বাংলা সাহিত্যের অমর ভাষাবিদ গবেষক, বৈয়াকরণিক ও পণ্ডিত অধ্যাপক হরলাল রায়। জন্মে ছিলেন পাড়া গাঁয়ে। কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার ধামতি গ্রামে। ১৯৩৫ সালের ২৯ নভেম্বর কোনো এক সময়ে রায় পরিবারে জন্মনেন এই ক্ষণজন্মা কীর্তিমানপুরুষ। গ্রামের আলো–বাতাস, ধুলিকণায় মিলেমিশে বেড়ে ওঠা হরলাল রায় বাল্যবেলা থেকে মেধাবী ছিলেন। ক্রমাগত তার স্বাক্ষর রেখে যান বাংলা ভাষা সাহিত্যে ও ব্যাকরণে। ৬০ ও ৭০ দশকে বাংলা ভাষা ও তার প্রচলন, রীতিনীতি বাংলা ব্যাকরণের শতাব্দীর প্রাচীন দুর্বোধ্যতা দূর করে ব্যংলা ভাষা ও ব্যাকরণকে ছাত্র–ছাত্রীদের মাঝে বোধগম্যতার স্তরে নিয়ে সহজ সরল ভাষা ও জীবনঘনিষ্ঠ উপমায় প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করে জনপ্রিয় করার মূল কৃতিত্ব বাংলা সাহিত্যের এই মেধাবী শিক্ষক, গবেষক ও খ্যাতিমান বৈয়াকরণিক অধ্যাপক হরলাল রায়ের। বিষয়টি অকপটে স্বীকার করতেই হয় বাংলা ভাষাভাষী তৎকালীন সময়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের।
বলা যায়–আমাদের সময় ‘বাংলা ব্যাকরণ ও ভাষা শিক্ষা’ শিক্ষার্থীদের মাঝে সেতু বন্ধন হয়ে কাজ করেছেন বৈয়াকরণিক পণ্ডিত অধ্যাপক হরলাল রায়। তিনি যেমনি করে বলতেন ঠিক তেমনি করে ভাষার সীমানাকে আবদ্ধ করতেন তাঁর পাণ্ডিত্বের কৌশলে। অতিসহজে তা রপ্ত করতে পারতেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ। আমরা বাংলা ভাষাকে রপ্ত করতাম তাঁর ছলে।
মিশনারী উৎসাহ আর পাণ্ডিত্যপুর্ণ জ্ঞান নিয়ে বাংলা ব্যাকরণ, ভাষা ও সাহিত্যেও বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করে তিনি আমাদের পাঠ্য পুস্তক ও শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে গবেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন নিঃসন্দেহে। সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষার ব্যাকরণ।
হরলাল রায় ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষাজীবনের ইতি টানেন। সে বছরের শেষেরে দিকে সেপ্টেম্বর মাসে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে শুরু করেন কর্মজীবন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শিক্ষায় নিবেদিত হয়ে উজাড় করে বিলিয়ে দেন নিজেকে।
১৯৬৩ সালে পুঁথিঘর থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় অধ্যাপক হরলাল রায় রচিত ‘উচ্চতর ব্যাকরণ ও ভাষা’ এবং পরবর্তীতে বহু সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘উচ্চতর ব্যাকরণ ও ভাষা’ গ্রন্থটি ছিল সে সময়কার ছাত্রছাত্রীদের মাঝে সর্বাধিক পঠিত বাংলা ব্যাকরণের বই। প্রতিটি সংস্করণেই তিনি ছাত্র–ছাত্রীদের জন্য নতুন নতুন বিষয় ও আঙ্গিক যোগ করেছেন যা ছিল আমাদের কাছে সহজবোধ্য ও সাবলীল।
‘উচ্চতর ব্যাকরণ ও ভাষা’ গ্রন্থেও পূর্বভাষণে তিনি বলেছেন,‘স্থান ও কাল ভেদে রুপান্তর হচ্ছে মানুষ ও মানুষের মন। তাই একশো বছর আগের পৃথিবী এখন নেই। আর একশো বছর পরেও আজকের পৃথিবী থাকবে না। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়, নতুবা’ এই পৃথিবীতে টিকে থাকা দায়।’
পরিবর্তন ও রূপান্তরের এই অকাঠ্য নীতি মেনে নিয়েই তিনি প্রতিটি গ্রন্থে ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধণ করেছেন। হরলাল রায় রচিত কোনো না কোনো গ্রন্থ পাঠ না করে স্কুল কলেজের গণ্ডি অতিক্রম করেছে–এমন ছাত্র–ছাত্রী খুঁজে পাওয়া হবে খুবই দুষ্কর। রচনা অধ্যায় পড়তে গিয়ে ‘চৈত্রের দুপর’ রচনার আঙ্গিক এখনো মনে দাগ কাটে। তৃষার্ত কাক মাঠফাটারোদে কর্কোশ স্বরে কা– কা করে উড়ে যায় দূর সীমানায়। কিংবা ‘জোৎস্না রাত’ ‘বষাকাল’ ‘শৈশব স্মৃতি’ পড়তে পড়তে কখন যে হারিয়ে গেছি নিদারুণ স্মৃতির অতল গহিনে, টেরই পাইনি। ভাষা বৈচিত্র্য, বর্ণনা, আঙ্গিক এতই শ্রুতিমধুর ও মনোমুগ্ধকর ছিল–যা একমাত্র হরলাল রায়’ই পেরেছেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-‘উচ্চতর ব্যাকরণ ও ভাষা’ ‘ব্যাকরণ ও রচনা’ ‘বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা’ ‘এসো ব্যাকরণ শিখি’ ‘রচনাদর্শ’ ‘কিশোর বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা’ ‘ছোটদের বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা’ ‘দেরভাষা প্রবেশ, ‘সঞ্চয়ন’ ‘সংস্কৃত পাঠ’ ‘বাংলা ছন্দের রূপরেখা’ ‘চর্চাগীতি’ ‘উচ্চতর বাণিজ্যিক বাংলা’ ‘বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস’ ‘একের ভেতর তিন’ প্রভৃতি।
বাংলা ব্যাকরণের এই দিকপাল পণ্ডিত শুধুমাত্র পাঠ্য ও সহায়ক গ্রন্থ রচনাতেই কেবল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তা কিন্তু নয়, বাংলা সাহিত্যের মৌলিক গবেষণাতেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, তাঁর ‘চর্চাগীতি’ গ্রন্থে’। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্চাপদের ওপর তাঁর পর্যালোচনা গ্রন্থ ‘চর্চাগীতি’। এ গ্রন্থে তিনি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এই গ্রন্থের আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে–সহজ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ছাত্রদের অনেক প্রশ্নের সহজ সমাধান তিনি সাথে সাথে দিয়েছেন। যা শিক্ষার্থীর সময়, পরিশ্রম সংক্ষিপ্ত হয়ে এসেছে। পাণ্ডিত্যের ভারে পণ্ডিতদের বই অনেক শিক্ষার্থীর বোধগম্য হয় না, না হওয়ার হেতু খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। হরলাল রায় এখানে সেতু বন্ধন তৈরি করেছেন ওই সব শিক্ষার্থীর জন্য।
অধ্যাপক হরলাল রায় আজ থেকে সাড়ে তিন দশক আগে ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ মাসে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। সে সময় তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ ছিলেন। প্রিয় এই ভাষাবিদকে শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক











