১৭৫৭ সালের জুন মাসে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে পরিচালিত ইংরেজ বাহিনী এদেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তায় পলাশীর যুদ্ধে বাংলার বাহিনীকে পরাজিত করে এবং নৃশংসভাবে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা নিহত হন। নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাকে হত্যা করে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানী সারা বাংলার মালিক বনে যায়। ব্যবসায়ী কোম্পানী বণিক শক্তি থেকে সামরিক ও রাজ্যধিকারী শাসকে পরিণত হয়। শুরু হয় ঔপনিবেশিক শাসনকাল। ইংরেজদের অত্যাচার নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিদের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলা শুরু হয়। বৃটিশ রাজ শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণে ১৮৫৭ সালের ৮ এপ্রিল দুই বীর সিপাহী মঙ্গল পান্ডে ও ঈশ্বরী পান্ডেকে ইংরেজরা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে।
বাংলায় বৃটিশ বিরোধী সিপাহী বিপ্লবের আগুন এখান হতেই প্রথম শুরু হয়। মঙ্গল পান্ডে ও ইশ্বরী পান্ডের হত্যার পরে ভারতের সিপাহীদের মধ্যে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের ৩৪ নং নেটিভ বেঙ্গল পদাতিক রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করেন হাবিলদার রজব আলী খাঁ নেতৃত্বে। ১৮৫৭ এর ১৮ নভেম্বর হাবিলদার রজব আলীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম প্রায় ৩০ ঘন্টা ব্রিটিশ শাসন মুক্ত রাখা হয়। চট্টগ্রামে হাবিলদার রজব আলীর সিপাহী বিদ্রোহ রক্তক্ষয়ী এ বিদ্রোহ প্রচণ্ডভাবে সমগ্র বাঙালির মনে রেখাপাত করে। বিপ্লব ও বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায় ১৮৯৯–১৯০১ সালে কলকাতার তরুণ ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রের উদ্যোগে বাংলার প্রথম গোপন বিপ্লবী দল ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সমিতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের দ্বারা ইংরেজদের পরাধীনতার নাগপাশ থেকে ভারতকে স্বাধীন করা। এর কিছুদিন পর রবীন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে একদল তরুণ বিপ্লবী ১৯০৬ এর মার্চ মাসে ‘যুগান্তর’ পত্রিকা প্রকাশ করে। যুগান্তর পত্রিকাকে ঘিরে তরুণদের মাঝে আরেকটি বিপ্লবী দল গড়ে উঠে। ‘যুগান্তর’ আর অনুশীলন’ উভয় বিপ্লবী দলেরই আদর্শ ও লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র বিপ্লবী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠা। বাংলার বিপ্লবী দলের প্রথম শহীদ প্রফুল্ল চক্রবর্তী ১৯০৭ সালে দেওঘর পাহাড়ে কুমিল্লার বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের তৈরী বোমা পরীক্ষার সময় মারা যান।
১৯০৮ এর ৩০ এপ্রিল কিশোর বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী বিহারের মজ্জফর পুরে ইংরেজ কর্মচারী কিংস ফোর্ডকে বোমা মারতে গিয়ে ভুল করে তা মিসেস ও মিস কেনিডির গাড়িতে পড়ে। প্রফুল্ল চাকী নিজ রিভলভারের গুলিতে মৃত্যুবরণ করে আর বিচারে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়।
সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস ও গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনের পূর্ববর্তী অগ্নিযুগের ইতিহাস হলো অসংগঠিত বিপ্লবের কাহিনি। ক্ষুদ্র মনের প্রতিক্রিয়া রক্তের বদলে রক্ত, অত্যাচারের জবাবে অত্যাচার। এটিকে মূল মন্ত্র হিসেবে ধারণ করে চট্টগ্রামের তরুণ দল এক অগ্নিমন্ত্রে দিক্ষীত হয়ে এবং এ আদর্শকে ধারণ করে ইস্পাত কঠিন শপথ নেয়। যা হলো বৃটিশ রাজশক্তির কবল থেকে মাতৃভূমির মুক্তি। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা কঠিন অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে দেশ মাতাকে মুক্ত করার শপথ নিয়ে ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে পাঁচ জন সদস্যকে নিয়ে বিপ্লবী দল গঠন করেন। পাঁচ জন বিপ্লবীরা হলেন, (১) সূর্যসেন (মাস্টার দা), (২) অনুরূপ সেন, (৩) নগেন সেন (জুলু সেন), (৪) অম্বিকা চক্রবর্তী, (৫) চারুবিকাশ দত্ত।
চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য স্বাধীনতা সংগ্রামী চারুবিকাশ দত্ত। ১৮৯৫ সালে বিপ্লব তীর্থ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার কানুনগোপাড়া গ্রামে বিপ্লবী চারুবিকাশ দত্তের জন্ম। পিতা শশীভূষণ দত্ত ও মাতা শৈলজাবালা দত্ত। স্থানীয় স্কুলে লেখাপড়ার হাতেখড়ি। ছাত্রাবস্থায় তিনি অনুশীলন দলে যোগ দেন। আমরণ তিনি এই দলের আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে কাজ করেছেন। তিনি নিজেকে চট্টগ্রামের ‘অনুশীলন’ দলের নেতা গিরিজাশংকর চৌধুরীর শিষ্য হিসেবে পরিচয় দিতেন। চট্টগ্রামে তিনি অনুশীলন দলকে সাংগঠনিকভাবে প্রতিষ্ঠা করার কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯১৮ সালে মাস্টারদার নেতৃত্বে যে বিপ্লবী দল গঠন করা হয় তাত্থেকে চারুবিকাশ দত্ত বেরিয়ে যান এবং গোপন সংবিধান অনুসারি বিপ্লবী সংগঠন চারুবিকাশ দত্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও দুটি বিপ্লবী দল আলাদাভাবে কাজ শুরু করেন। মাস্টারদার নেতৃত্বে বিপ্লবী দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মাঝে ৪ জনই মাস্টারদার নেতৃত্বে বিপ্লবী দল এবং এদের অধীনে অনন্ত সিংহ সহ ১৫ সদস্যের প্রথম সারির সদস্যরা চট্টগ্রামে আলাদাভাবে বিপ্লবী কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯১৮ সালে চারুবিকাশ দত্ত চট্টগ্রাম অনুশীলন দলের চট্টগ্রাম শাখার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময়েই বিপ্লবী প্রমোদ রঞ্জনের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা জন্মে। উভয়ের এ ঘনিষ্ঠতা আজীবন অক্ষুণ্ন থাকে। ১৯২০–২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান।
১৯২৪ সালে রাজদ্রোহের অপরাধে তাঁর কারাদণ্ড হয়। ১৯২৮–২৯ সালে চারুবিকাশ দত্ত জেলে ও স্বগৃহে অন্তরীণ ছিলেন। ১৯৩০ সালের জানুয়ারী মাসে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১০৮ নং ধারা মতে তিনি পুনরায় অভিযুক্ত হন।
বৃটিশ রাজশক্তি চারুবিকাশ দত্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন যে, ‘তিনি ছায়াচিত্র সহযোগে বক্তৃতার মাধ্যমে ভারতের ঐশ্বর্য এবং বিদেশীদের কর্তৃক ভারতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের কথা বলে মানুষের মাঝে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য উৎসাহীত করেন’। তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত এ অভিযোগের প্রতি উত্তরে তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবরে ৭৫ পৃষ্ঠার এক জবানবন্দী দাখিল করেন।
১৯৩১ সালে রাজদ্রোহের অপরাধে তাঁকে কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। দীর্ঘ সাত বছর একটানা কারাবাসের পর ১৯৩৮ সালে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৩৮ এর আগস্ট মাসে তিনি চট্টগ্রাম এসে পৌঁছালে রেলওয়ে ষ্টেশনে তাঁকে গণ–সংবর্ধনা দেয়া হয়। মুক্তিলাভের পর তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। এরপর থেকে তিনি কংগ্রেস দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে এবং কংগ্রেসের আদর্শ প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বহু জনসভায় বিদেশী শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে এবং স্বদেশী শিল্প প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনামূলক বক্তৃতা করেন এবং কংগ্রেসের নীতি ও আদর্শ নিয়ে প্রায়শ বক্তব্য দেন।
চারুবিকাশ দত্ত একজন নিবেতি প্রাণ কংগ্রেস কর্মী এবং আপোষহীন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। শারীরিক অক্ষমতা তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে এবং তাঁর অবিচল নীতি ও আস্থাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। গ্রামে গ্রামে গিয়ে তিনি ছায়াচিত্রের সাহায্যে ভারতের ঐতিহাসিক অতীত ও গৌরবের নিদর্শন এবং বিপ্লবীদের জীবনের ইতিহাস বিশেষ করে তাঁদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের রোমাঞ্চকর ঘটনাবলী জনগণকে আবেগ দিয়ে বুঝিয়ে বক্তৃতা করতেন। জনগণ তাঁর এ বক্তব্য আগ্রহ ভরে শুনতেন।
বিপ্লবী চারুবিকাশ দত্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর গ্রন্থ এবং অনেক প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর রচিত বিখ্যাত দু’টি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। ‘বিপ্লবী বীর প্রমোদ রঞ্জন’ বইটি তাঁর সতীর্থ বিপ্লবী প্রমোদ রঞ্জনের জীবন ও বিপ্লবী আদর্শ নিয়ে রচনা করা হয়েছে অপর গ্রন্থটি ‘রাজদ্রোহীর জবানবন্দী’ (১৯৩১) শীর্ষক গ্রন্থটিতে বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর নিজস্ব ভাবাদর্শ নিয়ে রচনা করা হয়েছে। চারুবিকাশ দত্ত রচিত উভয় গ্রন্থই ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়।
উপরোক্ত গ্রন্থ দু’টিতে চট্টগ্রামের স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু তথ্য বিবৃত করা হয়েছে। একজন উৎস্বর্গীকৃত প্রাণ স্বাধীনতা সংগ্রামী চারুবিকাশ দত্ত বাঙালিদের নিকট স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। মহান এ স্বাধীনতা সংগ্রামী ৮ মে (২৫ শে বৈশাখ) ১৯৬১ সালে পরলোক গমন করেন। আজ এসব বিপ্লবীদের এবং দেশপ্রেমিকদের কথা আলোচনা করতে গিয়ে মনে হয়, আমরা আজ যে স্বাধীনতা ভোগ করেছি তাঁর ভিত্তি রচনা করেছেন এ রকম নাম জানা না জানা বিপ্লবী ও শহীদেরা গুলির মুখে, ফাঁসির দড়িতে, পুলিশের লাঠির কাছে গোয়েন্দা পুলিশের গোপন কুটরির নির্মম অত্যাচারে এরা বিদায় নিয়েছিল সুন্দর ধরণী থেকে। শ্রদ্ধার সাথে আমাদের সে সব বিপ্লবের কথা স্মরণ করতে হবে এবং তার যথাযথ মূল্য দিতে হবে।
সূত্র ঃ ১। অনন্ত সিংহ রচিত ‘অগ্নিগর্ভ’ চট্টগ্রাম, ব্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, কলকাতা।
২। সুনীতি ভূষণ কানুনগো সম্পাদিত, চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘চট্টগ্রাম চরিতাভিধান’।
৩। পুর্ণেন্দু দস্তিার রচিত ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম, বইঘর, চট্টগ্রাম।
লেখক: প্রাবন্ধিক: সম্পাদক, শিল্পশৈলী।