বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি মাহেন্দ্রক্ষণ ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও পাক–বাহিনীর আত্মসমার্পণান্তে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় মিছিল। বাঙালির সুমহান আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম আমাদের বিজয় অর্জনে বিরাট সাফল্য বয়ে এনেছে। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোন অবস্থানে কী ঘটেছিল তার অনেক কিছু এখনও আমাদের নবীনদের নিকট অজানা অচেনা রয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ বংশধরদের অবগত করা আমাদের মহান দায়িত্ব ও কর্তব্য। স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রাউজানের ১১নং পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মরহুম এ.কে ফজলুল হক সাহেবের বড় অবদান হল, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুজিব বাহিনী গঠন করা এবং সঠিক সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা। গত ৭ জানুয়ারি ছিল তাঁর ছত্রিশতম মৃত্যুবার্ষিকী। গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি তাঁকে এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য যে সব বীর সেনানী নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ পশ্চিম গুজরা ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন পি.কে. সেন বাজার (মগদাই) এলাকায় বিকেল ৪.০০ টায় আমরা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে বিজয় মিছিল বের করি। এ বিজয় মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে ফজলুল হক সাহেব। বিজয় মিছিলে ইউনিয়নের উত্তর অংশ হতে যোগ দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস হাফিজ খান রুমু সাহেবের দল। ইউনিয়নের দক্ষিণ অংশ হতে মিছিলে যোগ দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ মিত্র বড়ুয়ার দল। এছাড়া উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন ডা. সরফরাজ খান বাবুল, মো. জাকেরিয়া, দুলাল বড়ুয়া, আবদুল মান্নান, পরিমল বড়ুয়া প্রমুখ। এতে স্থানীয় উল্লসিত জনসাধারণও অংশ নেন।
কিছুক্ষণ অবস্থান শেষে এ বিজয় মিছিল থেকে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ মিত্র বড়ুয়া একটি দল নিয়ে মিছিল সহকারে চলে গেলেন ইউনিয়নের দক্ষিণ প্রান্তে। বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শওকত হাফিজ খান রুশ্নির নেতৃত্বে কাগতিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠেও বিজয় মিছিল ও সমাবেশ ছিল। তাই বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে ফজলুল হক সাহেবের নেতৃত্বে আমরা মিছিল নিয়ে ইউনিয়নের উত্তর প্রান্তে কাগতিয়া স্কুল মাঠের সমাবেশস্থলে গিয়ে যোগদান করি। উক্ত সমাবেশে উপস্থিত সকলকে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শওকত হাফিজ খান রুশ্নি সাহেব ধৈর্য্য ধারণ করার আহবান জানিয়ে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য প্রদান করেন। এতে আরো বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে ফজলুল হক সাহেব, মো. জাকেরিয়া সাহেব, রুমু সাহেব, বাবুল সাহেব প্রমুখ। এভাবে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর আমরা পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নে বিজয় মিছিল সমাপ্ত করি। আমার স্মৃতিতে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম এবং শ্রেষ্ঠ দিন ১৯৭১ সালের বিজয় মিছিলের সময়টি।
যাঁর নেতৃত্বে ও মহানুভবতায় মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম সেই কীর্তিমান পুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা এ.কে ফজলুল হকের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো গত ৭ জানুয়ারি ২০২৩। তিনি স্বীয় থানায় শিক্ষা বিস্তারে অনন্য ভূমিকা পালনকারী, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের ঋণ সালিশি বোর্ডের সদস্য, চট্টগ্রাম আদালতের জুরার এবং রাউজান শিক্ষক সমিতির আমৃত্যু সভাপতি, উত্তর চট্টগ্রামের ‘শিক্ষকরবি’ খ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক ও মুসলিম মনীষা হযরত আলহাজ্ব ওছমান আলী মাস্টার (রহ.) প্রকাশ-‘বড় মাস্টার’ এর সুযোগ্য প্রথম পুত্র।
তিনি ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ আন্দোলন, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৮ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন ও ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁদের বাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম প্রধান ‘শেল্টার হাউস’ ছিলো। আমৃত্যু অসামপ্রদায়িক ও দুর্বার সাহসী ফজলুল হক দীর্ঘদিন অত্যন্ত সুনামের সাথে ১১নং পশ্চিম গুজরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং রাউজান চেয়ারম্যান সমিতির সভাপতি ছিলেন। জনাব হক গহিরা শান্তির দ্বীপ কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতিরও দীর্ঘসময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এ.কে ফজলুল হক ১৯৮৭ সালের ৭ জানুয়ারি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেন।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক, গুজরা শ্যামা চরণ উচ্চ বিদ্যালয়, রাউজান, চট্টগ্রাম।