মৌলভী হাফিজুর রহমান বিএবিটি। একজন শিক্ষাবিদ, জ্ঞান-তাপস। আমার সৌভাগ্য, তিনি আমার বাবা। ভাই-বোনদের মধ্যে আমি সবার ছোট হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে মা-বাবাসহ সকলের আদর স্নেহে আমার বেড়ে ওঠা। মা ছিলেন অতি কোমলপ্রাণ, সহজ-সরল, শান্ত-শিষ্ট এক ভদ্র মহিলা। ধর্মপ্রাণ, বিদূষী, আদর্শ মহিলা ছিলেন আমার মা।
বাবা ছিলেন উচ্চ ইংরেজি শিক্ষিত অথচ ইসলামী জীবন ধারায় পরিচালিত এক আধ্যাত্মিক সিদ্ধ পুরুষ। শেষ জীবনে তিনি দীর্ঘ একুশ বছর নানুপুর আবু সোবহান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ছোটবেলা থেকে দেখেছি, সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবী ছিল বাবার নিত্য দিনের পোশাক। ফজরের নামাজ শেষে নিম্নস্বরে পবিত্র কোরআন তেলোয়াত ছিল বাবার প্রাত্যহিক রুটিনের অংশ। বাবাকে আজীবন ঘড়ি ব্যবহার করতে দেখিনি। তবুও সময়ানুবর্তিতা ছিল তাঁর দৈনন্দিন কাজের দিক নির্দেশনার মত।
আমাদের স্কুলে ক্লাসের সময়সূচী ছিল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে। আব্বাসহ ভাইবোনরা সবাই সকাল ১০টার আগেই মধ্যাহ্ন আহার সেরে স্কুলমুখী হতাম। স্কুল ভবনের অবস্থান ছিল আমাদের বাসা থেকে ১০০ গজ দূরে। সোয়া ১০ টায় এসেম্বলি হতো। পরে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ শ্রেণী কক্ষে হাজির হতো।
স্কুলে অধ্যয়নকালে দেখেছি, বাবা কি রকম ব্যক্তিত্ববান ছিলেন! তাঁকে ছাত্র-শিক্ষক সকলেই সমীহ করে চলতেন। প্রশাসনিক ও একাডেমিক উভয় দিকেই বাবা ছিলেন অত্যন্ত কড়া ও দক্ষ। পাঠদানের জন্য শ্রেণী কক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই সমস্ত কক্ষে জুড়ে থাকতো পিন পতন নীরবতা। আব্বা শুধু নবম ও দশম শ্রেণীতে ইংরেজি পড়াতেন। ইংরেজি উচ্চারণের সময় মনে হতো তিনি বাঙালি নন। বাংলা, আরবী, উর্দু, ফার্সীতেও বাবার বেশ দখল ছিল।
ছোটকালে দৈনিক আজাদী’র আগামীদের আসরে আমি ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ লিখতাম। আব্বা আমাকে খুব উৎসাহ দিতেন। পত্রিকায় প্রকাশ পেলে শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের দেখাতেন। আব্বা আপাদমস্তক ধার্মিক ছিলেন কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। আগাগোড়া অসামপ্রদায়িক চরিত্রের মানুষ ছিলেন। আব্বার নিকট সব ধর্মের ছাত্র-শিক্ষকরাই ছিলেন সমান। সেজন্য ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের ছিলেন তিনি পরম শ্রদ্ধাভাজন। কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের স্বত্ত্বাধিকারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সদ্য প্রয়াত লায়ন প্রফুল্ল রঞ্জন সিনহার ‘আমার শিক্ষক মৌলভী হাফিজুর রহমান বিএবিটি’ লেখা পড়েই তা’ অনুধাবন করি। এ লেখাতেই দেবতুল্য শিক্ষকের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগের ভাষা খুঁজে পাই। ১৯৮৫/৮৬ সালের কথা। আব্বা তখন অবসরে গ্রামের বাড়ি রাউজানের মোহাম্মদপুরে। আমাদের বাড়ির আমানত উল্লাহ মাস্টার সাহেবের মেয়ে কুন্ডেশ্বরী গার্লস কলেজে ভর্তি হবে। মাস্টার সাহেব তাঁর কন্যার ভর্তির ব্যাপারে প্রফুল্ল রঞ্জন সিনহার নিকট বাবার একটি পত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। সিনহা বাবু যখন শুনলেন পত্র বাহককে তাঁর শিক্ষক হাফিজ মিয়া পাঠিয়েছেন, তিনি নাকি তখন সেন্ডেল খুলে রেখে খালি পায়ে পত্রটি হাতে নিয়েছিলেন। গুরুভক্তির এমন উদাহরণ সত্যিই বিরল।
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত মিতব্যয়ী মানুষ। শুনেছি, ১৯৬৩ সালে নানুপুর স্কুলে আব্বার যোগদান নিশ্চিত হওয়ার পর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা, শিল্পপতি ও দানবীর মির্জা আবু আহমদ জায়গা কিনে একটি পাকা আবাসিক হেডমাস্টার কোয়ার্টার নির্মাণ করে দেন। স্কুলের খরচ না হওয়ার জন্য বাবার অবসর গ্রহণ পর্যন্ত দীর্ঘ বাইশ বছর এই একতলা ভবন চুনকাম/রং বিহীন ছিল। একবার মির্জা আবু সাহেব বাসা পরিদর্শনে এসে বলেছিলেন, “হেড মাস্টার সাহেব, আপনার বাসার কক্ষ অপর্যাপ্ত হয়েছে মনে হয়। আর একটি রুম বাড়িয়ে দিই।” বাবা খরচ কমানোর জন্য মির্জা সাহেবের সেই প্রস্তাব সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
আমরা ৬ ভাইবোন বাবার শয্যাকক্ষে পাতানো একটি লম্বা টেবিলে পড়ালেখা করে এসএসসি পর্যন্ত পাশ করেছিলাম। আব্বা রাত ১০ টার মধ্যে মশারী টাঙ্গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। বাবার মশারীর ভেতরে হারিকেনের আলো গেলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে আশংকায় আমরা মশারীর গায়ে একটি চাদর ঝুলিয়ে দিতাম। তারপর অনুচ্চ স্বরে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করতাম। মা-বাবার প্রতি আমরা সন্তানরা ছিলাম অত্যধিক যত্নবান ও শ্রদ্ধাশীল।
বাবার মধ্যে লোভ-মোহ কোনদিন দেখিনি। তিনি ছিলেন সর্বপ্রকার জাগতিক আচার, নিয়মাবলীর অনেক ঊর্ধ্বে। আজকাল বহু শিক্ষিত এমন কি ধর্মীয় ব্যক্তিদের মধ্যেও পরনিন্দা, পরচর্চা দেখা যায়। কিন্তু আব্বা ছিলেন এই সমস্ত মানবীয় দোষ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। কিছু অতি শিক্ষিত মানুষকেও দেখা যায় আমন্ত্রণ পত্রে নাম আগে-পিছে হলে আমন্ত্রণ দাতাদের ওপর রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে যায়। ক্ষোভ ঝাড়ে। অনুষ্ঠান বয়কট করে। অথচ আমার বাবার মনে এগুলো কোনদিন বিন্দু মাত্র রেখাপাত করেনি। একটি ঘটনা বলি। সালটা ১৯৯৩। মোহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয় থেকে ১৯৩৩ সালে মধ্য ইংরেজি বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে আমার বাবা সমগ্র চট্টগ্রাম জেলায় প্রথম স্থান লাভ করেন। আব্বাকে এর আগেও বিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেকবার সভাপতি/প্রধান অতিথি করা হয়েছে। তাই হয়তো স্কুল কর্তৃপক্ষ সেবার প্রধান অতিথি হিসেবে অন্য কাউকে বেছে নিয়েছেন। যথারীতি কার্ড ছাপানো হয়েছে। কিন্তু বাধ সাধলেন প্রধান অতিথি। তিনি ঢাকায় এমন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কাজে আটকে গেছেন যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে অপারগ। উপায়ন্তর না দেখে স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবুু অনিল কৃঞ্চ দাশ ও হেড মৌলানা আবদুস সালাম সাহেব ছুটে এলেন আমাদের বাড়িতে। তাঁরা বাবাকে সবকিছু খুলে বললেন এবং অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার জন্য বিনয়ের সাথে অনুরোধ জানালেন। সেদিন হয়তো আমার বাবার জায়গায় যদি অন্য কেউ হতেন তা’হলে অনুষ্ঠানে তো যেতেনই না বরঞ্চ প্রধান শিক্ষক ও হেড মৌলানাকে কিছু কথা শুনিয়ে দিতেন। কিন্তু নির্ধারিত দিনে বাবা স্কুলের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে মহৎ হৃদয়ের পরিচয় দিয়েছিলেন।
১৯৯৯ সালে আমার বাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে “শোকোচ্ছ্বাস” নামে প্রকাশিত একটি স্মরণিকায় বাবার ছাত্র, চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের বাংলা ভাষা সাহিত্যের প্রাক্তন শিক্ষক, অধ্যাপক আহমদ হোসেন এর লেখা থেকে কোড করছি : “একজন শিক্ষক, সর্বোপরি একজন প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাঁর সমকক্ষ ব্যক্তি সমগ্র দেশে খুঁজে বের করা দুষ্কর। হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শিক্ষকের শিক্ষা দেয়া একটি সবকের দান পাহাড় পরিমাণ সোনার চাইতেও বেশি। আমি দুনিয়া পরিমাণ স্বর্ণ বা ধন-দৌলত দিয়েও আমার এই শিক্ষক থেকে লব্ধ জ্ঞানের ঋণ শোধ করতে পারব না। আমার পরম পূজনীয় এই শিক্ষক থেকে শেখা জ্ঞান তাই আমার কাছে অমূল্য চির ভাস্বর, চির উজ্জ্বল, চির অম্লান।”
বাবার সম্পর্কে লিখতে গেলে আরও অনেক কিছুই লেখা যাবে। আগামীকাল ৮ এপ্রিল ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকীর এই দিনে বাবার স্মৃতি খুবই মনে পড়ে। আল্লাহ, আমার মরহুমা ও মরহুম মা-বাবাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন।
লেখক : মৌলভী হাফিজুর রহমান বিএবিটির কন্যা।