স্মরণ : নিভৃতচারী সমাজব্রতী মোহাম্মদ মোসলেহ্‌ উদ্দিন এফসিএ

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | মঙ্গলবার , ১ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

বীর প্রসবীনি উর্বর রাউজানের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক মেধাবী মুখ। যাঁদের অধিকাংশই চির অচেনা, প্রচারবিমুখ। এসব মানুষেরা জনসমক্ষে নিজেকে জাহির করতে চান না মোটেই। তাঁরা জানেন না বিলাসী জীবন কি? জানেন না ধন সম্পদের পাহাড় গড়তে। আজকাল দুস্থ মানবতায় সামান্য দান করলেই বড়সড় নেতা হওয়া যায়। অল্প কিছু দান করেই সংবাদ মাধ্যমে তা ফলাও করে ছাপানো হয়-এগুলো সত্যিকারের লোক দেখানো সমাজকর্ম, তা অচিরেই নিঃশেষ হতে বাধ্য-যার ছিঁটেফোটাও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অংশ হতে পারে না। সত্যিকারের সমাজকর্মী তারাই-যারা মানবতার সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করে শুধুমাত্র মহাশক্তিমান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। তারা প্রচার করে বেড়ায় না, কাউকে খোঁটা দিয়ে দানগ্রহীতাকে কষ্ট দেয় না-এটাই সত্যিকারের সমাজসেবা। আজকাল ভুইফোঁড় সমাজকর্মী আর সমাজ সংগঠনের কোন অভাব নেই এ দেশে। অল্পস্বল্প সমাজকর্ম করেই অনেকে বনে যান বড় মাপের নেতা! অগ্নিকান্ড, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বানভাসি মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ, করোনা আক্রান্ত মানুষ-এ ধরনের ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের সরকারি বরাদ্দের শত ভাগের ৫ ভাগ দিয়ে বাকী অর্থ সাবাড় করেন অনেক জনপ্রতিনিধি। এটি এখন টক অব দা কান্ট্রি-তে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ‘যারা আল্লাহতায়ালার পথে নিজেদের ধন সম্পদ ব্যয় করে এবং ব্যয় করে তা প্রচার করে বেড়ায় না, প্রতিদান চেয়ে তাকে কষ্ট দেয় না, তাদের মালিকের কাছে তাদের জন্যে পুরস্কার রয়েছে, এদের কোন ভয় নেই, তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না’-সূরা বাকারা-২৬২। এমনি এক প্রচারবিমুখ সমাজহিতৈষী, নিভৃতচারী সমাজসেবকের কথা বলব আজ। তিনি হলেন মোহাম্মদ মোসলেহ্‌ উদ্দিন এফসিএ।
চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার অন্তর্গত শাহ্‌নগর গ্রামের আবদুল জব্বার মুন্‌শী বাড়ীর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম ১৯৩৩ সালের ১০ মার্চ। পিতার নাম মো. সিরাজুল হক এবং মাতার নাম উম্মে সালমা। তাঁর মাতা একজন বিদূষী এবং ধার্মিক মহিলা ছিলেন। পিতা ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। মোসলেহ্‌ উদ্দিন বাল্যকাল থেকেই কিছুটা ব্যতিক্রম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন মেধাবী, অধ্যবসায়ী এবং পরিশ্রমী। ১৯৩৭ সালে মাওলানা আমীর আলী সাহেবের মক্তবে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু। ১৯৪০ সালে শাহ্‌নগর প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে রাউজান আর. আর. এ.সি. ইনস্টিটিউশন হতে এস.এস.সি পাস করেন, এরপর তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট এবং ডিগ্রি পাস করেন। বি.কম.-এ তিনি সে সময় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন। অত:পর ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.কম. পাস করেন। ১৯৫৭ সালে সরকারি বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে লন্ডন যাত্রা করেন। ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্টস ইন ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েল্‌স হতে ১৯৬৩ সালে সি.এ. পাস করেন।
পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন সফল পেশাজীবী। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত তৎকালীন পাকিস্তান ও বাংলাদেশে রহমান-রহমান হক চার্টার্ড একাউন্টেন্টস এর পার্টনার ছিলেন এবং পাশাপাশি পাকিস্তানের কনসাল্‌টিং ফার্ম ই ডব্লিউ পি এসোসিয়েটস লি. এর পরিচালক ছিলেন। আন্তর্জাতিক চার্টার্ড একাউন্টেন্টস কুপারস এন্ড লিব্রান্ড এর সিনিয়র ম্যানেজার ছিলেন ১৯৭৪ থেকে ৭৮ পর্যন্ত। ১৯৭৯ থেকে ৮৪ পর্যন্ত দীর্ঘ ৫ বছরের অধিককাল সময় তিনি আফ্রিকার দেশ জাম্বিয়ায় চাকরি করেছেন অত্যন্ত সুনামের সাথে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপ্‌মেন্ট কো-অপারেশন অব জাম্বিয়ার ফিন্যান্স ডিরেক্টর ছিলেন। ব্যাংক অব জাম্বিয়ার সরকারি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২-৮৪ পর্যন্ত জাম্বিয়ান প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৮৫ থেকে ৮৭ পর্যন্ত লিবিয়ার বিখ্যাত অঙিডেন্টাল কোম্পানির সিনিয়র অডিটর ছিলেন। একই কোম্পানীর ইন্টারনাল অডিট বিভাগে পরিচালকসহ ৯০ থেকে ৯৬ পর্যন্ত অর্থ উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৯৬’র ডিসেম্বর থেকে আমৃত্যু রহমান-রহমান হক চার্টার্ড একাউন্টেন্ট্‌স এর পার্টনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে প্রচারবিমুখ, নিরহংকারী, বিনয়ী ও নম্র প্রকৃতির মানুষ তিনি। গরীব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই তাঁর স্বপ্ন, সাদাসিধে জীবনযাপনকারী এ মানুষটি ব্যক্তিগত আয়ের একটি বড় অংশ দুস্থ, আর্তপীড়িত মানুষের সেবায় ব্যয় করেন। গরীব মেধাবী ছাত্রদের জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করা এবং গরীব রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা তাঁর অন্যতম লক্ষ্য।
তিনি অনেকগুলো সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। চিরায়ত শান্তি সোসাইটির সভাপতি, সিরাজুল হক মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, তা ছাড়া ফয়েসলেক চক্ষু হাসপাতাল রোগী কল্যাণ সমিতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক, ডায়াবেটিক সমিতির সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন। তিনি আমৃত্যু তাঁর ওস্তাদ মাওলানা আমির আলী সাহেবের প্রতিষ্ঠিত রাউজান এমদাদুল ইসলাম নূরানী কেজির চেয়ারম্যান এর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সাথে আমার ছিল গভীর সম্পর্ক। উত্তর চট্টগ্রামের জনহিতকর সমাজ-সংগঠন রাউজান ক্লাবের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে তাঁকে পেয়েছি খুব কাছাকাছি। ক্লাবের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তিনি দান করেছেন বিশাল অংকের অনুদান। তিনি অনেকবার আদালত ভবনস্থ রাউজান ক্লাব কার্যালয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালায় অংশগ্রহণ করেছেন এবং ক্লাবের বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করে ভীষণ আনন্দিত হন। চট্টগ্রাম শহরস্থ আগ্রাবাদে তাঁর নিজস্ব অফিসে আমি অনেকবার গিয়েছি। তিনি কথা বলতেন অত্যন্ত নরম সুরে। কথাবার্তায় ছিল অসম্ভব গাম্ভীর্যতা। সত্য ও নিষ্ঠার একজন ধারক-বাহক মোহাম্মদ মোসলেহ্‌ উদ্দিন এফসিএ। অসহায় মানবতার আশ্রয়স্থল ছিলেন অজপাড়াগাঁয়ের এই মেধাবী মুখ। তাঁর কাছে সহযোগিতা চেয়ে কেউ কোনদিন বিমুখ হননি। বর্তমানের তথাকথিত সমাজসেবকদের কাছে তিনি ছিলেন এক অনুপম আদর্শ। পবিত্র কোরানুল করিমের পরে যে কিতাবটি সারা পৃথিবীতে একমাত্র গ্রহণযোগ্য সেই বোখারী শরীফের প্রতিটি হাদিস ছিলো তাঁর নখদর্পণে। ২০০৯ সালের ২৯ মে রাউজান ক্লাবের গুণীজন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমরা এই মহান ব্যক্তিত্বকে সম্মাননা জানানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস পেয়েছি। যদিও তিনি ছিলেন জাতীয়ভাবে স্বীকৃতিযোগ্য একজন ব্যক্তি। আমরা হয়তো তাঁকে ততটুকু সম্মান দিতে পারিনি-এটা শুধু রাউজান নয়, সারা দেশের ব্যর্থতা। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত এ মেধাবী মুখ গত ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আমেরিকার হিউস্টন হসপিটালে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে মারা যান। ওনার দাফন হয়েছে ওখানে। তাঁর তিন ছেলে: বড় ছেলে ইলেকট্রিকেল ইঞ্জিনিয়ার, তিনি হিউস্টন শেভরণ অয়েল কোম্পনিতে চাকরি করেন, মেঝ ছেলে টেঙাস ইন্সট্রুমেন্ট নামক কোম্পানিতে চাকরি করেন, থাকেন ডালাস- এ। সর্বকনিষ্ঠ ছেলে একজন ফার্মাসিস্ট, তিনি হিউস্টন এর একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিন ছেলে অবিকল তাঁর গর্বিত বাবার অসাধারণ গুণে গুণান্বিত এবং মহান রাব্বুল আ’লামিনের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে প্রবাস এবং দেশে মানবিক সেবা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর স্ত্রী মিসেস শামসুন্নাহার একজন রত্নগর্ভা মা। অধিকাংশ সময় ছেলেদের সাথে আমেরিকাতেই থাকেন। তিনি দেশে এলে নিজেকে জড়িত রাখেন সামাজিক কর্মকান্ডের ব্যস্ততায়। স্বামীর পথ ধরে মানবসেবায় তিনি ছুটেন অসম্ভব গতিতে। মরহুম মোসলেহ্‌উদ্দিন এফসিএ এর সাথে আমার শেষ কথা হয়েছে ২০১৪ সালে আমেরিকার অন্যতম প্রদেশ বাফেলো থেকে। আন্তর্জাতিক ইএনটি কংগ্রেসে যোগদানের কারণে তখন আমি আমেরিকায়। বাফেলোর শেষ সীমান্তে অবস্থিত নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে গিয়ে খবর পেলাম উনি আমেরিকাতেই আছেন। আমি সাথে সাথে তাঁর সাথে ফোনে কথা বললাম। ওপার থেকে অস্ফূট সূরে ভেসে আসে, ‘ডাক্তার সাহেব কেমন আছেন, আসুন না হিউস্টন এসে ঘুরে যান’। আর হয়নি কথা তাঁর সাথে-দেখাও হবে না আর এ জীবনে। এ ধরণের সাদা মনের মানুষেরা এ ভাবেই চলে যান অতি নীরবে, অতি নিভৃতে। কিন্তু তাঁদের ছায়া রয়ে যায় এ উর্বর জমিনে। আমরা তাঁদের ছায়া ধরে ধরে পথ চলবো, নিজের জীবনকে করে তুলবো সে সব গুণীদের সান্নিধ্য আর ছোঁয়ায়। জিন্দেগীর পুরোটা সময় কেটে দিয়েছেন আর্তমানবতার সেবায় এই মহান মানুষটি। কেমন করে ভুলব এ কীর্তিমান মানুষটিকে? দুর্নীতির শীর্ষে থাকা এ প্রান্তরে আরো জন্ম হোক অনেক মোসলেহ্‌ উদ্দিন এর। আমরা তাকিয়ে আছি সেই উচ্চ আশায়, উচ্চ আকাঙ্ক্ষায়।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি)

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘মন ছোটে রঙে বোনা উপত্যকায়’
পরবর্তী নিবন্ধনো মাস্ক- নো সার্ভিস, জনগণের দায়িত্ব ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ