শহর মানেই ব্যস্ততার নানা উপাখ্যান, যান্ত্রিকতার হরেক আয়োজন। বলা যায় ব্যস্ত–যন্ত্রে মেশানো জনবসতি। এই শহরে এক টুকরো সবুজ গড়তে পারাও অনেক বড় ফলদায়ক। সুন্দর পরিকল্পনায় অগ্রসর হতে পারলে, শোভা দেয়ার পাশাপাশি রোজগারের উপলক্ষ হিসেবেও আসতে পারে এইসব সবুজ প্রয়াস।
নিত্য ব্যস্ততা পাশ কাটাতে যদি একটা প্রাযুক্তিক উপায়ে গড়া যায় এই সবুজ তাহলে তো বেশ হয়! যন্ত্রের ঘেরাটোপকে যন্ত্র দিয়ে শাসন করেও এখন ফুল–ফসলের চাষ করা যায়। পরিকল্পনামাফিক এসব করতে পারলে নগর কৃষিতেও বড় সাফল্য পেতে পারি আমরা। যে পরিকল্পনাকে আমরা স্মার্ট কৃষি নামেও এগিয়ে নিতে পারি। এটাকেই বলা হচ্ছে স্মার্ট নগরীর জন্য স্মার্ট কৃষি।
বর্তমানে আমরা ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব’ বা ‘ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন’ বা ‘ফোর আইআর’ এর লগনে। এমন পরিস্থিতিতে কৃষিতে ফোর আইআরের প্রভাব, সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ এবং তা মোকাবিলায় আমাদের করণীয় ঠিক করতে হবে। আমরা যদি এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে না পারি, তাহলে পিছিয়ে পড়ব, সন্দেহ নেই। আর এই তাল মেলানোর নামই স্মার্ট কৃষি।
স্মার্ট কৃষিতে ইন্টারনেট অব থিংস, সেন্সর, লোকেশন সিস্টেম, অটোমেশন, রোবটিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে জায়গার সর্বোত্তম ব্যবহার এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি করতে সক্ষম করে তোলা যায়। যথার্থ সেচ এবং সুনির্দিষ্ট উদ্ভিদ বাছাই, পুষ্টির জন্য সেন্সর, মাটি, জল, আলো, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ব্যবস্থাপনার জন্য সফটওয়্যার, জিপিএস, মোবাইল সংযোগ, রোবট ব্যবহার–বিশ্লেষণ তথা ইন্টারনেট অব থিংস থেকে প্রাপ্ত ডাটার মাধ্যমে এই কৃষি পরিচালিত হয়। এসব ব্যবস্থার থাকায় কৃষক প্রক্রিয়াগুলো নিরীক্ষণ করতে পারে এবং দূর থেকে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। জিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগের পূর্বাভাস প্রদান ও দমন ব্যবস্থাপনা, রোবটিক্স (ক্ষেত্র বিশেষে) ইত্যাদি ব্যবহারে কম খরচে অধিক ফলন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে।
এছাড়াও শহর এলাকায় গ্রিনহাউসের মধ্যেও বিভিন্ন সবজি সারা বছর চাষ করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এজন্য উপযুক্ত জায়গায় গ্রিনহাউস স্থাপনের সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বিশ্বে অল্প জায়গায় স্বচ্ছ কাচঘেরা পুরো নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে ভার্টিক্যাল ফার্মিং হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক নগর কৃষি আরো টেকসই করা সম্ভব, কারণ এতে সেচের পানির অপচয় ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ কমিয়ে এনে ৩–৪ গুণ ফলন বাড়ানো যায়। যেখানে হাইড্রোপনিক্যালি পুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ পানিকে অটোমেটিক এবং জলবায়ুনিয়ন্ত্রিত বিল্ডিংয়ে সংরক্ষণ করে পুনরায় ব্যবহার করা হয়। আধুনিক এই প্রযুক্তির ইনডোর ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সেন্সর বেইজড এগ্রিকালচার ইত্যাদি ব্যবহারের কারণে এককালীন খরচ বেশি হতে পারে। তবে বিধায় স্থানীয় উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে এর খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব। ভার্টিক্যাল ডিভাইস, স্মার্ট ফার্মিং ডিভাইস, গ্রিন স্ক্রিন, স্বয়ংক্রিয় সেচসমৃদ্ধ ভার্টিক্যাল লাইন ডিভাইস ইত্যাদি এখন আমাদের দেশেই তৈরি করা সম্ভব। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপে কাজ করলে নগর ফার্মিং টেকসই ও লাভজনক করা সম্ভব।
আমরা জানি, ইতিমধ্যে কৃষিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার শুরু হয়েছে। কৃষিতে এ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে একদল আইটি ইঞ্জিনিয়ার ও কৃষিবিদ ‘ডা.চাষী’ মোবাইল এ্যাপ বাংলাদেশে গুগল প্লে–স্টোরে রিলিজ করেছেন। এ এ্যাপ দিয়ে ছাদ–বাগান এবং মাঠ ফসলের রোগ ও পোকামাকড়ের সঠিক তথ্য ও সমাধান জানা সম্ভব হচ্ছে। ডা. চাষী অ্যাপ মূলত যেভাবে কাজ করে: কৃষকরা তার ফোনে ডা. চাষী অ্যাপ ডাউনলোড করেন এবং ফসলের আক্রাস্ত স্থানের ছবি তুলেন, তাহলেই ‘ডা. চাষী’ অ্যাপ বলে দেয় কৃষকের ফসলের সমস্যা ও সমাধান। এছাড়া ডা: চাষী অ্যাপ থেকে আরও যে সকল সুবিধা পেয়ে থাকেন তা হল: আগাম সাত দিনের কৃষি আবহাওয়ার পূর্বাভাস, কল সেন্টারের সহায়তা নেওয়া, দরকার হলে সমস্যা ও সমাধান ভয়েজে শুনতে পারা। ফসলের সমস্যা ও সমাধানের জৈব এবং রাসায়নিক সমাধান পণ্যসহ জানতে পারা ইত্যাদি। ‘ডা.চাষী’–এর মতো আরো প্রাযুক্তিক উপস্থিতি ও ব্যবহার বাড়িয়ে গুরুত্ববহ করে তোলা যায় নগর কৃষিকে।
স্মার্ট কৃষির আরেকটি বাস্তব উদাহরণ দিই। কিছুদিন আগে বাংলাদেশী–আমেরিকান চুয়েট ক্যাম্পাস ভিজিট করছিলেন। দেখা গেছে, এই ভিজিটের ফাঁকে ফাঁকে তিনি মোবাইল আ্যপে তাঁর আমেরিকাস্থ বাড়ির আশে–পাশের খামার, গাছপালার দেখভালও করছিলেন। উনার খামার ও বাগান প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত। খামারে রয়েছে একাধিক সেন্সর, যার মাধ্যমে আর্দ্রতার পরিমাণ, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের উপস্থিতি এবং গাছে কোনো রোগের আক্রমণ ঘটছে কিনা তা বোঝা যায়। কোন কৃষক কবা মালীর শারীরিক তদারকি নেই। প্রযুক্তি সেট করা আছে– প্রযুক্তির আহ্বানে পানি সেচ, বালাই নাশক, সারের ব্যবহার অটো পেয়ে যাচ্ছে গাছ–গাছালি। এর ফলে হাজার মাইল দূরে থেকেও তিনি নিশ্চিত থাকতে পারছেন। দূর নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি সঠিকভাবে খামার পরিচালনা করতে পারছেন। নগর জীবনে একনাগাড়ে সময় বের করা কঠিন, তাই মোবাইল আ্যাপ এর মাধ্যমে তদারকিতে সময়ও বাঁচে, সবুজও ভালো থাকে। আমাদের দেশেও এমন সিস্টেম এবং আ্যাপ ব্যবহার চালু করা যেতে পারে।
আমাদের দেশে নগর কৃষি বলতে এখনও ছাদকৃষিকেই বোঝায়। কারণ শহরে চাষাবাদের একটি বড় অংশ হলো ছাদ। ছাদবাগান দিয়ে অনেক পরিবারের ফল–ফসলের চাহিদাও মিটছে। কিন্তু এর পাশাপাশি এখনই ভাবতে হবে বাণিজ্যিকভাবে নগর ভার্টিক্যাল ও ইনডোর চাষাবাদ নিয়ে। যা দেশের কৃষি সেক্টরে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ চলছে। অতিবৃষ্টি কিংবা অনাবৃষ্টি, আগাম–অকাল বন্যা যেন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিগড়ে যাওয়া আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। এছাড়া দেশের জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিপরীতে আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। কৃষিজমির ক্ষুদ্রায়তন, কৃষিশ্রমিক–সংকটও বিদ্যমান। এরপরও বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এক ইঞ্চি জমিও ফাঁকা না রাখতে নির্দেশনা দিয়েছেন। তাই কৃষিতে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার সময় এখনই।
তবে কৃষিতে ফোর আইআর বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ থাকবে যেমন–প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, নলেজ গ্যাপ, ধীরগতির ইন্টারনেট, দেশীয় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের অভাব, মোটিভেশনের অভাব ইত্যাদি। আমাদের এসব সমস্যা সমাধান করে দ্রুত সামনের দিকে এগুতে হবে।
আমাদের কৃষিতে এরইমধ্যে সফল ডিজিটালাইজেশন ঘটেছে। ফলে কৃষি অর্থনীতিতেও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। বিপুলসংখ্যক প্রযুক্তি–প্রেমী কৃষি ব্যবসায় উদ্যোক্তা হচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ইত্যাদির মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ডিজিটাল জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে অনেকেই। প্রযুক্তি এখানে বড় ভূমিকায় আছে। আমরা এখন নগর কৃষিকে এখন নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারি।
লেখক: উপ–পরিচালক (তথ্য ও প্রকাশনা),
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।










