হাসপাতালের করিডোরে তখন নেমে এসেছিল এক অদ্ভুত নীরবতা। ডিউটি ডাক্তার এসে বললেন, ‘পেশেন্টের অবস্থা ভালো না। চাইলে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে শেষ চেষ্টা করা যেতে পারে।’ আমি কিছু বলতে পারিনি। গলা আটকে গিয়েছিল। শুধু দু‘হাত জোড় করে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রইলাম প্রার্থনার মতো করে। হয়তো তাকিয়ে ছিলাম একটু করুণা, একটু অলৌকিক আশার জন্য। ডাক্তার তাড়া দিচ্ছিলেন। নার্স এসে একটি কাগজ এগিয়ে দিলেন সইয়ের জন্য।
ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয় আপনার?’
আমার ঠোঁট কাঁপছিল। খুব ধীরে, অস্ফুট স্বরে বললাম– ‘আব্বু’। এই একটিমাত্র শব্দেই যেন আমার সমস্ত পৃথিবী কেঁপে উঠেছিল। সেই মুহূর্তটি এখনো মনে হলে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
সেদিন ছিল ২০২৩ সালের ১০ আগস্ট যে দিনটিতে আমি হারিয়েছি কেবল একজন মানুষকে নয়, হারিয়েছি আমার আশ্রয়, ভালোবাসা আর জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণাকে আমার বাবা, লোকমান হাকিম।
অধ্যাপক লোকমান হাকিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিদ্যায় অনার্স মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করে ১৯৭০ সনে শিক্ষাজীবন সমাপন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি চট্টগ্রাম সিটি কলেজে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হন। পাশাপাশি এনায়েত বাজারস্থ চট্টগ্রাম মহিলা কলেজেও তিনি শিক্ষকতা চালিয়ে যান। সত্তরের নির্বাচনকালে তিনি অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ (যিনি পরবর্তীতে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন)-এর নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তিনি দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি রাউজান উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামমুখী উন্নয়ন কার্যক্রম যথা–আদর্শ গ্রাম প্রকল্প যা জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং ভূমিহীন কৃষকদের তদারকী ঋণ প্রকল্প পরিচালনা করেন। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের নেতৃত্বে দেশ উন্নয়ন কাজে একনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ার কারণে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ সুপিরিয়র সার্ভিসে সুযোগ পেয়েও যোগ দেননি। তিনি ১৯৭৬ সনের প্রথমদিকে ভারতে তিন মাসব্যাপী গ্রাম উন্নয়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ৭৬–৭৭ সনে সোভিয়েট ইউনিয়নে সমবায়ের উপর ডিগ্রি নেন। পরবর্তী সময়ে তিনি জাতীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা–প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রে যোগ দেন। গ্রামমুখী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন কাজে থাকাকালে তিনি চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী ও দৈনিক পূর্বকোণ–এ নিয়মিত কলাম লিখতেন। মৃত্যু পরবর্তী তাঁর প্রকাশিত কিছু সম্পাদকীয় নিয়ে একটি বই নাম ‘আঁধার পেরিয়ে আলোয়’ ছাপানো হয় যেটি অধ্যাপক মুহাম্মদ খালেদ স্যারকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করে গেছেন। ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ উন্নয়নকর্মী। জনগণের সেবা করাকেই তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর চোখে সমাজ মানে ছিল মানুষের পাশে দাঁড়ানো, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, এবং নিজের অবস্থান নিজ হাতে গড়ে নেওয়া। তিনি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) নাম পেইজ ডেভেলপমেন্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা আজও সুনামের সঙ্গে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বাবার রচিত তিনটি বই সমাজ উন্নয়ন ও মানবিক ভাবনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তাঁর লেখার মূল সুর ছিল ‘মানুষকে বোঝো, তাদের পাশে দাঁড়াও, এবং নিজের শক্তি দিয়ে সমাজে আলো ছড়াও।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল তাঁর তরুণ দিনের স্মৃতিতে ভরপুর ছিল। সেখানে গেলেই যেন তাঁর চোখে জ্বলে উঠত স্বাধীনতার স্বপ্ন আর ছাত্রজীবনের চেতনা। সেইসব স্মৃতির ভেতর দিয়েই তিনি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করে গেছেন মূল্যবান শিক্ষা।
আমার বাবার সবচেয়ে বেশি বলা কথাগুলোর একটি ছিল: ‘জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে হোক সামাজিক সম্পর্ক অথবা কাজ নিজের অবস্থান নিজেকেই বানাতে হবে।’ এই কথাটা আজও আমাকে চালিয়ে নিয়ে যায় প্রতিটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তার শিক্ষা, আদর্শ আর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এখনো আমার জীবনকে আলোকিত করে। আমি গর্বিত, আমি তাঁর মেয়ে। তাঁর পরিচয় আমার জন্য শুধু গর্ব নয়, আশীর্বাদও বটে।
যেখানেই গিয়েছি, যখনই নিজেকে তাঁর কন্যা বলে পরিচয় দিয়েছি মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মান আমাকে আবৃত করে রেখেছে। সেই মুহূর্তগুলোতে আরও গভীরভাবে অনুভব করেছি, তিনি কেমন একজন অনন্য মানুষ ছিলেন।
প্রায়ই মনে হয় তিনি এখনো আমার পাশে আছেন। প্রতিদিনই মনে মনে আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলি কখনো নিজের সিদ্ধান্ত শেয়ার করি, কখনো আবার দুঃখ কিংবা আনন্দ ভাগ করে নিই। মানুষ বলবে, তিনি নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস, বাবারা কখনোই হারিয়ে যান না। তারা বেঁচে থাকেন আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি সৎ কাজে, আর আমাদের হৃদয়ের গভীরে।
তাঁর ২য় মৃত্যুবার্ষিকীতে, আমি বাবাকে গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করছি। তিনি নেই এই সত্য যতটা কষ্টদায়ক, তার চেয়েও বেশি আশাব্যঞ্জক একটি সত্য হলো তিনি আমার ভেতরেই আছেন। আমি যখন ভালো কিছু করি, মানুষের পাশে দাঁড়াই, নিজের জায়গা তৈরি করি তখন আমি জানি, তিনি আমার সঙ্গেই আছেন।
লেখক : অধ্যাপক লোকমান হাকিমের কন্যা।