নব্বই দশকের শেষ দিকের কথা। দৈনিক পূর্বকোণ অফিসে কাজ করছি। সকালের শিফটে আমি শিফট ইন চার্জ। আমার শিফটের কাজ প্রায় শেষের দিকে। সহকর্মীরাও ডিউটি শেষে বাড়ি ফিরেছে। আমি পাতার ডামি করছিলাম। হঠাৎ দেখি দেশের বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান তাঁর সহধর্মিণী জোহরা রাহমানকে নিয়ে আমাদের অফিসে হাজির। তাঁকে সাথে করে নিয়ে আসেন আমাদের সে সময়কার বিজ্ঞাপন ম্যানেজার স্বপনদার মেয়ে জলি চৌধুরী মানে আবৃত্তিশিল্পী মিলি চৌধুরীর ছোট বোন।
এমন বড় মাপের কবিকে হঠাৎ সামনে পেয়ে আমি আনন্দে আত্মহারা। আমাদের দেশের প্রথম সারির আধুনিক কবিদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বাংলা কবিতার পঞ্চপাণ্ডবের শীর্ষজন আমার সামনে! যাঁর কাব্য বাংলা বিভাগের মাস্টার্স ক্লাশে আমাদের পাঠ্য ছিল। প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, রৌদ্র করোটিতে, শূন্যতায় তুমি শোকসভা কিংবা ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, এবার আমি গোলাপ নেবো এসব গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো পড়ে ১০০ নাম্বারের পরীক্ষায় আমাদের পাস করতে হয়েছিল। আধুনিক কবিতা, একটু কঠিন। কবিতাগুলো বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রচুর পড়াশোনা করতে হতো। এই বিষয়টি আবার পড়াতেন আমাদের আরেকজন কবি ও বিদগ্ধ শিক্ষক ময়ুখ চৌধুরী। তাঁর ক্লাসে কিন্তু পড়াশোনা অর্থাৎ হোম ওয়ার্ক করে যেতে হতো। কেননা, তিনি পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে খালি প্রশ্ন করতেন। কখন কি প্রশ্ন করে বসেন, তাই কেবল শামসুর রাহমান নয় বাংলা সাহিত্যের ভালরকম একটা ধারণা নিয়ে তাঁর ক্লাসে হাজির থাকতে হতো। তিনি শামসুর রাহমানের কাব্যসমগ্র পড়াতে গিয়ে বাংলা কবিতার ধারা, তিরিশের কবিকূল জীবনানন্দ, সুধীন দত্ত, বিষ্ণু রায়, অমিয় চক্রবর্তী এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রকে যেভাকে উপস্থাপন করতেন, একইভাবে আমাদের দেশের আধুনিক কবি বিশেষ করে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, পরবর্তীতে আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ এঁদের কবিতার দেশকাল এবং বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোকপাত করতেন।
তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যকালীন সময়ের কবি এবং দেশের সেরা কবির এমন অনাড়ম্বর এবং অনানুষ্ঠনিক আগমনে আমি দিগ্ববিদিক ছোটাছুটি শুরু করি। তাঁদেরকে নিউজ রুমে বসিয়ে আমি প্রথমে কবি শিশির দত্তকে ফোন দিই। তিনি সেসময়ে পূর্বকোণের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। ফোন দিই কবি ও সম্পাদক আবুল মোমেনকে, ফোন দিই নিউজ এডিটরকে কাউকে পাওয়া গেল না। অগত্যা আমাদের তৎকালীন এমডি (বর্তমান সম্পাদক ডা. ম. রমিজউদ্দীন চৌধুরী) সাহেব এলেন অফিসে। আমাদের আলোকচিত্রী রূপম চক্রবর্তীকে ফোন করে অফিসে নিয়ে আসেন। তিনি অনেকের কুশল জিজ্ঞেস করেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের কবিকূলের খবরাখবর। আমি এতো বেশি মর্মাহত হলাম একারণে, কারণ তখন পূর্বকোণে ভরা কবির দল। ভরদুপুর থাকায় সেসময় কেউই অফিসে ছিলেন না। ডাক্তার সাহেব তাঁকে আন্তরিক আপ্যায়ন করলেন। চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ইত্যাদি বিষয়ে তিনি কথা বলেছিলেন কবির সাথে। আমিও বলেছি। বলেছি, ‘আপনার কবিতা পড়ে অতখানি বুঝতে পারতাম না, বেশি বুঝেছি, আমাদের স্যারের উপস্থাপনা গুণে। আপনার প্রতিটি কাব্যগ্রন্থকে তিনি সরস ও প্রাণবন্ত বর্ণনাগুণে অনেক বেশি বোধগম্য করে তুলেছেন।’ বড় কবি, বড় মাপের মানুষ, দেখতে কি সুন্দর রাজপুত্রের মতো। বয়সে অনেক বেশি প্রবীণ, তাতে কি বেশভূষা আর ড্রেস আপ গেট আপে পুরো দস্তুর নবীনের ছাপ। তাঁর স্ত্রী জোহরা ভাবী পাশে বসা। আমি তাঁর কিছু কবিতা নিয়ে আলাপ করি। পুরনো ঢাকার পরিবেশ, মাহুতটুলির বর্ণনা, ঘোড়াগাড়ি এসব তাঁর কবিতায় পড়েছি। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ও পরবর্তীতে স্বৈরশাসনের চিত্রকল্প। তিনি দেশপ্রেমিক এবং অবশ্যই রোমান্টিক কবি। তিনি কেবল হেসেছেন। তিনি বলেন, প্রথমেই তাঁর কাছে বড় হচ্ছে স্বদেশ। এরপরে নিঃসন্দেহে প্রেম আর রোমান্টিকতা।
আমাদের আলোকচিত্রী একটি গ্রুপ ছবি তুললো। পরের দিন ছবিসহ পত্রিকায় শিরোনাম হলো, ‘অফিসে বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান।’
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেলো হরিদাসীর।
…
মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ–তিতিক্ষাকে, কি গভীর সাম্যতায় প্রকাশ করেছেন তিনি।
এমন বড় মাপের একজন কবিকে কাছ থেকে দেখা পরম সৌভাগ্যের। আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে কবিতার বরপুত্র অন্য এক শামসুর রাহমান।