নীরবে নিভৃতে পরপারে চলে গেলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার পেছনের স্বপ্নদর্শী শিব নারায়ণ দাস। ১৯৪৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর বর্তমান ঢাকা বিভাগের টঙ্গীবাড়িতে জন্মগ্রহণ করা শিব নারায়ণ দাস ছিলেন বাঙালি জাতির স্বাধীনতার অন্বেষণকারী, বাংলাদেশের পতাকার প্রথম ভেক্সিলোগ্রাফার। এটি সার্বভৌমত্বের জন্য আকাঙ্ক্ষিত জনগণের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।
১৯৭০ সালের ৬ জুন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর কক্ষে শিব নারায়ণ দাসসহ অন্যান্য ছাত্রনেতারা জড়ো হন। কিন্তু শিব নারায়ণ একজন স্বভাব আঁকিয়ে ছাত্র নেতা হিসেবে তৎকালীন ঘটঈখঊটঝ (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ) কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে শিব নারায়ণ দাস প্রস্তাবিত পতাকার লাল বৃত্তের উপর বাংলাদেশের মানচিত্র চিহ্নিত করার জন্য একটি ম্যাচস্টিক এবং হলুদ রং ব্যবহার করেন। সৃষ্টির এই কাজটি শুধু শৈল্পিকই ছিল না, ছিল পাকিস্তানি শাসকদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বক্তব্য।
সবুজ পটভূমিতে সূর্যের প্রতীক লাল বৃত্তের মধ্যে বাংলার হলুদ মানচিত্র সমন্বিত পতাকাটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর অল্প আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদে ২ মার্চ, ১৯৭১ সালে প্রথম উত্তোলন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে মুজিবনগরেও ওড়ানো হয় এই পতাকাটি। এমন কি ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে শিব নারায়ণ দাসের নকশা করা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। উইকিপিডিয়াতেও শিব নারায়ণকে উল্লেখ করা হয়েছে প্রথম জাতীয় পতাকার মূল ডিজাইনার হিসেবে। যা হয়ে উঠেছিল জাতির স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সংহতি প্রতীক। কিন্তু স্বাধীনতার পর বাস্তবিক কারণে পতাকা থেকে মানচিত্রটি সরিয়ে নেওয়া হয়। তৎকালীন শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি নকশা করা পতাকার মধ্যে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ ও তার ব্যাখ্যা সম্বলিত প্রতিবেদন দিতে বলে শিল্পী কামরুল হাসানকে এবং তাঁর পরিমার্জন করা রূপটিই বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত জাতীয় পতাকা। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে শিব নারায়ণ দাস কতটুকু স্বীকৃতি পেয়েছেন আমাদের কাছ থেকে? আমরা কয়জনেই বা জানি শিব নারায়ণের কথা। অথচ বিস্মৃত এই মানুষটি যে আমাদের প্রাণের জাতীয় পতাকার ইতিহাসে জড়িয়ে! অথচ এই কাজটি তাঁকে দিয়েই করানো যেত।
অস্ত্র হাতেও ১৯৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন শিব নারায়ণ দাস ও তার স্ত্রী গীতশ্রী চৌধুরী। অথচ দেশের ইতিহাসে তাদেরকে মনে রাখেনি। দেয়া হয়নি কোন স্বীকৃতি। ক্ষোভ ও অভিমানে শিব নারায়ণ ও স্ত্রী গীতশ্রী চৌধুরী এই দম্পতি কেউ নেয়নি রাষ্ট্র থেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। তাঁর বাবা সতীশ চন্দ্র দাস কুমিল্লায় আয়ুর্বেদ চিকিৎসা করতেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। হত্যা করেন অবর্ণনীয় নির্যাতনে। পিতা হারানোর শোক যেতে না যেতেই তার উপর যোগ হলো জাতীয় পতাকার স্বীকৃতি না পাওয়ার অভিমান। যার কারণে নিজেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখেন।
তাঁর প্রাথমিক জীবনে রাজনৈতিক সক্রিয়তার চিহ্ন ছিল। তিনি ভাষা আন্দোলনের নায়ক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, যার ফলে তাকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। ১৯৬২ সালের সেই শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসক আইয়ুব খান ‘শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি’ বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে শিক্ষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার ডিজাইনার হিসেবে শিব নারায়ণ দাসের উত্তরাধিকার তার দক্ষতা ও দেশপ্রেমের প্রমাণ। ১৯ এপ্রিল, ২০২৪–এ ৭৭ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর চলে যাওয়া, একটি যুগের সমাপ্তি চিহ্নিত করে তবে জাতির পরিচয়ে তাঁর অবদান চিরকাল স্মরণ করা হবে। স্মরণে থাকবে মৃত্যুর পূর্বে সন্ধানীতে তার চক্ষু দুটি দান করার কথা। দান করা কর্নিয়ায় চোখের আলোয় ফিরে পাবে দুইজন অন্ধ মানুষ। তাই শুধু দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নয় শিব নারায়ন দাস মননে চিন্তায় যে অবদান রেখেছেন মৃত্যুর পরেও দুইজন অন্ধ মানুষকে পৃথিবীর সুন্দর রঙ রূপ দেখার সুযোগ করে দিয়ে গেছেন।
শিব নারায়ণ দাসের জীবন ও কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রতীকের শক্তি এবং একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা। তার পতাকার নকশাটি কেবল একটি শৈল্পিক প্রচেষ্টা নয় বরং বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার অধিকারের সাহসী ঘোষণা ছিল। যার কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রথম পতাকার নকশাকার হিসেবে শিব নারায়ণ দাসের ঐতিহাসিক ভূমিকা এদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাঙালি জাতির কাছে। মহান এই শিল্পীর প্রয়াণে শোক ও বিনম্র শ্রদ্ধা দেশপ্রেমিক প্রিয় মানুষটির প্রতি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সংগঠক।