গীতিকার জি কে দা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। গোপাল কৃষ্ণ দত্ত (১৯৫২-২০২০) যিনি জি কে দত্ত নামেই ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন দুই বাংলার সঙ্গীত জগতে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি পৌরসভার ধুরুং(বাঁশঘাটা গ্রাম) এর এই কৃতীপুরুষ ছিলেন বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের শীর্ষস্থানীয় গীতিকবিদের কাতারের একজন। অর্থ-বিত্ত দারুণ ফাঁকি দিয়েছে এই গুণীজনকে। তবে চিত্তের বৃত্তে তিনি অসাধারণ এক আলোকিত মানুষ। দত্ত দা’র একান্ত সান্নিধ্য লাভে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বেশ কিছু গীতিকার উঠে এসেছেন আমাদের জাতীয় প্রচার মাধ্যমে। আমিও তাদেরই একজন।
খুবই খেয়ালি, অগোছালো, অন্তর্মুখী অথচ সৃষ্টির নেশায় বুদ হয়ে থাকা একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন জি কে দত্ত। সবার কাছে উন্মুক্ত হতে পারেননি তিনি- যার কাছে হয়েছিলেন, তাঁর সামনে খুলে দিয়েছিলেন হৃদয়ের সকল দুয়ার। একহারা ছোটখাট গড়নের মানুষটিকে দেখলে মনে হতো, এই বুঝি ভেঙে পড়বেন- অথচ যখন কথা বলা শুরু করতেন এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যেতেন শ্রোতা।
কিসের জানি এক দুঃখবোধ তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল সারাক্ষণ। তিনি তাঁর গানের বই “শতাব্দীকে বলে দিও” তে লিখেছিলেন,” আমার আর্থিক দৈন্যতা ও উদারতার সুযোগ নিয়ে আমাকে যারা কিনতে পারেনি, বিরাগভাজন হয়েছি আমি তাদেরই কাছে। নিন্দুকদের পাত্তা না দিয়ে আমাকে যারা কুড়িয়ে নিয়েছেন- তাদের ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে গেছে আমার যন্ত্রণাগুলো”। কী ছিলো তাঁর সেই অব্যক্ত যন্ত্রণা? তিনি আরো লিখলেন,” আমার বাবা মোটেও চাননি আমি সঙ্গীত জগতে আসি। কারণ শিল্পীরা নাকি উদাসীনতার জন্য বউ বাচ্চাদের সঠিকভাবে চালাতে পারে না। দেশ ও দশের মন যোগানোর জন্য কাজ করতে গিয়ে, বউ বাচ্চাদের উপর নজর দিতে পেরেছি খুব-ই কম”। পারিবারিক ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের কাছ-থেকে অবজ্ঞা-অবহেলা অনেক পেয়েছি। আমার সৌভাগ্য যে, ঐ দুঃসময়ে নীলিমা আমাকে বুঝতেও দেয়নি আমি ওর কতোটা অযোগ্য স্বামী ছিলাম। ওর কারণে আমার আজকে এতোটা পথ মাড়ানো”।
জি কে দত্তের সৃষ্টি তথা গান নিয়ে মন্তব্য করার দুঃসাহস বা বিদ্যাবুদ্ধি কোনটাই আমার নেই। মগজে, মননে সৃজনশীল উম্মাদনায় উদগ্রীব ছিলেন সর্বক্ষণিক ব্যক্তিক, পারিবারিক এবং আর্থিক সব সুবিধাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনকারী এই নিভৃতচারী মানুষটি। জাগতিক লোভ-লালসার প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ তাঁর ছিল না কখনো। তিনি জীবনকে খুব কাছে থেকে দেখেছিলেন, সুখবোধের চেয়ে দুঃখবোধই তাঁকে তাড়িয়েছে বেশি। সেকারণেই তাঁর গানে শরৎচন্দ্রের পার্বতী- দেবদাস থেকে শুরু করে চীনের দুঃখ হোয়াং হোও পর্যন্ত এসেছে বারবার। সর্বগ্রাসী, গভীর দুঃখবোধ বুকে চেপে, মনের আগুনে পোড়া শব্দমালায় তাঁর মনের মধুচাকটাকে সমৃদ্ধশালী করে তিনি হাজার- হাজার অনবদ্য গান রচনা করেছেন। দেশের প্রথিতযশা খ্যাতিমান প্রায় সব সুরকার আর শিল্পীগণই জি কে দত্তের গান গেয়েছেন। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ওপার বাংলায়ও তাঁর রচিত গানের খ্যাতি ছড়িয়ে সর্বমহলে সমাদৃত হয়েছে। ওপার বাংলার প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পী ও সুরকার সমরজিত রায় ও বাসুদেবের সুরে বিশ্বনন্দিত শিল্পী ভজন-সম্রাট অনুপ জলোটা, হৈমন্তী শুকলা ও রূপরেখা ব্যানার্জি ও জি কে দত্তের গান গেয়েছেন বলে শ্রুতি আছে। তিনি রোমান্টিক, স্যাড রোমান্টিক গানসহ দেশাত্মবোধক, ধর্মীয় গান ও ভক্তিগীতি এবং বেতার টিভিতে অনেক গীতিনক্সাও রচনা করেছেন। তাঁর রচিত কয়েকটি গানের কলি পড়লেই বুঝা যাবে তিনি কতোটা জীবনদর্শী ও অভিমানী গীতিকবি ছিলেন।
১. তুমিতো পেয়েছো মিলনের সুখ/বিরহে ভেঙেছে আমারই বুক/
২. এ জীবনে কেউ কি বলো/কখনো দু’বার মরে/সেদিন মরেছি আমি/ তোমাকে পাবার পরে/
৩. শিল্পী জীবন কেন সুখের হয় না/এ কথার উত্তর পাইনি তো হায়/
৪. আমি গান লিখি কবিতা লিখি/ এ দেশ মাটি ও মানুষের জন্য/
৫. আমি সবুজের আলপনা আঁকবো আবার/ যদি ফাগুন এনে দাও/
৬. শতাব্দীকে বলে দিও/ যেনো সে আমায় ক্ষমা করে/ অঘটন ঘটে গেছে/ নিয়তির ঝড়ে/
৭. কোন এক পথিকের ডায়েরিতে দেখলাম/বহু দেশ ঘুরে ঘুরে এসে/…
এমন অসংখ্য অসংখ্য হৃদয়স্পর্শী, মনকাড়া গানের স্রষ্টা ছিলেন জি কে দত্ত।
স্বভাবসুলভ প্রচারবিমুখ ও অন্তর্মুখীতার কারণে তিনি নিজে থেকে আবির্ভূত না হলে কোন সভা-সমিতি কিংবা সাহিত্য-গানের আড্ডায় উনাকে উপস্থিত পাওয়া যেতো না। বিশেষ করে ২০০৭ সালে তাঁর স্ত্রী নীলিমা’র মৃত্যুর পর বলতে গেলে জীবিত থাকতেই জি কে দত্ত দেশে একেবারে নিরুদ্দেশের মতো ছিলেন। এবার উনি সত্যি সত্যি না ফেরার দেশে চলে গেলেন (১লা ডিসেম্বর, ২০২০)। পেছনে রেখে গেলেন হাজার হাজার অনবদ্য প্রচারিত ও অপ্রচারিত গানের পান্ডুলিপি যা সময়ের পরিক্রমায় গানের সমঝদার শিল্পী- শ্রোতার হৃদয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে আগামী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ভালো থাকুন জি কে দা ওপারে।
লেখক : গীতিকার ও কবি।