জমিদার ধীরেন্দ্র লাল চৌধুরী ও যশোদা বালা চৌধুরীর ঘরে ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন মানিক চৌধুরী। মা যশোদা বালা চৌধুরী আদর করে পুত্রের নাম রেখেছিলেন মানিক। পটিয়ার হাবিলাসদ্বীপের মানিক পরবর্তীতে বাংলাদেশের মানিক হয়ে উঠেছিলেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তির সংগ্রামে মানিক চৌধুরীর মা মহীয়সী রমণী যশোদা বালা চৌধুরীর অবদানও কম নয়। অর্থ বিত্ত, শ্রম দিয়ে আওয়ামী লীগ কে সহযোগিতা করতেন মানিক চৌধুরীর মা যশোদা বালা চৌধুরী।
অত্যন্ত উদার ও অসম্প্রদায়িক ছিলেন মানিক চৌধুরী। অকাতরে মানুষকে দান করতেন। যে শিক্ষা তিনি পরিবার থেকে পেয়েছিলেন। বহু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাসিক খরচ তিনি নিজেই চালাতেন। অনেক নেতাকর্মীকে তিনি ঈদের সময় উপহার পাঠিয়ে দিতেন। এমনকি কুরবানীর সময়ও বহু নেতাকর্মীকে কোরবানির গরু কিনে দিতেন খাজা গরীবে নেওয়াজের এই ভক্ত।
সিক্রেট ডকুমেন্টস অফ ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দা নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিরিজ পুস্তকের ষষ্ঠ ও সপ্তম খণ্ডে দেখা যায় ১৯৬২–৬৩ সালে রাজনীতি যখন নিষিদ্ধ ছিল তখন বঙ্গবন্ধুর সাথে গোপন রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি যে দুজন নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী ছিলেন তার মধ্যে একজন হচ্ছেন জননেতা এম এ আজিজ আরেকজন হচ্ছেন জননেতা মানিক চৌধুরী।
৬০ এর দশকে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে তিনি অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন। ছাত্রলীগের প্রায় কর্মকাণ্ড মানিক চৌধুরীর অর্থে পরিচালিত হতো। বিভিন্ন কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগকে জিতিয়ে আনতে মানিক চৌধুরী কৌশলী ভূমিকা পালন করতেন। ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মানিক চৌধুরীর কৌশলী ভূমিকার কারণে ছাত্রলীগ জয় লাভ করে। সে সময় চট্টগ্রাম কলেজের হিন্দু ছাত্র–ছাত্রীরা ছিল ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক। হিন্দু ছাত্র–ছাত্রীরা ভোট দিতে গেলে ছাত্র ইউনিয়ন জয় লাভ করবে তাই মানিক চৌধুরী হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় গিয়ে বলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দিন ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে সংঘর্ষ হবে। এই কথা যখন হিন্দু পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ল তখন ভয়ে কোনও হিন্দু ছাত্রী চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে যায়নি। ফলে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রথমবার ছাত্রলীগ জয় লাভ করে। বাঙালির মুক্তির সনদ বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার সমর্থনে চট্টগ্রামের লালদিঘিতে যে প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেই জনসভা সফল করতে মানিক চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শুধু তাই নয় ছয় দফার পুস্তিকা, লিফলেট প্রভৃতি প্রকাশ করতে মানিক চৌধুরী অর্থ প্রদান করেন।
ছয় দফা আন্দোলনে এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরী গ্রেফতার হয়ে গেলে মানিক চৌধুরীর পরামর্শে চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। যদিও তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। তারই পরামর্শ সে সময় ডাক্তার সৈয়দুর রহমানকে শহর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয় এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ–সভাপতি এম এ মান্নানকে চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ছয় দফা আন্দোলনে ১৯৬৬ সালে ১৯ শে মে মানিক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে বছরে ডিসেম্বরে তিনি জেল থেকে মুক্তি লাভ করে আবার ছয় দফা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ছয় দফার পক্ষে অবস্থান করার কারণে দৈনিক ইত্তেফাক বাজেয়াপ্ত করে পাকিস্তান সরকার। তাই দৈনিক ইত্তেফাকের বিকল্প হিসেবে আব্দুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত দৈনিক আওয়াজকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু একটা পত্রিকা ভালোভাবে চালাতে গেলে অর্থের প্রয়োজন। সেই অর্থ কোথা হতে সংগ্রহ করবেন এ নিয়ে যখন আব্দুল গাফফার চৌধুরী দ্বিধান্বিত ছিলেন তখন বঙ্গবন্ধু আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে বলেছিলেন তুমি চট্টগ্রামের মানিক চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ কর আমি তাকে দৈনিক আওয়াজ পত্রিকা পরিচালনা করার জন্য বলে দিয়েছি।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলা তথা আজকের বাংলাদেশকে শোষণ করতে থাকে। সেই শোষণ নির্যাতন মানিক চৌধুরী মেনে নিতে পারেননি। এই শোষণ নির্যাতন যারা মেনে নিতে পারেননি তাদের মধ্যে মানিক চৌধুরী সহ কয়েকজন দেশ প্রেমিক সরকারি কর্মকর্তা, সামরিক বাহিনীর অফিসার ও সৈনিকদের নিয়ে ষাটের দশকের প্রথমার্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
১৯৬৭ সালের অক্টোবর–নভেম্বরের দিকে বিশ্বাসঘাতকতা করে আমির হোসেন নামক সামরিক বাহিনীর এক অফিসার তাদের এই পরিকল্পনা ফাঁস করে দেয়। এর পর পরেই পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে ১ নাম্বার আসামি করে মোট ৩৬ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে। মানিক চৌধুরী ছিলেন এই মামলার ১২তম আসামি। যেটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। এটি ছিল একটি সত্য মামলা। মানিক চৌধুরীকে গ্রেফতারের পর তাকে কারাগারে বেশি নির্যাতন করা হয়। কর্নেল মুস্তাফিজ পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে দীর্ঘক্ষণ বরফের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে। এই নির্যাতনের ফলে তার বহু অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অবশ হয়ে যায়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তান সরকার তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে বলে মানিক চৌধুরী পাকিস্তানকে বিভক্ত করার জন্য সশস্ত্র বিদ্রোহীদের অর্থ সহায়তা প্রদান করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করতে ভারতের সহযোগিতার জন্য ভারত সরকারের প্রতিনিধির সাথে দেশের ভিতর এবং ভারতে বৈঠক করেন। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পর মানিক চৌধুরী জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।
১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে তার চেয়ে কম যোগ্য ও কম ত্যাগী নেতাকর্মী আওয়ামীলীগ থেকে মনোনয়ন চাইলেও মানিক চৌধুরী মনোনয়ন চাননি। তবে চট্টগ্রামের কয়েকটি আসনের মনোনয়ন তার পছন্দমত না হওয়ায় তিনি মনঃক্ষুণ্ন হন। যার কারণে তিনি ৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে তিনি তার মনোনয়ন ফরম পরবর্তীতে প্রত্যাহার করে নেন। মানিক চৌধুরীর জীবনের অন্যতম সফলতা হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। যেই যুদ্ধে অংশগ্রহণের পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর সাথে বহু আগেই করেছিলেন। তার সেই লালিত স্বপ্ন ১৯৭১ সালে সফল হয়। যুদ্ধ শুরু হলে কিছুদিন বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যান। পরবর্তীতে মৌলভী আলি আহমেদ মাস্টার নাম ধারণ করে তিনি বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশে এসে বিশেষ করে ঢাকা অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত, অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করে যুদ্ধকে সফলতার পর্যায়ে নিয়ে যান।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এর কাল রাত্রে ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শাহাদাত বরণ করলে তিনি শোকবিহবল হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর হত্যা তিনি মেনে নিতে পারেননি। জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিতে তিনি ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলে ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট ঢাকা এয়ারপোর্টে কর্নেল কাদের তাকে গ্রেফতার করে। একই দিনে জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান সহ ২১জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে তাকে চট্টগ্রাম জেলখানায় নিয়ে আসা হয়। সে সময় তার জেল জীবনের সঙ্গী ছিলেন আব্দুল্লাহ আল হারুন, আতাউর রহমান খাঁন কায়সার, এম এ মান্নান, মহিউদ্দিন চৌধুরী, ইদ্রিস আলম বর্তমান চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী এমপি ও কমান্ডার মো: ইদ্রিস সহ অনেকে। মোস্তাক চক্র তাকে জেলখানা নির্মম নির্যাতন করে। স্বৈরশাসক জিয়াও মোস্তাক সরকারের আদলে মানিক চৌধুরীকে নির্যাতন করতে থাকে। এক পর্যায়ে জিয়া তাকে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিলে তিনি ঘৃণা করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় জেলখানায় তাকে এমন ভাবে নির্যাতন করা হয় যেন তিনি মারা যান। তার মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত জেনে তৎকালীন অবৈধ সরকার তাকে জেল থেকে মুক্তি দেয়। মানিক চৌধুরির চিকিৎসার জন্য ভারতে গমন করেন। এর কিছুদিন পরে বাঙালি জাতির প্রতি অসামান্য অবদান রাখা দেশপ্রেমিক এই মহান ব্যক্তি পরলোক গমন করেন। মানিক চৌধুরী যাদেরকে সাহায্য করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই এমপি হয়েছেন মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু মানিক চৌধুরীর স্মৃতি রক্ষার্থে আদৌ কি তারা কিছু করেছেন? মানিক চৌধুরীর স্মৃতি চিরজীবী হোক।
লেখক : প্রাবন্ধিক