স্মরণ: ছালেহ জহুর ওয়াজেদী (রহ.)

আবু নাছের মুহাম্মদ তৈয়ব আলী | বৃহস্পতিবার , ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৯:০৪ পূর্বাহ্ণ

আল্লামা ছালেহ জহুর ওয়াজেদী (রহ.) ছিলেন একজন বরেণ্য আলেম, আলেম সমাজের আদর্শ। বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের ওয়াজেদিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে আলহাজ্ব নজু মিয়া ও মহীয়সী জরিফা খাতুনের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন। ওই অবস্থিত চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদ্রাসা। এ মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে অনেকে বিখ্যাত আলেম হয়েছেন। বর্তমান সময়ে যেমন মিশর আল আজহারে যারা শিক্ষার্জন করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে, তাঁরা নিজেদের নামের সাথে আজহারী উপাধি লিখেন। তেমনি ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা অর্জনকারী কৃতী শিক্ষার্থীগণ ওয়াজেদী হিসেবে পরিচিত হতেন। যুগবরেণ্য অনেক পীর মাশায়েখ উক্ত মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছেন। এমন একজন কীর্তিমান আলেম ছিলেন আল্লামা ছালেহ জহুর ওয়াজেদী রহমতুল্লাহি আলাইহি। একজন আশেকে রাসুল সমাজসেবী, আলেমওলামাকে মোহববতকারী, ওয়াজনসিহতের মাধ্যমে মানব সমাজকে আল্লাহ ও রাসূলের পথে আহ্বান কারী সহ বহু গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর ৮মওফাত বার্ষিকীতে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মনের তাগিদে কিছু স্মৃতি চারণের উদ্দেশ্যে এ লেখার অবতারণা।

এক বর্ণাঢ্য ও সফল জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আদর্শালোকে দ্বীনি দাওয়াত সর্বস্তরে পৌঁছাতে তিনি আজীবন নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তিনি ছোটকাল থেকে পৈতিৃকভাবে বিত্তশালী হওয়া সত্ত্বেও দ্বীনি খেদমত থেকে কখনো বিরত থাকেননি। মসজিদের ইমাম ও খতীবের গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এলাকার জনসাধারণকে দ্বীনসুন্নিয়াত তথা ইসলামি আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার মহান দায়িত্ব পালন করে তিনি একজন সত্যিকার দিশারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর জন্মস্থান পাঁচলাইশ, বায়েজিদ তথা চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতিটি ঘরে ঘরে ওয়াজ মাহফিলে তাঁর সুললিত কণ্ঠের ওয়াজ শ্রবণ করে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলিম নরনারী হিদায়ত লাভ করেছেন। আওলাদে রাসুল রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরিকত আল্লামা হাফেজ কারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহ.) এর একজন মুরিদ হিসেবে তিনি এতদঞ্চলের প্রতি ঘরে সুন্নি মতাদর্শ প্রচার প্রসারে বিশাল খিদমত আনজাম দিয়েছেন। বাতিল সম্প্রদায়ের অপতৎপরতা রোধে তিনি আজীবন সোচ্চার ছিলেন।

কর্মজীবনের প্রারম্ভে তিনি ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদ্‌রাসা ও কুলগাঁওস্থ আহসানুল উলুম জামেয়া গাউসিয়া মাদ্‌রাসায় শিক্ষকতা করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৮০ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৭ বছর বায়েজিদ থানাধীন অক্সিজেনস্থ হাসনি বনস্পতি অয়েল মিল জামে মসজিদে ইমাম ও খতীবের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৫ সাল হতে তিনি নিয়মিত সরকারিভাবে হজ্জ আদায় করেছেন। ১৯৭৮ এবং ১৯৭৯ সনে শহীদ সালাহউদ্দীন নামক পানির জাহাজে করে পরপর দুই বার আমিরুল হুজ্জাজ ( হাজীদের গ্রুপ লিডার) এর দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহর মেহমান হাজী সাহেবদের খেদমতকে তিনি তার জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। এদেশে সরকারিভাবে হজ্জ আদায়ে হজ্জযাত্রী ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজ যখন বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন তখন বেসরকারিভাবে গড়ে উঠে বিভিন্ন হজ্জ কাফেলা। বেসরকারিভাবে গড়ে উঠা হজ্জ কাফেলার অন্যতম একজন পথিকৃৎ ছিলেন আমিরুল হুজ্জাজ আল্লামা ছালেহ জহুর ওয়াজেদী রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি অলিপ্রেমিক ছিলেন। তাই তিনি চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ অলি হযরত শাহছুফি শাহ আমানত (রহ.)এর নামে প্রতিষ্ঠা করেন শাহ আমানত হজ্জ কাফেলা। এ কাফেলার মাধ্যমে তিনি আজীবন হাজীদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। অনেক আলেমওলামাকে তিনি এ কাফেলার মাধ্যমে হজ্জে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।

আমার দেখা তিনি একজন সুন্নতে নববীর অনুসারী প্রকৃত আশেকে রাসুল, আলেমদ্বীন, সফল ও জনপ্রিয় মানুষ। অত্যন্ত সুশোভিত মার্জিত পোশাকে পরিপাটি সৌম্য দীপ্ত সুন্দর চেহারার অধিকারী। সকলের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। একজন সদালাপী বহুগুণে গুণান্বিত বিশাল মনের অধিকারী হিসেবে তিনি তাঁর প্রতিবেশী সকলের অতি প্রিয়ভাজন ছিলেন। গরীব দুঃখী অসহায়দের উদার হস্তে সাহায্য করতেন। আলেমওলামা, মাদ্‌রাসা ছাত্রদের তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন। তিনি বড় দানবীরও ছিলেন। গোপনে সাহায্য করতে বেশি পছন্দ করতেন। তাঁর অনুদানে বহু মসজিদমাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তাঁর জীবদ্দশায় একটি মসজিদ ও কবরস্থান প্রতিষ্ঠা করেছেন। অত্যন্ত সুন্দর এ মসজিদের পাশে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কবরস্থানে তিনি সমাহিত আছেন। তাঁর মাজার শরীফের পাশে একটি হেফজখানা ও এতিমখানা চালু করেছেন তাঁর সন্তানগণ। হিফজরত শিক্ষার্থীরা পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত ও নিয়মিত জিয়ারতের মাধ্যমে সদা আমলে সালেহ জারি রাখেন। এ ছাড়াও প্রতি মাসে মিলাদকিয়াম জিকির আজকার ওয়াজ নসিহত তাবারুক ইত্যাদি নেক আমল চলমান রয়েছে মাজার প্রাঙ্গণে।

তাঁর সন্তানগণও পিতার উত্তরাধিকারী হিসেবে তার সকল সদগুণে গুণান্বিত হয়েছেন। সমাজের গরীব দুঃখী পাড়া প্রতিবেশি নয় শুধু, দেশের যেকোনো স্থান থেকে কেউ কোন অভাবেঅনটনে তাঁদের সাহায্য প্রত্যাশী হলে কাউকে বিমুখ করেন না। সহাস্যে প্রয়োজনীয় সাহায্য করেন। অনেক মাদ্‌রাসা এতিমখানায় নিয়মিত সাহায্য করে আসছেন। তাঁর নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন আল্লামা ছালেহ জহুর ওয়াজেদী (রহ🙂 ফাউন্ডেশন। এ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে হযরত শাহ আমানত (রহ: ) জামে মসজিদ। মসজিদ সংলগ্ন মাজার শরীফ কমপ্লেক্স ঘিরে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী কমপ্লেক্স গড়ার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। বর্তমান এ কমপ্লেক্সে ৫০ জন শিক্ষার্থী হিফজুল কুরআন ও এতিমখানায় ফ্রি অধ্যয়ন করছে। প্রতিবছর রমজান মাসে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ রোজাদারের জন্য ইফতারির আয়োজন করে আসছে। এছাড়াও শীতবস্ত্র বিতরণ, ফ্রি খতনা ব্যবস্থা, ফ্রি স্বাস্থ্য সেবা দান সহ বহু সেবামূলক কর্মসূচি চলমান রয়েছে।

তাঁর সুযোগ্য সন্তানদের প্রতি একটি আবদার রাখা যায়, তা হলো হুজুরের স্মৃতি চির অম্লান ও জাগ্রত রাখার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশন ও কমপ্লেক্সে একটি গরীব অসহায়দের জন্য স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা সেবা ও একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা। আমার জানা মতে তাঁর বাড়ির সামনে আল্লামা ছালেহ জহুর (রহ🙂 ফাউন্ডেশন কর্তৃক একটি স্কুল ’চট্টগ্রাম আদর্শ স্কুল’ পরিচালিত হয়ে আসছে। সম্প্রতি উক্ত স্কুলের বার্ষিক ফলাফল প্রকাশ ও কৃতি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে দেখেছি, শিক্ষার্থী ছাত্রছাত্রী অত্যন্ত সুন্দরভাবে লেখাপড়া করছে। শিক্ষার পরিবেশও খুবই মানসম্পন্ন। উক্ত স্কুল ভবনকে বহুমুখী কমপ্লেক্সে রূপান্তরের মাধ্যমে আল্লামা ছালেহ জহুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে নামকরণ করে চিকিৎসা কেন্দ্র, কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ শিক্ষা ও সেবামূলক বহুমুখী কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে এ আশা করছি।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, মাসিক তরজুমান

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅদম্য প্রণয়গুলো অনাদরে কাঁদে ইচ্ছের উঠোনে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রকৃতি ও রাজনীতিতে আমেরিকার আগুন