দৈনিক আজাদী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র। কিন্তু তার জন্ম বাংলাদেশের জন্মের ১১ বছর ৩ মাস ১১ দিন আগে, অর্থাৎ ১৯৬০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার। এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় লাভের পর ১৭ ডিসেম্বর প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদী। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট তাদের পত্রিকা ‘নিরীক্ষা’ সেপ্টেম্বর–ডিসেম্বর ১৯৯৯ সংখ্যায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী’ শীর্ষক দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে আজাদীকে এই স্বীকৃতি দিয়েছে।
আজাদীতে আমি যুক্ত আছি তিন দশকেরও অধিক সময় ধরে। সেই থেকে এ পর্যন্ত অনেক গুণী সাংবাদিকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সাবেক প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ও বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেকের স্নেহধন্য হওয়ার গৌরব ও আনন্দে আমি অতিক্রম করছি আমার দিনগুলো। এখনো যাঁরা জীবিত আছেন, মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, তাঁরা যেন সুস্থ থাকেন এবং দীর্ঘজীবী হন।
আজকের এই লেখায় আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি তাঁদের, যাঁদের আমরা হারিয়েছি। তাঁরা ছিলেন আমার গুরুস্থানীয়। অনেক কিছু শিখেছি তাঁদের কাছ থেকে। তাঁদের ঋণ কখনো শোধ হওয়ার নয়।
সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা, যা বিশ্বাস করতেন–তা’ই বলতেন। একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ হয়েও আপাদমস্তক তিনি ছিলেন অসামপ্রদায়িক। সব শ্রেণির, সব ধর্মের মানুষের প্রতি তাঁর ছিল মমত্ববোধ। উন্নত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ বলতে যা বোঝায়– অধ্যাপক খালেদ তা’ই। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা তাঁকে মহীরূহ করে তুলেছে, করে তুলেছে সর্বজন শ্রদ্ধেয়।
সাধন কুমার ধর ছিলেন আমাদের বার্তা সম্পাদক। প্রচার মাধ্যমে জীবন কাটিয়েও প্রকৃত প্রচারবিমুখ ব্যক্তি ছিলেন তিনি। সততা, নিয়ম, নীতি ও শৃঙ্খলাকে যিনি আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন সারাটি জীবন। আমাদের পরম শ্রদ্ধার মানুষ, সৎ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তিনি। তাঁর উন্নত মস্তক, চলায়–বলায় ব্যক্তিত্বের স্ফূরণ, জ্ঞানের গভীরতা, সর্বোপরি পাণ্ডিত্যে আমি মোহিত থাকতাম। মুগ্ধ হতাম আন্তরিকতায়, প্রীত হতাম উৎসাহপূর্ণ আলাপে এবং কৃতার্থ হতাম তাঁর কাছ থেকে কিছু শিখে।
বিমলেন্দু বড়ুয়া সেই সাংবাদিকদের একজন, যিনি একটা মিশন নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন সাংবাদিকতায় এবং চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে এ পেশায় ধরে রেখেছিলেন নিজের ব্যক্তিত্ব। তিনি সপ্রাণ ছিলেন সব সময়, স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন, ছিলেন বন্ধুবৎসল। সাংবাদিক হিসেবে তিনি অর্জন করেছেন বিশেষ স্থান। শুধু সাংবাদিক হিসেবে নন, সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি পেয়েছেন সম্মান ও খ্যাতি।
ওবায়দুল হক ছিলেন ডাকসাইটে সাংবাদিক। দৈনিক আজাদীর প্রথম চিফ রিপোর্টার। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন হৃদয়বান, সুন্দর ও উদার মানুষ। ছিলেন একজন রসিক মানুষ। সারাক্ষণই থাকতেন হাসিখুশি। বক্তব্যে আড্ডায় এতটাই প্রাণখোলা ছিলেন, প্রথম সাক্ষাতেই তিনি সবার মন জয় করে নিতেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর মতো জাতীয় ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি। বার্লিন প্রবাসে বই লিখে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।
কাজী জাফরুল ইসলাম ছিলেন এক জাঁদরেল খ্যাতিমান সাংবাদিক। সাংবাদিকতা বিষয়ে পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান গবেষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সাংবাদিকতার নানা ধাপে তাঁর কৃতিত্ব ও প্রয়াস তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরূপে অধিষ্ঠিত করেছে। বোধে, অনুভবে ও পারঙ্গমতায় তিনি ছিলেন সৎ, সাহসী ও নীতিনিষ্ঠ। সাংবাদিকতা বিষয়ে তাঁর রয়েছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।
মোহাম্মদ ইউসুফ এই জনপদে ছিলেন আরেক বাঘা সাংবাদিক। কর্মে, জ্ঞানে, পাণ্ডিত্যে, ব্যক্তিত্বে এক আদর্শবান ও নীতিবান মানুষ। সাংবাদিকতায় অনুসরণীয় পুরুষ। তাঁর সঙ্গে অন্য কারো তুলনা চলে না। তাঁর মতো মানুষ সমাজে বিরল। ছিলেন নির্লোভ, নিরহংকার ও উদার মনের মানুষ। সাধারণ চলাফেরায় অভ্যস্ত ছিলেন বলে তিনি অর্জন করতে পেরেছেন অনেকের ভালোবাসা।
অরুণ দাশগুপ্ত। সৎ সাংবাদিক, নিষ্ঠাবান প্রাবন্ধিক, মেধাবী গবেষক, বিরলপ্রজ কবি ও গুণী সাহিত্য সম্পাদক। জ্ঞানে পাণ্ডিত্যে অভিজ্ঞতায় একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব। সৃজনশীল ও মননশীল জগতের একজন অনুকরণীয় পুরুষ। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাস, ঐতিহ্য– এমন কোনো দিক নেই যে তিনি জানতেন না। সব বিষয়ে ছিলো সমান অবগত ও আগ্রহ। লেখক হিসেবে তিনি যতটা খ্যাতিমান, এ জনপদে লেখকের পরিচর্যায় তিনি ছিলেন ততটা উদার। লেখকদের প্রাণিত করতে এবং লেখায় নিবেদিত কর্মীদের উৎসাহিত করতে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। চট্টগ্রামে একটি ‘সাহিত্যমানসম্পন্ন সমাজ’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসামান্য।
তফজল আহমদ ছিলেন অত্যন্ত উপকারী এক সাংবাদিক। আজাদী ইউনিটের প্রধান হিসেবে যতদিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন, ততদিন শুধু নয়; সবসময় সহকর্মীদের ভালো–মন্দ খবর রাখতেন। নিজে শ্রদ্ধেয় এম এ মালেকের বন্ধু হলেও কখনো তাঁর মধ্যে অহমিকা দেখিনি। আজাদী প্রতিষ্ঠার পর যখন ছোটোদের পাতা ‘আগামীদের আসর’ চালু হয়, তখন কিছুদিন তিনি এই বিভাগটি দেখেছিলেন। তিনি ছিলেন বন্ধু বৎসল, প্রাণোচ্ছল। উঁচু মনের এই মানুষটি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের অনেকের স্থানীয় অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
সিদ্দিক আহমেদ ছিলেন এক বহুমাত্রিক মানুষ। সৎ সাংবাদিক হিসেবে, পরিশ্রমী প্রাবন্ধিক হিসেবে, বিশ্বস্ত অনুবাদক হিসেবে এবং নীতিবান শিক্ষক হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল সর্বব্যাপী। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি পরিণত হয়েছিলেন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে। পরিবারের বাইরে আত্মীয় স্বজনের সীমানা ছাড়িয়ে নিজের সমাজের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি জননন্দিত হয়েছেন তাঁর কর্মে ও সৃজনশক্তির গুণে। যতোটা তিনি জানতেন, ধারণ করতেন, ততোটা জাহির করতেন না। অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, মনে হয়, সেটাই ছিলো তাঁর অসাধারণত্ব। মানুষকে বড় করে দেখা ছিলো তাঁর এক বিশেষ গুণ।
ওসমানুল হক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কখনো সুবিধা নেননি। ছিলেন অত্যন্ত ত্বরিৎকর্মা। দ্রুত প্রতিবেদন তৈরি করা, এডিট করা, চোখা ক্যাপশন লেখায় তাঁর জুড়ি ছিল না। নবীন সহকর্মীর জন্য তিনি ছিলেন প্রেরণার উৎস।
মোস্তফা কামাল পাশা ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলাম লেখক। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অস্থির প্রকৃতির। তবে ছিলেন স্পষ্টবাদী, সাহসী, নির্ভীক, অকুণ্ঠ মেধার অধিকারী। মনের কথাগুলো অকপটে বলতেন, কোনো রাখঢাক থাকতো না। অপ্রিয় সত্য উচ্চারণে ছিলেন নির্মোহ। পরোয়া করতেন না তার পরিণামের। ক্ষমতালোভী, তেলবাজ, ধান্দাবাজ, সুবিধাবাদী চরিত্রের মানুষগুলোর পোস্টমর্টেম লক্ষ করতাম তাঁর লেখাগুলোতে।
সুখেন্দু ভট্টাচার্য ছিলেন এক নির্বিবাদী সাংবাদিক। আমার তৈরি সংবাদ তিনি দেখতেন। ত্রুটি থাকলে শুদ্ধ করে দিতেন। বেশি ওলটপালট হলে তিনি নিজেই সংবাদ তৈরি করে আমারটার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে বলতেন। বড় হৃদয়বান মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর আরেক গুণ– তিনি ছিলেন নাটক–অন্তপ্রাণ মানুষ। নাট্যজন হিসেবে তাঁর পরিচিতি ও খ্যাতি ছিল।
হেলাল উদ্দিন চৌধুরী আরেক সৎ সাংবাদিক। ছিলেন আজাদীর চিফ রিপোর্টার। আজাদী থেকে অন্যত্র চলে গিয়েও আজাদী পরিবারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। নিয়মিত আসতেন আজাদীতে, লিখতেনও। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগেও তাঁর কলাম প্রকাশিত হয়েছে এখানে।
যে কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে এখানে ছোটো করে লিখলাম, তা কেবল শ্রদ্ধা নিবেদনস্বরূপ। তাঁরা এখন আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আমাদের সামনে আছে তাঁদের আদর্শ। আমরা তাঁদের নৈতিকতার ছায়ায় আছি। বিশাল উন্নত চরিত্রের এই মানুষগুলো আমাদের এখনো পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন, এগিয়ে নিচ্ছেন। লোভ–লালসার ঊর্ধ্বে থেকে সৎ ও নিষ্ঠাবান থাকার প্রেরণা দিচ্ছেন। আবারও বলি, আমরা নিয়মিত তাঁদের স্মরণ করি, তাঁদের স্বচ্ছ ও মুক্ত চিন্তার কথা মনে করি, আমরা ভাবি তাঁদের সাহস ও সৌন্দর্যের কথা, মানবিক মূল্যবোধ ও কর্মকৃতির কথা। আমরা উজ্জীবিত হই। আমরা এগিয়ে চলার উৎসাহ পাই। আমরা নির্লোভ জীবন সাধনায় ব্রতী হওয়ার প্রেরণা পাই।
[পুনশ্চ : আমি যাঁদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, এই লেখায় কেবল তাঁদের স্মরণ করার চেষ্টা করেছি। ১৯৯১–এর আগে অনেক গুণী সাংবাদিক কাজ করেছেন আজাদীতে, তাঁদের সান্নিধ্য পেলে নিজে ধন্য হতাম।]
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর–৪২২), বাংলা একাডেমি।