পূর্বে লটমনি পাহাড়, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে শঙ্খ নদী–প্রকৃতির এই তিন অনুপম সৃষ্টি বাঁশখালী উপজেলার বাণীগ্রাম–সাধনপুরকে করেছে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বহু শিক্ষাবিদ, শিক্ষানুরাগী আর মহৎপ্রাণ মানুষদের পুণ্য স্মৃতি ধন্য এই সাধনপুর। বৃটিশ আমলের পরাধীনতার সময়কাল থেকে বহু শিক্ষাবিদ, আর শিক্ষানুরাগীদের শিক্ষা বিস্তারের জন্য অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে সাধনপুর এবং সংলগ্ন বাণীগ্রাম সমগ্র বাঁশখালীতে শিক্ষার মান এবং শিক্ষিতের হারের দিক দিয়ে সবচেয়ে উচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত। শিক্ষা বিস্তারের জন্য সেদিনের মহৎপ্রাণ মানুষদের প্রচেষ্টার ফল ভোগ করছেন আজকের মানুষ। অতীতের সে সব দিনে শিক্ষা লাভের জন্য তেমন কোনও প্রতিষ্ঠান ছিল না। টোল, মক্তব–মাদ্রাসাই ছিল হিন্দু–মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের শিক্ষা লাভের প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে মূলতঃ ধর্মীয় শিক্ষাই দেওয়া হত। তৎকালে বাণীগ্রাম ও সাধনপুরের ধনাঢ্য হিন্দু ব্যক্তিবর্গ আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে যথেষ্ট অবদান রাখেন। এই সম্প্রদায়েরই কতিপয় শিক্ষানুরাগীর প্রচেষ্টায় ১৯১৭ সালে বাণীগ্রাম–সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সে যুগে মুসলিম ছাত্ররা মাদ্রাসা–মক্তবে এবং মুসলিম মেয়েরা বাড়িতেই ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করত। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য সেসময় কতিপয় অবস্থাপন্ন ও প্রগতিশীল মুসলিম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মুসলিম সম্প্রদায়কে তাদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করাতে উদ্বুদ্ধ করেন। ধীরে ধীরে মুসলিম ছাত্ররা বাণীগ্রাম–সাধনপুর স্কুলে ভর্তি হতে শুরু করেন।
অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ ১৯৩২ সালে এই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর জন্ম ১৯১৪ সালে এই সাধনপুরেই। অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক ও নন্দিত সমাজ হিতৈষী। ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় ছিল তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মানের কথা সাহিত্যিক। তাঁকে কথার যাদুকর বলা যায়। তিনি তাঁর লেখনীতে রসিকতার মাধ্যমে সমাজের ভুল–ভ্রান্তি, সমাজের বৈষম্য আর অসংগতি তুলে ধরেছেন। তাঁর কথা আর লেখনি ছিল যেমন রসাত্মক, ঠিক তেমনি অখণ্ডনীয় যুক্তিসম্পন্ন, তীক্ষ্ম এবং ক্ষুরধার। তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংসদ বাংলা ডিকশনারী ব্যবহার করতেন। এই ডিকশনারীতে ‘বাহাত্তুরে’ শব্দের বর্ণিত অর্থানুযায়ী তিনি ‘বাহাত্তুরের অকর্মন্য ভীমরতি গ্রস্থ’ বুড়ো ছিলেন না। তিনি ‘বোকা মিয়াও’ ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাহাত্তুর বছর বয়সের প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা চৌকষ এক তরুণ। গত দুই প্রজন্ম বাঁশখালীর এই স্বনামধন্য কৃতি পুরুষ, সাধনপুরের রত্ন অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ সম্পর্কে খুব বেশি জানেন না। এদেরকে এবং আগামী প্রজন্মকে এই মহান পুরুষ সম্পর্কে জানানোর দায়িত্ব তাঁর উত্তরসূরীদের, যাদের হাতে তিনি তাঁর অসমাপ্ত কর্ম সম্পাদনের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন তাঁর শেষ ইচ্ছা পত্রে। সত্য প্রকাশে অকপট আর নির্ভীক এই মানুষটি যদি তাঁর জন্মভূমি বাঁশখালীবাসীর বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যান তবে তা হবে চরম লজ্জাজনক ব্যর্থতা। বাঁশখালীর আকাশ–বাতাস, তরুলতা, অজপাড়া গাঁয়ের ধূলিকণায় মিশে আছে অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদের স্মৃতি। তাঁর কর্মের কথা, তাঁর মেধা–মননের কথা, শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবদানের কথা, দুঃখী মেহেনতী মানুষের প্রতি তাঁর মমত্ববোধের কথা, ‘সমস্ত তনু–মন–প্রাণ, সমস্ত জীবন দিয়ে’ জন্মভূমিকে ভালোবাসার কথা এ প্রজন্ম এবং আগামী দিনের সকল প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাঁর অর্থ–বিত্তের প্রাচুর্য ছিল না। কিন্তু তাঁর হৃদয়ে ছিল জনগণের কল্যাণ সাধনে ইচ্ছার প্রাচুর্য। সীমাবদ্ধ সাধ্যের মধ্যে থেকেও তাঁর হাতেই ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন হাই স্কুল, সাধনপুর পল্লী মঙ্গল সমিতি, বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ এবং পশ্চিম সাধনপুর হাই স্কুল। চট্টগ্রাম সিটি কলেজের প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন প্রধান অগ্রণী। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে বাঁশখালী থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
এখানে সাধনপুরের আর একজন সমাজহিতৈষীর কথা উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হবে। এই বিশিষ্ট ব্যক্তি হচ্ছেন মরহুম মালেকুজ্জামান চৌধুরী। বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ ও সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে তিনি ছিলেন অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদের সার্বক্ষণিক সহযোদ্ধা। মালেকুজ্জামান চৌধুরীর শ্রম ও ঘাম মিশে আছে বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ এবং বাঁশখালী পল্লী উন্নয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের ইট পাথরে। মালেকুজ্জামান চৌধুরী শিশুদের শিক্ষাজীবন শুরুর প্রারম্ভে শিশুদেরই উপযোগী শিক্ষাদানের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। শিশুদের গৎবাঁধা শিক্ষা দেওয়ার বিষয়ে তিনি ভিন্নমত পোষণ করতেন। অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদের মতই তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিশুরা তোতা পাখী নয়। তাদেরও আলাদা চিন্তা–চেতনা রয়েছে। মালেকুজ্জামান চৌধুরী তাঁর জীবদ্দশায় শিশুদের জন্য একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন স্কুল করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। বিদ্রোহী কবির গানের বুলবুল ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে’। কিন্তু মালেকুজ্জামান চৌধুরীর বুলবুল এখনো জেগে আছেন। পরম ধৈর্য্য, দক্ষতা আর অধ্যাবসায়ের সাথে তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন এই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ শিশু বিদ্যাপীঠ মালেকুজ্জামান কিন্ডার গার্টেন।
সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের নিষ্ঠুরতা, অমানুসিকতা, বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা–এসব বিষয় অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদকে খুবই ভাবাত। তাঁর লেখা পড়ে এটা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, তাঁর সমস্ত লেখালেখি একান্তই অন্তরের তাগিদে এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই। তাঁর সমাধির গায়ে লিপিবদ্ধ তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রের প্রতিটি অক্ষরে, প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি বাক্যে ‘এই সুন্দর প্রকৃতির লীলা নিকেতনে বসবাসকারী দারিদ্র মলিন অসুন্দর জীবনযাপনকারী শোষিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, ভাগ্যহত মানুষদের’ জন্য তাঁর অপরিসীম মমত্ববোধ ও বেদনার যে প্রকাশ ঘটেছে, তা’ তাঁর অন্তরের গভীর থেকে উৎসারিত। তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রে তিনি এ সকল শোষিত বঞ্চিত মানুষদের ‘সর্বাঙ্গ সুন্দর উন্নত মানুষের স্তরে টেনে তুলতে’ চেয়েছিলেন। কিন্তু তা করতে না পারায় তিনি জীবনের পড়ন্ত বেলায় সর্বক্ষণ বেদনায় ভারাক্রান্ত থাকতেন। সমাজের ভাগ্যাহত মানুষদের জীবনমানের উন্নয়নে তাঁর সকল প্রচেষ্টা নিবেদিত ছিল। কিন্তু এ কাজে ‘সাফল্যের তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত’ থাকার আক্ষেপ তাঁর দরদী হৃদয়ে সারাক্ষণ রক্ত ঝরাতো। তাঁর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য তিনি তাঁর পরবর্তী ‘যোগ্যদের’ কাছে যে আশাবাদ ব্যক্ত করে গেছেন, তাঁর সেই অন্তিম আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের কাজে আজ তাঁর অনেক অনুরাগী আর প্রিয়জন নিজেদের ব্যাপৃত রেখেছেন। তিনি আজ অনেক দূরে। কিন্তু তাঁর নিজ হাতে গড়া সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন উচ্চ বিদ্যালয় এবং বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ সমগ্র উত্তর বাঁশখালীতে দীর্ঘদিন যাবত জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান আজ তাদের প্রাচীনত্ব এবং এ অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে তাদের বিশাল সাফল্য আর গৌরবের পতাকা উড্ডীন করে চলেছে। জীবনের পরপারে যেখানেই থাকুন না কেন, অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ তাঁর হাতে গড়া সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন হাই স্কুল এবং বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজের সাফল্য, সমৃদ্ধি আর খ্যাতির কথা জেনে নিশ্চয় আনন্দিত হচ্ছেন।
১৯৯৪ সালের ২৮ মে এই নির্লোভ ও খাঁটি দেশপ্রেমিক, বাঁশখালীর অহংকার প্রফেসর আসহাব উদ্দিন আহমদের জীবনাবসান ঘটে। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর প্রিয় কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়াতলে তাঁকে সমাহিত করা হয়। অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদের স্মৃতির প্রতি জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা। সবশেষে বলি: ‘হে মহান, তুমি রয়েছ হৃদয়ে মম – হয়ে এক বিশাল বটবৃক্ষ সম’।
লেখক : সমাজকর্মী