
দীপ্তিময় ব্যক্তিত্ব এবং প্রতিভার প্রভাবে সমাজ ও জাতি গৌরবময় স্বর্ণশিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়। শিক্ষক এমন একজন ব্যক্তিত্ব যার বিকশিত আলোকবর্তিকায় সমাজ–জাতি আলোকিত হয়। আজ এমন একজন আলোকিত ব্যক্তিত্বের কথা বলব যার আলোয় আলোকিত হয়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা আনোয়ারা ও কর্ণফুলীর প্রত্যন্ত জনপদ। এতদঞ্চলের বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তিনি প্রায় দুই যুগেরও বেশি শিক্ষকতা করেছেন। এর মধ্যে দুটি স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন প্রায় ১৬ বছর। অথচ তিনি বেঁচে ছিলেন মাত্র ৫১ বছর।
যার কথা বলছিলাম তিনি হলেন আনোয়ারা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমানে সরকারি) এবং পশ্চিম পটিয়ার (বর্তমানে কর্ণফুলী উপজেলা) দৌলতপুর বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল মোতালেব। এই মহান শিক্ষকের সাথে আমার কীভাবে যোগাযোগ হলো সেই স্মৃতিটুকুর কথা আজ আলোকপাত করব। আমি ১৯৮৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমরা তখন কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। রেজাল্ট বের হতে প্রায় তিনমাস সময় লাগত। সেই তিন মাস আমি বিভিন্ন ক্লাসের কিছু ছাত্র পড়তাম। শ্রদ্ধাভাজন স্যারের নিজ বাড়ি ছিল আনোয়ারা থানার শিলাইগড়া গ্রামে। আর আমার বাড়ি ছিল পাশের ঝিওরী গ্রামে। আমি শিলাইগড়া গ্রামের কিছু ছাত্র পড়াতাম। এমন সময় কার কাছ থেকে খবর পেয়ে স্যার উনার সন্তানদের পড়ানোর জন্য আমাকে নিয়োগ করলেন। স্যারের বড় ছেলে টিপু তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল, অন্যরা প্রাইমারি স্কুলে পড়ত। আমি বিশেষ করে টিপুকেই পড়াতাম। তাও প্রতিদিন নয়, কারণ টিপু বেশির ভাগ সময় স্যারের সাথে থাকতেন। স্যার তখন দৌলতপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
আমি যখন স্যারের বাড়িতে যেতাম, প্রায় সময় বিভিন্ন বিষয়ে স্যারের সাথে আমার কথা হতো। আমার পড়াশোনা, জীবনের লক্ষ্য এবং আমার পরিবারের খবরা–খবর নিতেন। স্যার সবসময় আমাকে অনেক উপদেশ দিতেন। জীবনে কীভাবে বড় হতে হয়, জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য কী কী গুণাবলী অর্জন করতে হয়, অধ্যবসায় ও নিয়মানুবর্তীতা একজন ছাত্রকে কীভাবে সাফল্যের শিখরে নিয়ে যায় ইত্যাদি বিষয়ে স্যারের দিক নির্দেশনামূলক কথাগুলো আমি মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। স্যারের এসব অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য ছিল আমার জীবনের সাফল্যের উৎস।
মোতালেব স্যার একজন শিক্ষক হিসেবে, সমাজহিতৈষী ব্যক্তি সর্বোপরি একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে এলাকায় একজন অনুসরণীয়, অনুকরণীয় ব্যক্তি ছিলেন। প্রায় তিন মাস আমি স্যারের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। এই তিন মাসে তিনি আমার মনোজগতকে ঋদ্ধ করেছেন, আমার চিন্তা চেতনাকে করেছেন সমৃদ্ধ। এরই মধ্যে আমার এসএসসি, পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। আমি কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড থেকে মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান অধিকার করি। আমার রেজাল্ট শুনে স্যার অত্যন্ত খুশি হলেন। আমাকে চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার পরামর্শ দিলেন এবং স্যারের একজন প্রাক্তন ছাত্রের সন্তানদের পড়ানোর জন্য আগে থেকে আমাকে ঠিক করে রাখলেন। স্যার জানতেন আমার আর্থিক অবস্থা ভালো না। এ কারণে স্যার চট্টগ্রাম শহরে আমার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে রাখলেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়ে আমি যখন হোস্টেলে সিট পাওয়ার কথা স্যারকে জানাই তিনি তখন আমাকে হোস্টেলে থাকতে পরামর্শ দিলেন। আমি হোস্টেলে থেকে দুই–তিনটি টিউশনি করে নিজ লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করতে লাগলাম। মাঝে মাঝে স্যারের সাথে যোগাযোগ করতাম। কিন্তু এই যোগাযোগ খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মৃত্যু নামক মহাসত্য বিষয়টি আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পিতৃসম একজন মহান শিক্ষাগুরুকে আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেললাম। তিনি সরাসরি আমার শিক্ষক ছিলেন না, শ্রেণিকক্ষে তিনি আমাকে সরাসরি পাঠদান করেননি বটে। কিন্তু কথাবার্তা, আচার আচরণে তিনি আমাকে যে শিক্ষা দান করেছেন তার মধ্য দিয়ে মোতালেব স্যার আমার হৃদয়ে মহান শিক্ষা গুরুর স্থান দখল করেছিলেন।
১৯৮৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর আমাদেরকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে মোতালেব স্যার চিরবিদায় নিলেন। স্যারের আকস্মিক মৃত্যু যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মনে হলো। আমার দুর্ভাগ্য স্যারের শেষযাত্রায় আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। কারণ স্যারের মৃত্যু সংবাদ আমি শুনেছি মৃত্যুর পরের দিন দৈনিক আজাদী পত্রিকার মাধ্যমে।
মোতালেব স্যারের মতো মানবদরদী, পরোপকারী সমাজসেবক, গুণী, বিজ্ঞ শিক্ষক বর্তমান সমাজে বিরল। তিনি এলাকার গরিব ছাত্রছাত্রী, দরিদ্র মানুষদের অকাতরে দান করতেন। যদিও উনার মধ্যে সীমাবদ্ধতা ছিল। একজন শিক্ষকের বেতন খুবই নগণ্য। তারপরও তিনি তা থেকে গরিব, দুঃখী, মেহনতি মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতেন। আকাশের উদারতা ও স্বর্গীয় মহত্ত্ব দিয়ে তিনি মানুষের অন্তরে অক্ষয় পদচিহ্ন এঁকে গেছেন। লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, আনোয়ারা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।












