শিক্ষক পিতা একজন ছেলেকে ডাক্তার বানাতে পেরে নিজের জীবনটাকেই সার্থক মনে করেছিলেন। সেই ডাক্তার যখন স্বনামধন্য হন, দেশজোড়া যার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, গরীবের ডাক্তার হিসেবে যার পরিচিতি– এমন একজন সন্তান নিয়ে গর্ব করাটাও স্বাভাবিক। তাই কেবল জীবদ্দশায় নয়; মৃত্যুর পরও সেই ছেলের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর এই শিক্ষক। চন্দনাইশের দোহাজারি জামিরজুরির বাসিন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু তাহের ওরফে তাহের মাস্টারের সেই ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন তার চিকিৎসক ছেলে ডা. এসএম মোস্তফা কামাল। নাড়ির টানকে পেছনে ফেলে কেবল নিজের কাছাকাছি রাখতেই চট্টগ্রামের মিসকিন শাহ মাজারের কবরস্থানে অন্তিম শয়ানে শায়িত করা হয় প্রাণপ্রিয় পিতাকে। কারণ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে লাইফ কেয়ার ডায়গনস্টিক সেন্টারে ডাক্তার মোস্তফা কামালের চেম্বার ছিল। এই চেম্বারে যাওয়া আসা করতে হয় এই পথ দিয়েই। যাওয়া আসার পথে পিতার কবর প্রতিদিন একনজর দেখতে পারবেন, এতে নিজের মনেও প্রশান্তি লাগবে, পিতার অন্তিম ইচ্ছাটাও পূরণ হবে–তাই এমন সিদ্ধান্ত। ২০১৯ সালে জন্মশত বর্ষের দিনই মৃত্যুবরণ করেন মাস্টার আবু তাহের। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি জন্মের শতবর্ষ যেদিন পূরণ হয় সেই দিনই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন চিকিৎকের গর্বিত এই পিতা। কিন্তু এর মাত্র আড়াই বছরের মাথায় ২০২১ সালে করোনা মহামারির সময় করোনায় আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হন ডা. মোস্তফা কামাল। মাত্র ৬৪ বছর বয়সে তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেবে করোনা–এমনটা চিন্তাই ছিল না কারও। কিন্তু ডা. মোস্তফা কামাল নিজের রোগ ও স্বাস্থ্যের অবস্থা বিবেচনায় হয়তো ভেবেই নিয়েছিলেন তাকেও পৃথিবী ছাড়তে হবে সহসা। তাই তার অন্তিম শয়ান কোথায় হবে তার সিদ্ধান্ত নেন। ছেলের জন্য যদি পিতা গ্রাম ছেড়ে শহরে অন্তিম শয়ান বেছে নেন, তবে ছেলে কিভাবে পিতাকে ফেলে থাকবেন গ্রামে! তাই পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে দেন, যদি তার মৃত্যু হয় তবে তাকেও যেন তার বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়। ২০২১ সালের ১৩ জুলাই ঢাকার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন পিতাঅন্তঃপ্রাণ এই চিকিৎসক। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ডা. মোস্তফা কামালকে মিসকিন শাহ মাজারের কবরস্থানে বাবার একই কবরেই দাফন করা হয়। এ যেন পিতা–পুত্রের ভালোবাসার কাছে হেরে যাওয়া নাড়ির টান। আশৈশব কাটানো গ্রামের চির চেনা পরিবেশের মুগ্ধতা।
আবু তাহের মাস্টার চন্দনাইশের চাগাচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদ থেকে অবসর নেন। অবসরের পর গ্রামে থাকলেও জীবনের শেষ সময়টুকু তিনি কাটিয়েছেন ছেলে ডা. এসএম মোস্তফা কামালের পাথরঘাটার বাসায়। শত বছর বছর বেঁচে থাকা পিতার চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার কোনো ত্রুটি হয় নি। ছেলেকে চিকিৎসক বানানোর সার্থকতা ছিল এখানেই। আমার বড় ভাই ডাক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম চৌধুরীর স্ত্রীর বড় ভাই ডা. মোস্তফা কামাল। সে হিসেবে তিনি আমাদের পারিবারিক ডাক্তারেও পরিণত হয়েছিলেন। নিজের, পরিবারের সদস্য, মা–বাবা কিংবা আত্মীয় স্বজনের ছোট বড় যে কোনো অসুখ–বিসুখে তিনিই ছিলেন ভরসা। তার আওতায় থাকলে চিকিৎসা দিয়েছেন। না থাকলে পরামর্শ দিয়েছেন। তাই রোগ–শোক নিয়ে আমাদের খুব একটা ঘাবড়াতে হতো না। কারণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকতো ঘরেই আছেন। কেবল আমাদের নয়, নিজের এলাকায় প্রতি শুক্রবার বিনামূল্যে মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা দিয়েছেন। শহরের চেম্বারে গ্রামের লোক এলেই চিকিৎসা ফ্রি। কোনো ফি নিতেন না। এ জন্য তিনি এলাকায় গরীবের ডাক্তার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। প্রয়াত এই চিকিৎসকের নামে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে স্থাপন করা হয়েছে ‘ডা. মোস্তফা কামাল হার্টফেইলিওর ব্লক।’ যেখানে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের জরুরি চিকিৎসা দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক থেকে অবসর নেওয়ার পর জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল– ইউএসটিসিতে কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ডা. মোস্তফা কামাল হার্ট ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটিসহ বিভিন্ন চিকিৎসাসেবা সংঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে নেতৃত্ব দেন। চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। ২০২০ সালে যখন করোনা মহামারি শুরু হয় তিনি করোনা আক্রান্ত বহু রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন। বহু রোগী তার সেবা পেয়ে কঠিন সেই রোগ থেকে সেরে ওঠেছেন। করোনা সম্পর্কে টেলিভিশন টকশোতে কথা বলে সর্বস্তরের মানুষকে সতর্ক করেছেন। ভাগ্যের পরিহাসে ২০২১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝিতে তিনি নিজেই করোনায় আক্রান্ত হন। তাকে চট্টগ্রামের পার্কভিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে অবস্থার অবনতি হওয়ায় ২৬ জুন নেওয়া হয় ঢাকার বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ১৩ জুলাই তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। আজ ১৩ জুলাই তার মৃত্যুর দুই বছর পূর্ণ হল।
পরম আত্মীয় হিসেবে ডা. মোস্তফা কামালের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মেশার সুযোগ হয়েছে আমার। সাংবাদিকতা পেশাকে বিশেষ মর্যাদা দিতেন তিনি। সে হিসেবে আমাকেও ভালোবাসতেন। তাই বয়সে অনেক অনেক ছোট হলেও অনেক কিছুই আমার সঙ্গে শেয়ার করতেন। মৃত্যুর আগে পিতার অসিয়ত বা শেষ ইচ্ছার বিষয়টিও তিনি আমাকে বলেছিলেন। মৃত্যুর পর কীভাবে পিতার জন্য মিসকিন শাহ মাজার কবরস্থানে কবরের জায়গা জোগাড় করেছেন সে কথাও বলেছেন। পিতার মৃত্যুর পর মিসকিন শাহ মাজারে কবরের জায়গা কিভাবে পাবেন তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন তিনি। খোঁজ নিয়ে সরাসরি চলে যান চন্দনপুরা এলাকায় অবস্থিত মিসকিন শাহ মাজারের এক মোতোয়াল্লির বাসায়। সেখানে গিয়ে পিতার কবরের জন্য সাড়ে তিন হাত জায়গার আবদার করেন। প্রয়োজনে টাকা দিয়ে হলেও। মোতোয়াল্লী আমতা আমতা করছিলেন। এমন সময় তার সামনে আসেন মোতোয়াল্লীর এক মেয়ে। সামনে এসে তাকে স্যার সম্বোধন করেন। বলেন, স্যার আপনার বাবার জন্য মিসকিন শাহ মাজারে অবশ্যই কবরের জায়গা দেয়া হবে। ডা. মোস্তফা কামালকে অবাক করে দিয়ে বলেন, ‘স্যার চট্টগ্রাম মেডিকেলে আমি আপনার ছাত্রী ছিলাম।’ মেয়ের কথায় পিতাও অকপটে রাজি হয়ে যান। পিতার জন্য সহজেই জোগাড় হয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত স্থানে কবরের জায়গা। সেই একই কবরে আড়াই বছরের মাথায় শায়িত হন ডা. এসএম মোস্তফা কামালও। গ্রাম ছেড়ে শহরে অন্তিম শয়ানে পিতা–পুত্র। আল্লাহ তাদের এই ভালোবাসাকে কবুল করুক। তাদের আত্মা শান্তিন্তে পূর্ণ রাখুক। এটাই কামনা করি। ডা. মোস্তফা কামালের উত্তরসূরী হিসেবে বর্তমানে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত আছেন তার ছেলে ডা. তাজওয়ার তাহির আলিফ। ইউএসটিসি ও ম্যাক্স হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত এই ক্ষুদে চিকিৎসক পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছেন। তার সাফল্য কামনা করি।
লেখক: ব্যুরো প্রধান, দৈনিক যুগান্তর; যুগ্ম সম্পাদক, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব।