল এমন
সাজেদ- রিদম গিটার, একোডিয়ান। রনি- ড্রাম। লুলু – লিড গিটার, বেনজু। তপন চৌধুরী – মূল বাংলা গায়ক, রুডি- বেস গিটার ও ইংরেজি গায়ক, লরেঞ্জো – রিদম ও ইংরেজি গায়ক। এভাবেই সোলসের প্রতিষ্ঠা হয়ে যাওয়ার পর, মোটামুটি ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমরা গুছিয়ে নিই। তারপরের কাহিনী তো ইতিহাস। সেইদিনের সুরেলা, আজ সোলস নামে দেশজুড়ে অনেকের পছন্দের ব্যান্ড।
এটা তো আর একদিনে হয়নি। দলের সকলের আন্তরিকতা, দলের প্রতি বিশ্বস্ততা, আর কমিটমেন্ট – এটাই মূল শক্তি। এই দীর্ঘ সংগীতের ভ্রমণ যাত্রায় সোলস আজও টিকে আছে। অনেক সময়ে অনেকে বিভিন্ন কারণে দল ছেড়ে গেছেন। আমিও ১৯৭৪ সালের শেষের দিকে পারিবারিক কারণে সোলস ছেড়ে চলে আসি। কিন্তু, সোলস আজও আছে। বিভিন্ন সময়ে অনেক ভাল শিল্পী যুক্ত হয়েছেন। তাদের সকলের ঐকান্তিকতার কারণে সোলস এগিয়ে চলছে। এটা আমাকে আনন্দ দেয়। তৃপ্তি দেয়।
সলো বলি আর ব্যান্ড বলি গানই হচ্ছে মুখ্য
গান ভাল এবং জনপ্রিয় না হলে ব্যান্ডের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটতো। তাই সোলসের প্রথম এলবাম থেকে শুরু করে যতো এলবাম বেরিয়েছে, প্রতিটি এলবামের লাইন-আপকে সাধুবাদ দিতেই হয়। কারণ তাঁরা সোলসের জন্য কালজয়ী গান উপহার দিয়েছিলো।
এদের মধ্য আমার ব্যক্তিগত পছন্দের তপন চৌধুরী, নকীব খান, আইয়ুব বাচ্চু, পিলু খান, নাসিম আলী, পার্থ বড়ুয়াও আছে।
সোলসের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রনির আন্তরিকতা ও সংগঠন চালোনোর দক্ষতা ছিল প্রশংসনীয়। সেই সময়ে আমি রনিকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, রনির আন্তরিকতা ও পরিশ্রম।
রনি আমাকে ভুলে যায়নি। একসময় জামালখান রোডে রনিদের পরিবার একটি বাসা কিনেছিলো, যেটা প্রথমদিকে খালি পড়েছিলো সেখানে এবং পরে নকীবের বাসায়ও রনির আহবানে সোলসের প্র্যকটিসে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো।
সোলসের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রনি বা সোলস আমাকে দাওয়াত দিতো। আমিও উপস্থিত থাকার চেষ্টা করেছি।
আসলে রনির জন্যই সোলস ছেড়ে আসার পরও সোলসের সাথে আমার যোগাযোগ ছিলো।
২৬ মে ২০২১ তারিখ দুপুরে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি গিয়ে আমাদের প্রিয় মানুষ রনিকে এভাবে দেখবো, কখনো ভাবিনি। আমরা ছিলাম সেই ১৯৭২ সাল থেকে সাথী। সেই সাথীকে হারিয়ে আজ আমি বাকহারা। এখন আছে শুধু সুরেলা ও সোলস নিয়ে রনির স্মৃতি। আমি রনির বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সুরেলা ও সোলস।