১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরের ১ম অর্ধ্বে পিজি হাসপাতালে আমার ভায়রা ভাই ইঞ্জিনিয়ার ওয়াকিল আহমদ চৌধুরী মেরুদণ্ডে অপারেশন জনিত কারণে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর ছোট ভাই ঢাবি’র শিক্ষার্থী ফারুক আহমদ চৌধুরীসহ তাঁকে দেখতে গিয়ে দেখি হাসপাতালের ভি আই পি কেবিনের সামনে পুলিশ দাঁড়ানো। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ঐ সব কেবিনের একটিতে আছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ মৌলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। অন্যটিতে যিনি আছেন তিনি এককালের আওয়ামীলীগ নেতা, পরবর্তীতে জাতীয় পার্টির ১৯৮৬ সালের গঠিত মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এ কথা শুনে প্রহরারত পুলিশ সদস্যদের বললাম আমরা তাঁর সাথে দেখা করতে চাই। কিন্তু নাহ, তারা আমাদেরকে দেখা করতে দিতে রাজী নয়। তাদের বুঝিয়ে বললাম যে, “আমরা চট্টগ্রাম থেকে এসেছি, ছাত্র রাজনীতি করেছি, ’৬৯-এর গণ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলাম। সুতরাং যেভাবেই হোক আমাকে নেতাদের সাথে দেখা করতেই হবে। পুলিশ ভাইরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করে জানালেন, যে কোন একজনের সাথে দেখা করার জন্য আমাদেরকে অনুমতি দেয়া যেতে পারে। তাও আপনারা চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন বিধায়। আমার সহযোগীর ভিন্নমত সত্ত্বেও আমি তর্কবাগীশ সাহেবের সাথে দেখা করার ইচ্ছা জানালাম।
ভি আই পি কেবিন। ভিতরে মৌলানা সাহেবের জামাতা বসা ছিলেন। তিনি আমাদেরকে স্বাগত জানালেন। ঢুকে দেখি অপরূপ সুন্দর একজন মানুষ। গায়ের রং, দাড়ি, চুল সবই সাদা, যেন স্বর্গীয় দূত। চোয়ালে কোন দাঁত নেই। বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, তিনি আমাদেরকে দেখে খুশী হয়েছেন। আমার দুরু দুরু করে বুক কাঁপছিল। সত্যিই কি আমি বৃটিশ ভারতের মাঠ কাঁপানো একজন রাজনৈতিক নেতা, বঙ্গবন্ধুর পূর্বসূরী তথা মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগের একজন সাবেক সভাপতির সামনে বসার সুযোগ পেলাম! স্বাধীনতা পূর্বে আমার বাবা কতিপয় লোকের সাক্ষাতে বলেছিলেন, “মৌলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে কি আপনারা একজন সাধারণ ‘উলা পাশ’ মৌলানা মনে করেন”? মনে পড়লে শিউরে উঠি। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে মৌঃ আবদুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামীলীগের সভাপতিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। মৌলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ সাহেব সেই থেকে ১৯৬৬ সালের ১৯শে মার্চ বঙ্গবন্ধু দলের পরবর্তী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এই গুরু দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র জনতার উপর পাক বাহিনীর নির্বিচারে গুলি ছোঁড়ার প্রতিবাদে তিনি পাকিস্তান আইন পরিষদে তীব্র বাকবিতণ্ডা করে বেরিয়ে আসেন। সেই থেকে তাঁর মুসলিমলীগ ত্যাগ এবং আওয়ামীলীগে যোগদান।
তাঁর বিনয়ী কোমলভাষী জামাতা একটু উচ্চ অথচ মায়াবী কন্ঠে তাঁকে বললেন, “বাবা, ইনারা চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন, আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান”। বুঝলাম মৌলানা সাহেবের শ্রবণ শক্তি বেশ কিছুটা লোপ পেয়েছে। তিনি ইশারায় সম্মতি প্রকাশের পর আমি সালাম জানিয়ে বললাম, “বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে আপনার অর্থাৎ আপনাদের রাজনীতি চর্চার ভূমিকা আমার কিছুটা জানা আছে। মাঝ পথে আপনাদেরই আওয়ামীলীগের প্রতি আপনার কিছু অভিমানের বিষয় ঘটেছিল। আপনি অনুমতি দিলে সব মিলিয়ে কয়েকটি কথা জানতে চাইব”। তাঁর সম্মতিতে আমি নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলো করেছিলাম –
আমার প্রথম প্রশ্ন ঃ- ইতিহাস পাঠে জানা যায়, ১৪৯৩ খ্রি. বাংলার সোলতান মোজাফাফর হাবসীকে হত্যা করে আলাউদ্দিন হোসাইন শাহ ক্ষমতায় আরোহন করেন। এরপর সোলতান আলাউদ্দিন হোসাইন শাহ তার চারপাশের সংশ্লিষ্ট বক্তিবর্গকে বলে দিলেন “এখন থেকে সব সম্পদ তোমাদের ব্যবহারের জন্য” (ঊাবৎুঃযরহম ড়হ ঃযব ংড়রষ নবষড়হমং ঃড় ুড়ঁ) । এ কথা শুনার পর সবাই এক প্রকার লুটতরাজে লিপ্ত হয়ে নিজেরাই সম্পদশালী হয়ে উঠতে লাগলেন। পরবর্তীতে সোলতান পুনরায় সবাইকে লুটতরাজ করে দেশে বিদেশে সম্পদ নষ্ট না করার জন্য পর পর তিন বার হুঁিশয়ার করে দেন। তা সত্ত্বেও ভাল ফল না পাওয়ায় সোলতান আলাউদ্দিন হোসাইন শাহ বাংলা রাজ্য থেকে ১৪৯৪-৯৫ খৃীঃ প্রায় ২০,০০০ (বিশ হাজার) মানুষ হত্যা করার ইতিহাস আছে। অন্যদিকে আলাউদ্দিন হোসাইন শাহ ইতিহাসে বাংলার শ্রেষ্ঠ সোলতানদের অন্যতম হিসেবেও পরিগনিত। এখন আপনার কাছে আমার প্রশ্ন, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে নানাদিক থেকে এত লুটপাট শুরু হলো, বাংলাদেশের ক্ষতি সাধিত হলো, বঙ্গবন্ধুর ইমেজের মারাত্মক ক্ষতি হলো, এমনকি ঐ ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে তাঁকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। তাহলে বঙ্গবন্ধু রাজ্য শাসনে সেই সফল খ্যাত সুলতান আলাউদ্দিন শাহ’র পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন না কেন ?
এর উত্তরে তিনি এক প্রকার কড়া সুরে আমাকে বললেন, “১৪৯৪ থেকে ১৯৭২ পাঁচ শত বছর ব্যবধানের উভয় পরিবেশকে আপনি একই মানদণ্ডে বিচার করতে পারেন না। একজন সুলতান তখন রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি, তাঁর ইচ্ছায় এবং নির্দেশে রাজ্য পরিচালিত হতো। আর আজকের আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র জনগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধি কিংবা জনগণের সম্মতি ছাড়া কিছু করতে পারে না। অন্তত বঙ্গবন্ধু তা করতে চাননি”।
আমার ২য় প্রশ্নঃ আপনি একজন প্রাজ্ঞ আলেম, আবার অন্যদিকে প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ। আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি.এস.সি-তে মানুষ্য মূর্তির ভাষ্কর্য তৈরী করা হয়েছে। আপনার দৃষ্টিতে এদেশের একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে ?
উত্তরে তিনি বলেন, “মূর্তি আর ভাস্কর্য ভিন্ন জিনিস। পূজা বা আরাধনা করার জন্য কোন ব্যক্তির অবিকল অবয়ব তৈরী করা হলে সেটা হবে মূর্তি। আর জাতীয় বা সমকালীন বা স্থানিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা, ঐতিহ্যকে তুলে ধরা, সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য যে কাঠামো বা নিদর্শন তৈরী করা হয় তা হলো ঝপঁষঢ়ঃঁৎব বা ভাস্কর্য। ইসলামের দৃষ্টিতে এই কাজটি কোনভাবেই আপত্তিজনক হতে পারে না। বিশ্বের অনেক মুসলিম রাষ্ট্রে ভাষ্কর্য নির্মাণ ও সংরক্ষণ করা আছে। এখানেও বীর বাংলার অর্থাৎ বাঙালির বীরত্বের ঐতিহ্য তুলে ধরে আবহমানকাল প্রদর্শনের জন্য অপরাজেয় বাংলা নির্মাণ করা হয়েছে। ঐতিহ্য সমুন্নত রাখার কাজের সাথে ইসলামের সংঘর্ষ থাকার প্রশ্নই আসে না।
আমার ৩য় প্রশ্নঃ যতটুকু জানি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সময় পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রীত্বের পদ ছেড়ে দিয়ে পুনরায় আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে ফিরে আসেন। এতে দলে তাঁর সমসাময়ীক প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিবিদ অলি আহাদ (বর্তমান একাদশ সংসদের বি.এন.পি-র সাংসদ ব্যারিস্টার রুমীন ফারহানার পিতা) নিজেকে প্রত্যাশিত পদ থেকে পদবঞ্চিত মনে করে শেখ মুজিবুর রহমানের কারণে ক্ষোভে দুঃখে আওয়ামীলীগ ছাড়েন। একইভাবে ১৯৬৬ সালে ১৯ শে মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়মীলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। অন্যদিকে সভাপতি হিসেবে আওয়ামীলীগের দুর্দিনের কাণ্ডারী হওয়া সত্ত্বেও (বিনয়ের সাথে বলছি) আপনি সভাপতির পদ না পাওয়ায় কিছুটা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। শেখ মুজিবের সেই দিনের ভূমিকাকে আপনি আজ কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? এবং দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের সায়াহ্নে এসে আপনার দৃষ্টিতে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ ও ‘জাতির পিতা শেখ মুজিব’ কে নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি হতে পারে ?
উত্তরঃ আপনি ঠিকই বলেছেন, যে কোন দলের অভ্যন্তরে কোন্দল উপকোন্দল থাকে। বিশেষ করে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও ব্যতিক্রমধর্মী উত্থান অনেকে মেনে নিতে পারতো না। অপরদিকে তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতাকে অস্বীকার করা কারো পক্ষে সম্ভবও ছিল না। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বরাবরই ঈর্ষণীয় ছিল। সে যখন যে পদে যেভাবে ভূমিকা রেখেছে তা সময়ের নিরীখে তাঁর ঐ কাজটি শ্রেষ্ঠই ছিল। সে একজন অদম্য সাহসী পুরুষ। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মাঠে তাঁর মত বিচক্ষণ যোগ্য রাজনীতিক পাকিস্তানে দ্বিতীয়জন ছিল না। যার জন্য সে বাঙালির একজন নেতা হয়ে উঠেছিল, বাঙালিরা তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছে। আপামর বাঙালিকে একত্রিত করে পাকিস্তানের শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করে দিয়েছে। বাঙালী জাতিকে মহিমান্বিত করেছে। তাই সে বাঙালী জাতির পিতা। এক কথায় সে বাংলা ও বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান।
প্রশ্নঃ বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে সকল স্তরের মানুষদের নিয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক দল (বাকশাল) গঠন করলেন। এটা কি ১৯৭২ সালে করা উচিত ছিল না?
উত্তরঃ শেখ মুজিব অত্যন্ত আবেগ প্রবণ উদার হৃদয়ের মানুষ ছিল। কঠোর শাসন ছাড়া সবাইকে মমতা দিয়ে জাতি গঠনের কাজে নিয়োজিত করতে ছেয়েছিল। কিন্তু দেশবাসী তাকে বুঝতে চায় নাই বা পারে নাই। সেই সুযোগে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ক্রীড়ানক হয়ে কিছু বিপথগামী লোক তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করল। এটা জাতির জন্য চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়।
ফেরার সময় তিনি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমিও পরম মমতায় তাঁর হস্ত স্পর্শে নিজেকে মহিমান্বিত মনে করেছিলাম।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট