জননেতা আবদুল্লাহ আল নোমান আজীবন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে ছিলেন। গণতন্ত্রের কর্মী ছিলেন, নেতা ছিলেন। তার ৬০ বছরের অধিক রাজনৈতিক জীবন অনেক চড়াই–উৎরাই, জেল–জুলুম আত্নগোপনের মধ্যদিয়ে গিয়েছে।
১৯৬৮ সালের ১০ ই আগস্ট নোমান ভাই –মৌলভী সৈয়দ স্ট্যাট ব্যাংক অফ পাকিস্তানের (বর্তমানে পুরাতন বাংলাদেশ ব্যাংক) এর প্রধান গেইট থেকে গ্রেফতার হন সকাল ৯ টায়। আইবি ইন্সপেক্টর রউফ ও গণজালবেস পুলিশ নিয়ে তাদের গ্রেফতার করে। নোমান ভাই মেনন গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়ন বৃহওর চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সভাপতি আর শহীদ মৌলভী সৈয়দ ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি ছাত্রলীগের সভাপতি। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট স্বৈরাচার জেনারেল আইয়ুব খানের পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান রুল জারী করেছিলো তৃতীয় বিভাগে যারা এসএসসি পাশ করবে তারা কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে না। নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য এটা ছিলো বৈষম্যমূলক নীতি। এর বিরুদ্ধে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পূর্ব পাকিস্তানে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ ই আগস্ট ১৯৬৮ সাল ধর্মঘট আহবান করে। সাথে যুক্ত করে ছাত্র রাজবন্দীসহ –সকল রাজবন্দীর মুক্তি। এরজন্য প্রায় ১৫ দিন ধরে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা সমাবেশ ও প্রচারপত্র বিলি করা হয়। ১০ ই আগস্ট ছাত্র ধর্মঘট সফল করার জন্য ৯ আগস্ট রাতে আমরা প্রায় ৬০ জন ছাত্র কর্মী চট্টগ্রাম সিটি কলেজের অডিটোরিয়ামে ছিলাম। সকালে কলেজিয়েট স্কুলের মর্নিং শিফটে ধর্মঘট সফল করে মুসলিম হাই স্কুলের মর্নিং শিফটে ধর্মঘট সফল করি। কলেজিয়েট স্কুলে পিকেটিং করার সময় পুলিশ ধাওয়া করলে আমরা স্টেশন কলোনীতে ঢুকে পড়ি। আমাদের পিকেটিং করার গ্রুপ ভাগ করা ছিলো পাঁচ পাঁচ করে। আমার সাথে মতিয়া গ্রুপের আমি, শহীদ সুভাষ (কক্সবাজার), সুবীর দত্ত এবং মেনন গ্রুপের কালো সেলিম ও বেলায়েত হোসেন ছিলো। আমরা যখন মুসলিম হাই স্কুলের ভিতরে তখন নোমান ভাই ও মৌলভী সৈয়দ ভাইকে গ্রেফতার করা হয়। আমাদের আরো দায়িত্ব ছিলো চট্টগ্রাম কলেজ ও ইন্টারমেডিয়েট (মহসীন কলেজ)এ ধর্মঘট সফল করার। চট্টগ্রাম কলেজে ধর্মঘট করা ছিলো কঠিন। ছাত্ররা প্রচুর সরকারি বৃত্তি পেতো এবং ঢুকার গেইট ছিলো কয়েকটি। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র নেতাদের নেতৃত্বেও কয়েকটি পিকেটিং গ্রুপ হয়েছিলো। আমরা সিটি কলেজের ছাত্ররা গিয়েছিলাম সাহায্য করতে। বদি দোভাষ ছিলো চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস। মোজাফফর আহমেদ টিকে (তমকায়ে খেদমত) ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ। ছাত্ররা যেনো ধর্মঘট করতে না পারে তার জন্য কলেজের সকল প্রবেশ পথে শিক্ষকদের পাহারা থাকতো, বাহিরে থাকতো পুলিশ। পুলিশ অফিসাররা ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানি। এনএসএফ অর্থাৎ ছাত্র ফেডারেশন মোনায়েম খানের হকিস্টিক বাহিনী ও থাকতো কলেজের ভিতরে বাইরে। তারা পিকআপ নিয়ে ঘুরতো যেনো ছাত্ররা ধর্মঘট করতে না পারে। আমি ঐদিন বর্তমানের মুহসীন কলেজে ধর্মঘট সফল করার পর নামতে গিয়ে চট্টগ্রাম কলেজের প্রধান গেইট থেকে বেলা এগারোটায় গ্রেফতার হয়ে যাই। পুলিশের জীপে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় লালদিঘির পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে, আগে থেকে নোমান ভাই ও মৌলভী সৈয়দকে ঐখানে রাখা হয়েছিল। আমাদেরকে গ্রেফতারের পর ছাত্র বিক্ষোভ আরো ছড়িয়ে পড়ে ১১ ই আগস্ট গ্রেফতার হয় ১০০ এর অধিক ছাত্র। পুলিশ কমিশনার অফিসে আমাদেরকে আলাদা আলাদা ভাবে ইন্টারোগোশন করা হয়। তৎকালীন নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে এবং চৌধুরী হারুন, কমরেড সাত্তার, দেবেন সিকদারসহ কিছু নেতার কথা জিজ্ঞেস করা হয়, তাদের সাথে পরিচয় আছে কিনা প্রশ্ন করা হয়, আমি বললাম না। আসলেই আমার সাথে পরিচয় ছিলো না। আমি ছিলাম খুবই নতুন ছাত্রকর্মী। ছিলাম চট্টগ্রাম সিটি ছাত্র ইউনিয়নের প্রচার সম্পাদক। জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাদেরকে হ্যান্ডকাপ পড়িয়ে কোর্ট ইন্সপেক্টরের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। ঐখানে এন্ট্রির পর চট্টগ্রাম জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়। চট্টগ্রাম জেলের অফিস রুমে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাকালীন চট্টগ্রামের সভাপতি প্রয়াত আবদুল্লাহ আল হারুন ভাই আমাদের জন্য লুঙ্গি, গামছা, সাবান ও টুথপেস্ট নিয়ে আসেন।
জেল খাতায় এন্ট্রির পর হাজতি হিসেবে আমাদেরকে হাজতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। থালা, বাটি, কম্বল আমাদেরকে দেয়া হয়, বলা হয় এইগুলো হলো জেলখানার সম্বল। কয়েকদিন হাজতে থাকলাম আমরা। নোমান ভাইয়ে কাছে চিরকুট এসেছিলো কমরেড পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কাছ থেকে, জেলখানার কাজের লোকের মাধ্যমে, স্টার সিগারেটের ভিতরের কাগজে লেখা ছিলো সাহস না হারানোর কথা। উনি তখন ৫ নং ওয়ার্ডে রাজবন্দী হিসেবে বন্দী ছিলেন। ঢাকা–চট্টগ্রামের পত্রিকায় আমাদের গ্রেফতারের সংবাদ প্রকাশিত হয়।
কয়েকদিন পর আমাদের জন্য ডিফেন্স অফ পাকিস্তান রুলে (উচজ) এক মাসের ডিটেনশন অর্ডার চলে আসে। আমরাও জেলখানার পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে পূর্ণেন্দু দস্তিদার, মান্নান ভাইদের সাথে একি ওয়ার্ডের বাসিন্দা হয়ে গেলাম। এই ওয়ার্ডে ছাত্রলীগ নেতা এসএম ইউসুফ, শহীদ পিসি বর্মণ, সাবের আহমেদ আজগিরী–ছাত্রলীগ, পরে জাসদ নেতা, আমিন জুট মিলের শ্রমিক নেতা দ্বীন মোহাম্মদ সহ ১৭ জন ছিলাম। রাজবন্দীদের মধ্যে ক্যাটাগরি ভাগ ছিলো অ,ই,ঈ কিন্তু সবাই একসাথে রান্না করে গোল দিয়ে বসে খাওয়া হতো। নিজেদের মধ্যে কোনো বৈষম্য ছিলো না। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের ব্যবস্থাপনায় আর পিসি বর্মনের চমৎকার রান্নায় আমরা জেল জীবনের নিসঙ্গতা ও দুঃখ কষ্ট ভুলে থাকতে পেরেছিলাম। জেল লাইব্রেরী ছিলো পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কল্যাণে সমৃদ্ধ। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতির কথা’ রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’সহ প্রচুর বই পড়েছি, পড়তো আরো কয়েকজন। নোমান ভাই আর আমি থাকতাম পাশাপাশি। রাজনৈতিক আলাপ হতো সবসময় উনি আমার বেশ কয়েক বছরের সিনিয়র ছিলেন। মস্কো–পিকিং এর পার্থক্যের অনেক তত্ত্বকথা বলতেন, কিছু বুঝতাম আর কিছু বুঝতাম না। নোমান ভাই জেলখানা থেকে বিএ পরীক্ষা দেন। একসাথে কাটিয়েছি সাত মাস।
আমি ও মান্নান ভাই মুক্তি পেলাম ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তারিখ ও দিনটা মনে নেই। দুপুরবেলা খাওয়ার পর আমাদেরকে মুক্তি দেয়া হলো। কিছু রাজনৈতিক কর্মী জেল গেইটে আমাদেরকে বক্সি হাটের তৈরী কাগজের মালা পরিয়ে দিলেন। তখন, এখনকার মতো কাঁচা ফুলের প্রাধান্য ও ছড়াছড়ি ছিলো না। ইটালিয়ান বেবী টেক্সী করে দুইজন বাসার দিকে যাত্রা করলাম। আমার বাসা ছিলো আসকারদিঘির পাড়, মান্নান ভাইয়ের বাসা দামপাড়া। মান্নান ভাই আমাকে আসকারদিঘির বাসায় নামিয়ে দিয়ে উনার বাসায় চলে গেলেন। নোমান ভাই তখনো মুক্ত হননি। একে একে ফেব্রুয়ারি মাসে সবাই মুক্ত হলেন। সবার শেষে মুক্ত হন শহীদ পূর্ণেন্দু দস্তিদার। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন অগ্নিগর্ভ ও তুঙ্গে। ২২ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে ক্যান্টনম্যান্ট থেকে বীরের বেশে মুক্ত হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ২৩ শে ফেব্রুয়ারি উনাকে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সংবর্ধনা দেয় এবং বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে।
নোমান ভাই শ্রমিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। উনার সাথে মাঝে মধ্যে দেখা হতো, আমরা তখনো ছাত্র আন্দোলনে ব্যস্ত। মুক্তিযুদ্ধকালীন আগরতলার বটতলার চৌমুহনীতে উনার সাথে আবার দেখা হয়। বসে দুইজনে কফি খেলাম। কফির পয়সা উনিই দিলেন, কথা হলো অনেক। উনি বলছিলেন বামপন্থীদের আলাদা করে যুদ্ধের জন্য ফ্রন্ট খোলা প্রয়োজন। তখন কিন্তু এই রকম বাস্তবতা ছিলো না। যুদ্ধ শেষে রাজনৈতিক পথ ভিন্নতার কারণে খুব বেশি দেখা হয়নি। ৭৫ এর নির্মম রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ৭৮ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করলে উনি কিছুদিন পর উনার অনুসারীদের নিয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। ৮১ তে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিচারপতি সাত্তার প্রেসিডেন্ট হন পরে এরশাদের সামরিক শাসন জারী হয়। এরশাদ ক্ষমতায় থেকে জাতীয় পার্টি গঠন করলে বিএনপির অনেকে জাতীয় পার্টিতে চলে গেলেন। উনি তখন বিএনপির হাল ধরে বসে ছিলেন। একসময় বৃহত্তর চট্টগ্রামের মূল নেতায় পরিণত হন। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে উনার সাথে বারবার দেখা হতো, তখন ১৫ দল ৭ দল ও ৫ দলের আন্দোলন তুঙ্গে। মনে পড়ে ৯০ এর নভেম্বর মাসে কায়সার ভাইয়ের চন্দনপুরার বাসার পুকুরঘাটে–কায়সার ভাই, মহিউদ্দীন ভাই, নোমান ভাই ও আমি আন্দোলনের পরিকল্পনার জন্য একদিন বৈঠক করেছিলাম। ২৭ শে নভেম্বর ১৯৯০ ডাক্তার মিলন ঢাকার টিএসসি মোড়ে যখন গুলিবিদ্ধ হয় আমরা তখন চট্টগ্রাম নিউ মার্কেটের মোড়ে ছিলাম, পুলিশ ধাওয়া দেওয়ার পর আমরা আলকরণে ঢুকে পড়ি। বিএনপি নেতা মাবুদ সর্দার আমাদেরকে হোটেলে খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। খাওয়ার পর আমরা খুরশিদ মহলের পাশে পুরাতন গীর্জায় খান বোর্ডিংয়ে আশ্রয় নেই। পরে চারিদিক থেকে মিছিল নিয়ে নিউ মার্কেটের মোড়ে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়। আমরা হকার্স মার্কেটের ভিতর দিয়ে সমাবেশে এসে হাজির হই। সেখানে ১৫,৭ ও ৫ দলের ঐক্যবদ্ধ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। নিউ মার্কেটের গোল চত্বরে পাশাপাশি বসে ছিলাম কায়সার ভাই, মহিউদ্দীন ভাই,আহসান ভাই, নোমান ভাই ও নুরুদ্দীন জাহেদ মঞ্জু সহ। একসাথে পথ চলার ঘোষণা হয় কিন্তু হয়নি। ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯০ এরশাদ স্বৈরাচারের পতন হয়।
আবদুল্লাহ আল নোমান আইয়ুব স্বৈরাচারবিরোধী ১৯৬৯ এর ছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধা। ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নেতা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গেছেন। রাজনীতি করতে গিয়ে অনেক চড়াই উৎরাই, আঁকাবাঁকা পথে হাঁটতে হয়েছে।
৬০ দশকের প্রথমদিকে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ৬০ দশকের তরুণ ছাত্র সমাজ অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল বাংলাদেশের চেতনার জন্মদাতা। বাংলাদেশ তাদের কাঁধে ভর করে এসেছে। আজও বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হয়নি। দেশে চলছে এখনো অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা। কিন্তু বাংলাদেশের বীর জনতা পরাভব আবদুল্লাহ আল নোমান তাঁর কর্মের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।
লেখক: রাজনীতিবিদ; সভাপতি, সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটি।