স্মরণে শ্রদ্ধায় ফয়েজ আহমদ চৌধুরী

মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান | বৃহস্পতিবার , ৩ মার্চ, ২০২২ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

ফয়েজ আহমদ চৌধুরী। জন্ম আনুমানিক ১৯০৫ খ্রি., মৃত্যু ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০০। পিতা বাঁচা মিয়া চৌধুরী এবং মায়ের নাম মায়মুনা খাতুন। গ্রামের বাড়ি বাঁশখালীর বৈলছড়ী গ্রামের উকিল বাড়িতে। তিনি ঐতিহ্যবাহী জমিদার পরিবারের সন্তান। বৈলছড়ী গ্রামে তাঁর বংশের প্রথম পুরুষ উকিল কামন্দর আলম। জন্ম ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে। উকিল কামন্দর আলম কলিকাতা কোর্টে ওকালতি করতেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি হাটহাজারীর ছিপাতলি গ্রামে বলে জানা যায়। তৎকালে বাঁশখালী এলাকায় নয়াবাদ জমিদারী প্রসারিত হওয়ার সময় তিনি বাঁশখালীর সদর রাস্তার পাশে বড় একটি বাড়ি নির্মাণ করে বসতি স্থাপন করেন এবং জমিদারী স্বত্বাধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। সমসাময়িক দালিলিক খতিয়ান এখনো পরিবারে সংরক্ষিত আছে। ফয়েজ আহমদ চৌধুরী আট ছেলে মেয়ে রেখে ২০০০ সালে ইন্তেকাল করেন।
ফয়েজ আহমদ চৌধুরী একজন স্বশিক্ষিত, অত্যন্ত বিচক্ষণ, দক্ষ, দূরদর্শী ও ধৈর্যশীল লোক ছিলেন। তা না হলে বলতে গেলে এক প্রকার কিশোর বা যুব বয়সেই কোনো রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া সম্পুর্ণ একক উদ্যোগ, প্রচেষ্টা ও পারঙ্গমতায় পুর্ব পুরুষের নুয়ে পড়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে তিনি পুনরুদ্ধার করে একটি স্বস্তি ও স্থিতির জায়গায় দাঁড় করাতে পারতেন না।
অন্যদিকে ফয়েজ আহমদ চৌধুরী প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন তুখোড় সামাজিক লোকও ছিলেন। বাঁশখালী ও আনোয়ারার প্রতিষ্ঠিত সম্ভ্রান্ত প্রায় সব পরিবারের সাথে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তিনি অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ ও এমতাজুল হক চৌধুরীর সাথে বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং প্রথম পরিচালনা পরিষদের অভিভাবক সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদের মতে, ‘ন্যায় নীতি ও সামাজিক গুণাবলীর ক্ষেত্রে ফয়েজ আহমদ চৌধুরীকে আমি অন্য কারো সাথে তুলনা করতে পারি না’। ২০০০ সালে তাঁর মৃত্যুর পর আয়োজিত স্মরণ সভায় প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম (স্যার) বলেছিলেন, ‘দেখলেই যাকে ভেতর থেকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা জাগে, উজ্জল গৌর বর্ণের একজন লোকের নাম ‘কালা’ হলো কী করে জানি না। প্রায় দু’শ বছরের পুরনো ঝুট ঝামেলা কাটিয়ে পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের মতো অত্যন্ত দূরহ কাজটি করে সংসার সংগ্রামে ফয়েজ আহমদ চৌধুরী একজন অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে টিকে থাকবেন’। খান বাহাদুর আবদুচ ছাত্তার মিয়ার ছোট ছেলে জামালুচ ছাত্তার চৌধুরী বলেন, ‘ফয়েজ আহমদ চৌধুরীর সাথে দীর্ঘদিন চলাফেরা করেছি, ওয়াপদার ঠিকাদারী ব্যবসাও করেছি। তাঁর মতো নীতিবান সৎ সামাজিক ব্যক্তি আমি ২য় জন দেখি নাই’। জামালুচ ছাত্তার সাহেব সহ ফয়েজ আহমদ চৌধুরী ভাসানী ন্যাপের রাজনীতি করতেন। ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জামালুচ ছাত্তার সাহেবের নির্বাচনী অফিস ছিল ফয়েজ আহমদ চৌধুরীর বাড়ি। অন্যদিকে জামালুচ ছাত্তার সাহেবের বড় ভাই শ্রদ্ধেয় বজলুচ ছাত্তার সাহেব ছিলেন নেজামে ইসলামী পার্টির প্রার্থী। আবার একই সাথে শ্রদ্ধেয় আতাউর রহমান খান কায়সার সাহেব ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। কায়সার ভাই বলেন, ‘আমার দুই মামা (উপরে উল্লেখিত ছাত্তার ভ্রাতাদ্বয়) এবং আমি ভিন্ন ভিন্ন দল থেকে জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী ছিলাম। কিন্তু মজার বিষয় হল, আমাদের বাড়ি আনোয়ারা বিধায় আমরা ৩জন প্রার্থীর জন্যই ফয়েজ আহমদ চৌধুরীর বাড়িটি উন্মুক্ত ছিল। তাঁর উষ্ণ আন্তরিক অতিথি পরায়ণতা উদাহরণযোগ্য’। বঙ্গবন্ধু সরকারের গভর্নর, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সাবেক সদস্য শ্রদ্ধেয় জাকেরুল হক চৌধুরী ছিলেন ফয়েজ আহমদ চৌধুরীর মামাতো ভাই এবং যুগপথ ভায়রা ভাই। তাঁদের বৃহত্তর পরিবারের পরিধি অনেক বড়। এই বিরাট পরিধির সবার ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখের চূড়ান্ত খোঁজ খবর রাখতেন ফয়েজ আহমদ চৌধুরী। জাকেরুল হক চৌধুরীর মতে, ‘বড় ভাই ফয়েজ আহমদ চৌধুরীর অবর্তমানে আমাদের আত্মীয় স্বজনের এই বিশাল বহরের খবর রাখার মতো আর কেউ থাকবে না। তাঁকে ছাড়া আক্ষরিক অর্থেই আমাদের সামাজিকতা চর্চা অক্ষম হয়ে পড়বে’। বাঁশখালী জলদীর আর এক জমিদার-নন্দন আলাওল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জনাব মর্তুজ আলী চৌধুরী খুবই যুৎসই ভঙ্গিতে বলতেন, ‘আমার কাছে হৃদয় দিয়ে শ্রদ্ধা করার মতো ব্যক্তি হিসেবে ফয়েজ আহমদ চৌধুরী অদ্বিতীয়’। আলাওল কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুল মালেক নূরী মুক্তিযুদ্ধের সময় চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় গ্রহণ এবং অর্থনৈতিক ও মানবিক সাহায্য গ্রহণের সাথে সাথে চৌধুরী সাহেবের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদানের কথা বিভিন্ন সময় উল্লেখ করেন। আর এক বীর মুক্তিযোদ্ধা বাহারচরার বদি আহমদ বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে চৌধুরী সাহেব জোর সুপারিশ করে (অনেকটা বাধ্য করে) ঝুঁকি নিয়ে বৈলছড়ীর তৎকালীন স্বনামধন্য চিকিৎসক ডা. পি.সি. পালকে যদি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ডা. আবু ইউসুফ চৌধুরীর গুরুতর অসুস্থ পিতা মাস্টার ওয়াইজুর রহমান চৌধুরীর চিকিৎসা করাতে না পাঠাতেন তাহলে সেদিন হয়েতো তাঁকে বাঁচানো যেতো না। বাঁশখালীবাসীর অত্যন্ত প্রিয় জনদরদী এই ডাক্তার পাল বাবু বলেন, ‘ডাক্তারী পেশার পাশাপাশি বৈলছড়ী গ্রামে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনে চৌধুরী সাহেবের উৎসাহ ও সহযোগিতা আমার জন্য অপরিহার্য ছিল। আর এই সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে দুই পরিবারে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠে’। সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ নাদেরুজ্জামন চৌধুরী বলেন,‘ফয়েজ আহমদ চৌধুরী ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত, সৎ, উদার, সামাজিক ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক। যার প্রতি মানুষের আপনাতেই অন্তর থেকে শ্রদ্ধা জাগতো’।
‘চৌধুরী সাহেব’ হিসেবে সমধিক পরিচিত প্রখর ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্যের অধিকারী ফয়েজ আহমদ চৌধুরী দূরের বা নিকট কোনোরূপ পার্থক্য না রেখে সবার নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন এবং সর্বক্ষেত্রে সবার সম মর্যাদা প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতেন। তাঁর সহধর্মিনী মরহুমা শাকেরা বেগম চৌধুরীও তাঁর সুযোগ্য সহযোগী ছিলেন। আত্মীয় বা ঘনিষ্ট পরিবার সমুহের সন্তানদের বড় হওয়া, লেখাপড়া বা চাকুরী, বিয়ে শাদির উপযুক্ততার খোঁজ রাখা কিংবা বিয়ে ঠিক করণ ইত্যাদি ছিল ফয়েজ আহমদ চৌধুরীর একটি রুটিন কাজ। পরমত সহিষ্ণু ফয়েজ আহমদ চৌধুরী (অনৈতিক না হওয়া শর্তে) ছোট বড় সবার প্রস্তাব বা আবদার সহাস্যে মেনে নিতেন। তবে ২০ বছরে নানাবিধ প্রচুর আলাপচারিতার মধ্যে আমি তাঁকে কোনো দিনই উচ্চৈঃস্বরে (অট্টহাসি) হাসতে দেখিনি।
১৯৬৯ ইংরেজীতে জলদী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে এস.এস.সি পরীক্ষার কেন্দ্র স্থাপিত হয়। তৎকালীন দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার দিনে দূর দূরান্তের আত্মীয় স্বজনের এস.এস.সি পরীক্ষার্থী সন্তানদের তিনি নিজ বাড়িতে এনে রাখতেন এবং তারা মাসব্যাপি পরীক্ষার পুরো সময় ফয়েজ আহমদ চৌধুরীর বাড়িতে অবস্থান করতো। চৌধুরী সাহেব আনন্দচিত্তে সবার দেখভাল করতেন এবং সবার জন্য পড়া লেখার ভাল পরিবেশের সব ব্যবস্থা করতেন। তিনি নিয়মিত পত্রিকার সব খবর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন, আর শিক্ষামূলক বিষয়গুলো চিহ্নিত করে নিজ সন্তান ও আশে পাশে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতেন।
ফয়েজ আহমদ চৌধুরীর বড় ছেলে ডা. রশীদ আহমদ চৌধুরী বাবার পরামর্শে এলাকাবাসীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৯২ সালের দিকে একদিন তিনি আমার কাছে তাঁর অবর্তমানে পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষা করে ছেলেদের সংসার ধর্ম চালানোর বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলে আমি তাঁকে সব কিছু তাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে তাঁর জীবদ্দশায় তা দেখে যাওয়ার অনুরোধ করলাম। সপ্তাহের কম সময়েরও ব্যবধানে সারাক্ষণ সর্ব বিষয়ে খবরদারীতে অভ্যস্ত দক্ষ, অভিজ্ঞ ও সংগ্রামী সিদ্ধ পুরুষটি সব দায়িত্ব ছেলেদের হাতে ছেড়ে দিয়ে কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে বাকী জীবন স্বচক্ষে আনন্দচিত্তে সন্তানদের সুষ্ঠু সংসার পরিচালনা ও সামাজিক কর্মকাণ্ড উপভোগ করে গেছেন। এসব দিক বিবেচনা করে তাঁকে একজন কালোত্তীর্ণ প্রবাদ পুরুষও বলা যায়। বস্তুত ফয়েজ আহমদ চৌধুরীর মতো একজন মহৎপ্রাণ সামাজিক ব্যক্তির কর্মময় জীবনের পূর্ণ একটি চিত্র সযতনে লিপিবদ্ধ করতে পারলে নিঃসন্দেহে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি অনুসরণীয় উদাহরণ হয়ে থাকতো।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজব্রতী

পূর্ববর্তী নিবন্ধচিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল