একটি নতুন বছর শুরুর সাথে সাথে একজন শিক্ষার্থীর একটি নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়া। এক্ষেত্রে সন্তানদের স্কুলে যাওয়ার বিষয়টি অভিভাবকদের জন্য একটা বিশাল চিন্তার বিষয়। একটা কোমলমতি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন শুরুর আগে থেকেই অভিভাবকরা যাতায়াতের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি যুদ্ধের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় স্কুলে উপস্থিত হয়। শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও মেধা অনুযায়ী অভিভাবকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেন। সময় ও স্থান ভেদে এই পরিবর্তন ধারা অব্যাহত থাকে। সবার ইচ্ছা থাকে; একটা ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করা। আর এই ইচ্ছার পিছনেও শিক্ষার্থীর অনেক বেশি ভূমিকা থাকে। শিক্ষার্থীর ইচ্ছা ও আগ্রহ না থাকলে কখনো অভিভাবকদের একক প্রচেষ্টায় অনেক দূর যাওয়ার সম্ভব না। কিন্তু সবকিছুকে ঘিরে যাতায়াত সমস্যা প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। নিরাপদ জীবনের বিষয়টি অভিভাবকদের ভাবিয়ে তোলে। যারা বাড়ির পাশে স্কুলে পড়ালেখা করে এবং নিজেদের সামাজিক পরিবেশের ভিতরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে তাদের সেই চিন্তাটুকু থাকে না। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদেরকে ঠিকই দূরের অন্য স্কুলে এবং কলেজে যেতে বাধ্য হতে হয়। কারণ ভালো ভালো স্কুল কলেজগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর ভালো ভালো স্কুল এবং কলেজে ভর্তি যুদ্ধের মাধ্যমে আবার নতুন করে শিক্ষা জীবন শুরু করতে হয়। বিশেষ করে ছোট ছোট কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে যাতায়াত সমস্যাটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শিশুরা নিজেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারে। আসা–যাওয়ার বিষয়টির জন্য সম্পূর্ণ অভিভাবকদের ওপর নির্ভর করতে হয়। শিক্ষার্থীদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়া এবং আবার নিয়ে আনার ক্ষেত্রে যাতায়াত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরে হয়তো শিক্ষার্থীরা নিজেরাও যাতায়াত করতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও যাতায়াতের বিষয়টি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রধান চিন্তার বিষয় থাকে।
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। আমাদের জনবহুল দেশে রাস্তাঘাটের পরিমাণ খুব কম। তাছাড়া গাড়ির পরিমাণও কম। জনসংখ্য অনুযায়ী যানবাহনের সংখ্যা এবং রাস্তাঘাটের পরিমাণ খুব কম হওয়ায় যাতায়াতের সমস্যা একটা বড় সমস্যা। স্কুলগামী ছাত্র–ছাত্রীদের ক্ষেত্রে এ সমস্যাটি আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমাদের রাস্তাঘাটের পরিমাণ যেহেতু কম প্রতিদিন যানজটের সমস্যা থেকে যাচ্ছে। জনসংখ্যা অনুপাতে গাড়ির সংখ্যা ও রাস্তাঘাটের সংখ্যা খুবই কম হওয়ায় ছাত্র–ছাত্রী ও অভিভাবকদেরকে অনেক ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়। কে কার আগে দৌড়াবে – এক ধরনের প্রতিযোগিতা লেগে থাকে। আর এই প্রতিযোগিতার আরও একজন হচ্ছে গাড়ির চালক। গাড়ি চালকের একটি বড় অংশ হচ্ছে অশিক্ষিত ও অদক্ষ। আমাদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত গাড়িতে বাইরের সকল কাজকর্ম শেষ করে। কিন্তু এই সংখ্যা খুবই নগণ্য। একটা বিশাল পরিমাণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে সাধারণভাবে যাতায়াত করতে হয়। জনসাধারণের জন্য নির্ধারিত গাড়িগুলো তাদের একমাত্র হাতিয়ার। আর এই গাড়িগুলোর মধ্যে থাকে তীব্র প্রতিযোগিতা। আশেপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হয়তো রিক্সায় যাতায়াত করে। এককভাবে রিকশায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে গাড়ি ভাড়া অনেক বেশি লাগে। তাই মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো বাস টেম্পুতে চলাচল করে। এতে গাড়ি ভাড়ার পরিমাণ অনেক কম লাগে। সময় সাশ্রয় হয়। কিন্তু একটা সময় যখন একসাথে সকলে রাস্তায় বের হয় তখন মানুষের অনুপাতে যানবাহনের সংখ্যা কম থাকায় প্রতিযোগিতা চলে। এই প্রতিযোগিতার ফলে বিভিন্ন স্থানে যানজটের সৃষ্টি হয়। অনেক শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। আবার অত্যন্ত দুঃখের বিষয় ; এই প্রতিযোগিতার ফলে অনেক স্থানে দুর্ঘটনা ঘটে। কেউকে অঙ্গহানি হয়ে প্রতিবন্ধী জীবন যাপন করছে। আবার কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করছে। যান্ত্রিক জীবনের যান্ত্রিকতায় অনেকের অপমৃত্যু হচ্ছে। তাই যানবাহনের সমস্যাটি শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই প্রধান আলোচ্য বিষয়। শিক্ষার্থীদের নিরাপদে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা–যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের। স্মার্ট স্কুল বাস চালুর মাধ্যমে এই সমস্যাটা অনেকাংশে কমে যাবে। স্মার্ট স্কুল বাস চালানোর ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা নিশ্চিন্তে থাকবে।
স্মার্ট স্কুল বাস যাত্রার পরিকল্পনাটি নিয়ে জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোঃ ফখরুজ্জামান একটি ইতিবাচক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি বলেন ; চট্টগ্রাম শহরকে একটি স্মার্ট জেলায় প্রণীত করার জন্য স্মার্ট স্কুল বাস যাত্রার কোনও বিকল্প নাই। আমাদের শিশুরা যাতে নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে স্কুলে যেতে পারে তার জন্যই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আমাদের প্রিয় চট্টগ্রাম শহরকে স্মার্ট জেলায় রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে কয়েকটি পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এক্ষেত্রে তিনি স্মার্ট জেলা উদ্ভাবন চ্যালেঞ্জ ২০২৩ এর প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন। টাকার অংকে এ পুরস্কারের পরিমাণ আশি লাখ টাকা। আর এই টাকাটি সম্পূর্ণরূপে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের জন্য স্মার্ট স্কুল বাস পরিচালনার জন্য খরচ করা হবে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধনকৃত দশটি স্কুল বাস প্রযুক্তি সুবিধা আওতায় এনে স্মার্ট স্কুল বাসে রূপান্তরের কাজ চলছে। মোটামুটি একটি বাসের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৯টি স্মার্ট স্কুল বাস এ মাস থেকে চালু করা যাবে। আপাতত শিক্ষার্থীদের খরচ করতে হবে ৫ টাকা। আগামী বছর থেকে ১০ টাকা করে শিক্ষার্থীরা ভাড়া দিবে। স্মার্ট স্কুল বাস পরিচালনার ফলে নগরের যাতায়াত সমস্যা কিছুটা কমবে। বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে সখ্যতা গড়ে উঠবে। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের ভোগান্তি কমবে। তাছাড়া ব্যক্তিকেন্দ্রিক অধিক যাতায়াতের ক্ষেত্রে জ্বালানি খরচ সাশ্রয় হবে। সড়ক দুর্ঘটনা ও কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার মত সমস্যার সমাধান হবে। বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়; স্মার্ট স্কুল বাসের পরিকল্পনা সুদুরপ্রসারি চিন্তার ফসল। এই কর্মসূচির কারণে অভিভাবকদের ভোগান্তি ও উৎকণ্ঠা দূর হবে। স্মার্ট স্কুল বাস চালানোর মধ্য দিয়ে জেলা প্রশাসক হিসেবে আবুল বাসার মো. ফখরুজ্জামান নিজের মেধা ; সাহসিকতা ও মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে নিরাপদে তাদের শিক্ষা জীবন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাটাতে পারে সেটাই সকলের কাম্য। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা মানেই সকলের নিরাপত্তা।
লেখক: প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,
ডা: ফজলুল–হাজেরা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।