স্মরণের আবরণে সাংবাদিক সাধন কুমার ধর

এম নাসিরুল হক | বুধবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ


পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা সারাটি জীবন মানুষের জন্য কাজ করে যান নীরবে, নিভৃতে। চান না কোন প্রচার প্রচারণা। তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন দৈনিক আজাদীর সাবেক বার্তা সম্পাদক সাধন কুমার ধর, চলাফেরা, কথা-বার্তায় তিনি ছিলেন আপসহীন। সারা জীবন বুক ফুলিয়ে শির উঁচু করে হেঁটেছেন। একবারের জন্যও মাথা নত করেননি। সাংবাদিকতার এই শিক্ষক সাধন বাবুর জন্ম রাউজানের ডাবুয়া ইউনিয়নের প্রসিদ্ধ জমিদার ধর পরিবারে। লেখাপড়া শেষ করেছেন কলকাতায়। ধর পরিবারের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ছিল দেশ জোড়া। কিন্তু এগুলো নিয়ে কথা-বার্তা বলতে তাঁকে খুব বেশি শুনি নি। ১৯৭৭ সালের ১লা জুন আমি আজাদীতে যোগদানের পর থেকে যতদিন আজাদীতে ছিলাম ততদিন তিনি আমাদের বার্তা সম্পাদক ছিলেন। কলকাতা থেকে বিএসসি পাস করে এসে তিনি শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন হাটহাজারী স্কুলে। দীর্ঘদিন শিক্ষকতার পর তাঁর পরম বন্ধু দৈনিক আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের আহ্বানে আজাদীতে যোগদান করেন ১৯৬২ সালে। তিনি ২৭ বছর ডাবুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। এর আগে ছয় বছর সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন ঐ ইউনিয়ন পরিষদে। একবার তাঁর ইউনিয়নে সার্কেল অফিসারের দপ্তর থেকে কয়েকজন লোক গেছেন ইউনিয়নের কর্মকাণ্ড অডিট করতে। ইউপি সেক্রেটারী চেয়ারম্যান সাধন বাবুকে বললেন, সি. ও. অফিস থেকে লোক এসেছে তাদের দুপুরে খাওয়াতে হবে এবং যাতায়াত ভাতা দিতে হবে। এটা শুনে সাধন বাবু বললেন, তাদের যারা পাঠিয়েছে তারা ওদের খাবারের ব্যবস্থা করবে এবং গাড়ি ভাড়া দেবে। আমি ইউপিতে কাজ করে এক সের গম বিক্রি করিনি এবং আমার কোন অতিরিক্ত টাকা নাই যে আমি তাদের খাওয়াব। ’৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে রাতের শিফটে কাজ করার সময় কলেজিয়েট স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক এসে বললেন -আজকে যে অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা হয়েছে অংক বিষয়ের তার প্রশ্নপত্রে ভুল আছে। সাধন বাবু হাত টেনে তাদের কাছ থেকে প্রশ্নটা নিয়ে একটুখানি দেখে বললেন, প্রশ্ন ঠিক আছে। তখন শিক্ষকরা বলছিলেন, আমরা তো ছেলেদের পড়াচ্ছি। আমাদের জানামতে প্রশ্নটিতে একটি অংক ভুল আছে। সাধন বাবু তাঁর সামনে থাকা ডেস্কের ক্লিপ ফাইলে তাৎক্ষণিক অংকটি করে বললেন উত্তরটা দেখেন। দেখা গেছে উত্তরটা তাঁর কষা উত্তরের সাথে মিলে গেছে। লেখাপড়ার গভীরতা যে কতটুকু ছিল তা তিনি কোন দিন জাহির করতেন না। তাঁর বড় ছেলে কিংশুক ধর আমার ক্লাস ফ্রেন্ড। এটা জানার পরও তিনি কোন দিন আমাদেরকে তুমি করে সম্বোধন করেন নি। যে কোন বিষয় জানতে চাইলে তাৎক্ষণিক উত্তর দিতেন। একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম এত কিছু আপনার মনে থাকে কেমনে? আমাদের তো থাকে না। তিনি বললেন, আমাদের লেখাপড়া ছিল অনেক গভীর আপনাদেরগুলো ভাসা ভাসা, তাই মনে থাকে না।
একবার দৈনিক আজাদী অফিসে হামলা হল একটি নিউজ নিয়ে। একটি সিনেমা হলে কালোবাজারীদের সাথে কিছু কলেজ ছাত্রের মারামারি হয় এবং সেখানে একটি ছেলে মারা যায়। হেডিং-এ লেখা হয়েছিল ‘স্থানীয়দের সাথে কলেজ শিক্ষার্থীদের মারামারি’ এতে ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়। তাদের কথা ছিল আমাদের সাথে মারামারি হয়েছে টিকিট কালোবাজারীদের সাথে স্থানীয়দের সাথে নয়। যে ছেলেটি মারা যায় তার জানাজা শেষে শত শত ছাত্র মিছিল করে স্লোগান দিয়ে এসে আজাদী অফিসে হামলা চালায়। তারা অফিসে এসে গালাগাল দিয়ে সাধন বাবুকে খুঁজছিলেন। তিনি তখন অফিসে ছিলেন। তাকে খোঁজার পর তিনি হামলাকারীদের সামনে এসে বললেন, ‘আমি সাধন বাবু, তোমাদের কি বলার আছে আমাকে বল’। অবশ্য তাঁর গায়ে হাত তোলার সাহস পায় নি। কিন্তু আসবাবপত্রসহ সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার করে স্লোগান দিতে দিতে চলে যায়। এ রকম সাহসী মনের মানুষ আমি অন্তত কম দেখেছি।
দৈনিক আজাদী সম্পাদক মোহাম্মদ খালেদের সাথে মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর একটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছিল। সম্ভবত এটা ছিল জেলা পরিষদের নির্বাচন। ভোট চাওয়ার জন্য ফজলুল কাদের চৌধুরী সাধন বাবুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। আতিথেয়তার পর স্বভাবসুলভ ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেছেন, খালেদ সাব কউয়া ভোট পাইবু। তুই কিল্লাই তোয়ার ভোটটা পৌঁছাইতা ওয়া সাধন ব-ও’ এরপর চৌধুরীর হাসি। এ সময় তাঁর সামনে বসেই বললেন, প্রফেসার খালেদ সাহেব কমপক্ষে দুইটা ভোট পাবেন। একটি আমার এর একটি ওনার (নিজের) পরে চৌধুরী বললেন, -আঁর কথা আই কইলাম, ‘তুই এক্কানা চিন্দা গড়ি চাইয়ু; ওয়া সাধন ব-ও’। তৎকালীন সময়ে ফজলুল কাদের চৌধুরীর সামেন এভাবে সাহস দেখিয়ে কথা বলার লোক খুব কম ছিল।
নিয়মানুবর্তিতা তাঁর জীবনের অংশ ছিল উল্লেখ করার মত। তিনি প্রতিদিন রাত ৮টা বাজার দু’মিনিট আগে অফিসে ঢুকতেন এবং চেয়ারে বসেই খাতাতে সই করা ছিল তার প্রথম কাজ। আমি আজাদী থাকাকালীন দৈনিক কমপক্ষে দুইবার অফিসে আসলেও হাজিরা খাতায় সই করতে ভুলে যেতাম। একদিন তিনি কথায় কথায় বলছিলেন হাজিরা খাতায় সই করা এটাও একটি চাকরির অংশ। এটা অবশ্যই মানতে হবে।
একবার আমাদের একজন কলিক রিপোর্টারদের নিয়ে একটি গল্প লিখেছিলেন। তিনি সেখানে চেষ্টা করেছিলেন বুঝাতে যে, রিপোর্টাররা ‘সৎ’ নয়। আরো অনেক কিছু। আমি সাধন বাবুকে বললাম, স্যার এখন থেকে কাজ করা কমিয়ে দেব। এর কারণ জানতে চাইলে আমি ঐ গল্পের কথাটা বললাম। তিনি বললেন, যারা কাজ করে তাদের বদনামী হয়। আজ যারা কাজ করে না তাদের কোন বদনামী হয় না। আপনি কাজ করে যান, আর যারা মনে করে বদনামী করা তাদের কাজ তা তারা করতেই থাকবে। এমন একটি উদ্দীপনামূলক সান্ত্বনা আমাকে সে দিন সাহস যুগিয়েছিলো।
দৈনিক আজাদীতে প্লেগের নিউজ করে আমার চাকরি গেল এবং বিএনপি সরকারের আমলে মামলাও হল আমার বিরুদ্ধে। অথচ এই নিউজের জন্য যদি মামলা হতে হয় তাহলে যাদের বিরুদ্ধে হবার কথা ছিল তাদের বিরুদ্ধে না করে সাধন বাবুকে আসামী করা হয়েছিল। যদিও সাধন বাবু সে সময় এক সপ্তাহের ছুটিতে ছিল দুর্গাপূজা উপলক্ষে। যদিও আমরা সেদিন সরকারিভাবে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছি, কিন্তু সাধন বাবুকে অন্যায়ভাবে হয়রানি করা হয়েছিল। আমি এখনো বলি ঐ সংবাদ একশ ভাগ সত্য ছিল, যা পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন তৎকালীন ডিসি আবুল কাসেম সাহেব।
দৈনিক আজাদী সম্পাদক ছিলেন সাধন বাবুর বন্ধু। অফিসে তাদের খুনসুঁটি আমরা খুব এনজয় করতাম। প্রফেসর সাহেব মাঝে মধ্যে তার রুম ছেড়ে সাধন বাবুর পাশের চেয়ারে এসে বসতেন। কাজের সময় সাধন বাবুর অন্য কিছু খেয়াল থাকত না। কলিকদের কাজ বুঝিয়ে দেয়া এবং তাদের কাজ আদায় করে নেয়ার ব্যাপারে তিনি থাকতেন খুব সিরিয়াস। এই সুযোগে খালেদ সাহেব সাধন বাবুর ডেস্ক খুলে একটি সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে ফেলতেন। সাধন বাবু সিগারেটের প্যাকেট বের করে বলতেন আমার এখানে এতটা সিগারেট ছিল, এখন একটা কম কেন? এরি মধ্যে প্রফেসর সাহেব তার রুমে চলে যেতেন। তখন সাধন বাবু বলতেন, ‘অ, বুজ্জি তুই ডাকত আই বইস্‌সুদে এই কামল্লাই’- আমার এই আলোচনায় কিছু বিষয় আছে যা তার মুখ থেকে শোনা। আর অন্য বিষয়গুলো আমার দেখা। সাধন বাবু দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন, রাজনীতিতে বিক্রি করে তাঁর অর্থবিত্ত বাড়ানোর চেষ্টা ছিল না তার মধ্যে, তাঁর মত গুণী, নিষ্ঠাবান, ন্যায়নীতিপরায়ণ মানুষকে হারিয়ে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণের আবরণে বিদূষী এক নারী বেগম ফজিলাতুল কদর
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ