স্মরণ : আমার বাবা প্রিন্সিপ্যাল তোফায়েল আহমেদ

ডেইজী মউদুদ | বৃহস্পতিবার , ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

আজ ৪ ফেব্রুয়ারি আমার বাবা প্রিন্সিপ্যাল তোফায়েল আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকী। বীর প্রসবিনী এই চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনপদে কালে কালে যুগে যুগে কতো মনিষীর ই না জন্ম হয়েছে। কবি নবীন চন্দ্র সেন, বিপ্লবী সূর্যসেন আর বীরকন্যা প্রীতিলতার কারণে চট্টগ্রাম এই উপমহাদেশের মানুষের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। আমার বাবা প্রিন্সিপ্যাল তোফায়েল আহমেদও এই চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণকারী ক্ষণজন্মা এক ব্যক্তিত্ব। ১৯২৫ সালে রাউজানের এয়াছিন নগর গ্রামের সর্তারকূলে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম আমজাদ আলী। আর মাতার নাম খায়েরুন্নেছা। তাদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি কাজ।নিজেদের জমিজমা তারা নিজেরা চাষ করতেন। আবার কামলা ও খাটাতেন। গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর গোয়াল ভরা গরুই ছিল তাদের সম্পদ। সর্তার খালের তীরে তাদের বসত ছিল বিধায় জমিজমা ছিল ভীষণ উর্বর। বর্ষার বন্যায় সর্তার জল তার দুকূল ভাসিয়ে দিয়ে জমিকে পলি দিয়ে উর্বর করে দিত। ফলে প্রতি সিজনে তাদের জমিতে নানান ফসল ফলতো। সবজি আনাজ ছাড়াও ধান, কলাই , ফেলন, আলু, মরিচ ফলতো প্রতি বছর। তবে বাড়ির কর্তা আমজাদ আলী এলাকায় সৌখিন ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন সুপরিচিত। তিনি সফেদ লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী পরিধান করতেন , চুলে সুগন্ধি তেল মাখতেন আর ষাঁড়ের লড়াই, গরুর লড়াই আর মোড়গের লড়াই দিয়ে এলাকাবাসীকে আনন্দ দিতেন ,নিজেও উপভোগ করতেন। আমজাদ আলী আর খায়েরুন্নেছার তিন পুত্র আর এক কন্যা সন্তান ছিলেন। কন্যার অকাল মৃত্যু হলে তিন পুত্রই ছিলেন তাদের সংসারে। তিন পুত্রের মাঝে আমার বাবা তোফায়েল আহমেদ ছিলেন মেজো। কিশোর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। এরপর তাঁর একমাত্র চাচা সংসারের হাল ধরেন। কৃষি পরিবারে জন্মে ও ছোটকাল থেকে আমার বাবার লেখাপড়ার প্রতি ছিল অদম্য এক আগ্রহ। তিনি এলাকার প্রাইমারি স্কুলে প্রতি বছরই কৃতিত্বের সাথে পাস করতেন। একারণে শিক্ষকেরা তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। শিক্ষকদের সহযোগিতায় তিনি প্রাথমিক স্কুলের পাট চুকিয়ে রাউজান আর আর এসি মডেল হাইস্কুলে ভর্তি হন। রাউজান স্কুল থেকে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাঁকে। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ডিগ্রি পাস করেন। তিনি বুঝেছিলেন, সমকালীন সমাজে তাকে টিকে থাকতে হলে আইন সম্পর্কে তার সম্যক জ্ঞান থাকা চাই। তাই তিনি এল এল বি ডিগ্রি ও নিয়ে নেন। পরবর্তীতে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এসময় দাঙ্গা চলছিল। শুনেছি তিনি এবং সাবেক আজাদী সম্পাদক আমার খালু অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ অনেক কষ্টে লুকিয়ে লুকিয়ে, কখনো হেঁটে , কখনো গাড়ি চেপে দেশে এসে পৌঁছেন। চট্টগ্রামে এসে বাবা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। তিনি রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর, লালা নগর, ফটিকছড়ি করোনেশান হাই স্কুল, জাহানপুর এ আলী এ হাদী আবদুল বারী চৌধুরী স্কুল, নানুপুর হাইস্কুল, রাউজান আর আর এসি মডেল হাইস্কুলে হেডমাস্টারের দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি গহিরা মালটিরেটারেল হাই স্কুলে হেডমাস্টার ছিলেন।সে সময় রাউজান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি রাউজান কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হলেন। রাউজান কলেজে থাকা অবস্থায় গহিরা স্কুল কলেজে উন্নীত হলে তিনি প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপ্যাল হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।গহিরা কলেজে প্রিন্সিপ্যাল থাকাকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় তিনি পুনরায় চবিতে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে একাডেমিক জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে। চবি ইংরেজি বিভাগে প্রথম ক্লাস করতে গিয়ে তিনি এক মজার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সাবেক চবি ভিসি মো. আলী স্যারকে আমার বাবা নানুপুর স্কুলে পড়িয়েছিলেন। আর চবিতে প্রথম দিনের ক্লাস করতে গেলে ক্লাস নিতে আসেন মো.আলী স্যার। স্কুল শিক্ষককে ক্লাসরুমে ছাত্রের আসনে দেখে স্যার কিছুটা বিব্রত হন, আমার বাবা তখন দাঁড়িয়ে বলেন, শ্রেণিকক্ষে আমি ছাত্র, আপনি আমার শিক্ষক, আর কক্ষের বাইরে আপনি ছাত্র আমি শিক্ষক। কথাগুলো আমাকে মো. আলী স্যার বলেছিলেন।আমি আবার আমার মায়ের কাছেও এই গল্প শুনেছি। এই সময় গহিরা স্কুলের যথেষ্ট সুনাম ছিল। কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে স্কুলের ছাত্ররা খুব ভালো রেজাল্ট করতেন। আমার বাবার ছাত্র প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব আবদুল করিম গহিরা স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তিনি ক্লাস নাইনে উঠে কমার্স পড়তে চেয়েছিলেন।কিন্তু আমার বাবার কড়া নির্দেশে তিনি বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে বাধ্য হলেন। তাঁর অনেক ছাত্র আজ দেশের বিভিন্ন স্থানে পদস্থ পদে প্রতিষ্ঠিত।গহিরা স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে প্রায় সব বক্তাই আমার বাবার কথা বারবার বলেছিলেন। তখন কি পরিমাণ ভালো লাগছিল তা বোঝাতে পারবো না। আমার বাবা অত্যন্ত কড়া মেজাজের মানুষ ছিলেন।নীতি আর আদর্শের প্রশ্নে বরাবরই ছিলেন অটল। ছিলেন দক্ষ প্রশাসক আর অভিজ্ঞ শিক্ষক। গহিরা স্কুল ছিল মালটিলেটারেল অর্থাৎ বহুমুখী স্কুল। এখানে মানবিক, বিজ্ঞান আর বাণিজ্য বিভাগ ছাড়াও কৃষি, গার্হস্থ্য অর্থনীতি এবং আর্টস এন্ড ক্র্যফট বিভাগ অন্তর্ভুক্ত ছিল। স্কুলে তিনি শিক্ষার্থীদের কেবল পুঁথিগত বিদ্যায় শিক্ষিত করেননি। তিনি প্র্যাকটিক্যালি মাঠে ছাত্রদের দিয়ে সবজি বাগান করিয়েছিলেন, আর্টস এন্ড ক্র্যাফটের জন্য ল্যাব প্রতিষ্ঠা করে সেখানে বিভিন্ন হস্ত ও কুটির শিল্প তৈরির কাজ শেখাতেন। আবার বিনোদনের জন্য খেলাধূলা, যাত্রা, টকি সিনেমা, মঞ্চ নাটক, মেলা, সার্কাস এসবের ব্যবস্থা রেখেছিলেন।
অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানসিকতার এক প্রাণপুরুষ ছিলেন আমার বাবা। তিনি গহিরা স্কুলে হেডমাস্টার থাকা অবস্থায় শহীদ নূতনচন্দ্র সিংহ প্রতিষ্ঠিত কুন্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দিরে বিনা পারিশ্রমিকে পাঠদান করতেন। স্কুলের বেশিরভাগ হিন্দু শিক্ষকের সাথে তাঁর ছিল অন্যরকম এক সম্পর্ক। মনোরঞ্জন বাবু, রাজকমলবাবু, অনিলবাবুর কথা আমার মনে আছে। মনোরঞ্জন বাবুকে আমরা কাকা ডাকতাম। বাবা তাকে নিজের ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। তিনি আমাদের কোলে পিঠে নিয়ে বড় করেছিলেন।তিনি আমাদের শিখিয়েছেন খালাকে মাসী, খালুকে মেসো ডাকতে, আমরা এখনো সে ভাবে সম্বোধন করি। গহিরার বীরেন্দ্র বিশ্বাস বাড়ি, চৌধুরী বাড়ি, আবদুল্লাহ আল হারুন মামাদের পরিবার, একুশের প্রথম কবিতার লেখক মাহবুবুল আলম চৌধুরী, দিদার মার্কেটের দিদার মিয়া, কাঞ্চন মিয়া,রাউজানের পালিত পাড়া, ধর বাড়ি, অধ্যাপক মো. খালেদ, জালাল উকিল, নুরু মাস্টার, শিক্ষাগুরু হাফিজ মিয়া এবং জলিল নগরখ্যাত পীর জলিল মিয়ার সাথে আমার বাবার ছিল আত্মিক এক সম্পর্ক। তিনি চবির ইংরেজি বিভাগে প্রথম পর্ব শেষ করে ফাইনাল ইয়ারে উঠেন। লেখাপড়ার চাপ, স্কুল ও কলেজের চাপ সব মিলিয়ে বোধ হয় তার শরীর আর লোড নিতে পাচ্ছিলেন না! একদিন ভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, হঠাৎ মাথা চক্কর দিলে বাসায় শুয়ে পড়েন , আক্রান্ত হলেন ব্রেন হেমারেজে। টানা ১৮ দিন মুত্যুর সাথে যুদ্ধ করে তিনি ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । ওই সময় টানা ১৮ দিন আমরা আজাদী সম্পাদক আমার মালেক মামার আন্দরকিল্লাস্থ বাসায় থেকেছিলাম। মৃত্যুর পরে তাঁর মরদেহ গহিরা কলেজ মাঠে নেয়া হয়। গহিরাবাসী চেয়েছিল কলেজ মাঠের একপাশে তাঁকে সমাহিত করবেন। কিন্ত পুত্রশোকে কাতর আমার দাদী তাঁকে নিতে চান তাঁর কাছে। অগত্যা কি আর করা, আমার দাদীর মতকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হলো । আমার বাবার মৃত্যুর দিনে ফটোগ্রাফি করেছেন লায়ন পি আর সিনহা (সদ্য প্রয়াত মন্টু মামা)। ছবিতে দেখি তাঁর মরদেহ কাঁধে নিয়েছেন ভাষা সৈনিক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী, একুশের প্রথম কবিতার লেখক মাহবুবুল আলম চৌধুরী, কাঞ্চন মিয়া প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা। চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকায় মৃত্যু সংবাদ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ছাপানো হয়। পরের দিন গহিরা স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে এক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামের তখনকার ডিসি সালাউদ্দিন সাহেবসহ বিশিষ্টজনেরা সভায় শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। আজ কত যুগ হলো, তিনি নেই আমাদের মাঝে। কিন্তু যখনি আমি বাড়ি যাই, আমার প্রাথমিক শিক্ষার সূতিকাগার, গহিরা অঞ্চলের শিক্ষার বাতিঘর এই স্কুলের সামনে একটু দাঁড়াই! দেখি, আমাদের সেই বাসা (কোয়ার্টার), সেই পুকুর, সেই শান বাঁধানো ঘাট,বিশাল তোড়ণ, বিরাট মাঠ এখনো রয়েছে কালের সাক্ষী হয়ে। এখনো যেন শিক্ষা আর জ্ঞানের দ্যুতির বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছে, কি সুনশান পরিবেশ, যেন হাসছে, আর জ্বলজ্বল করছে। বাবা যেন পরপার থেকে দেখছেন তাঁর প্রাণপ্রিয় এ বিদ্যাপীঠকে। আর আমার চোখে ভাসে মধু কবির সেই বিখ্যাত উক্তি : ‘দাঁড়াও , পথিকবর ! জন্ম যদি তব বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল ..” বাবা আপনি যেখানে থাকুন, শান্তিতে থাকুন এই কামনা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানসিকতা পরিবর্তন দরকার
পরবর্তী নিবন্ধকরোনা প্রতিষেধক টিকা গ্রহণে মানুষের আগ্রহ-অনাগ্রহ