ইদানীং আদর্শ শিক্ষকের বড় খরা চলছে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিদ্দিক আহমদ মাস্টার এক্ষেত্রে একজন যথার্থই স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। এক কথায় শিক্ষাঙ্গনে তিনি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা, সমাজ অঙ্গনে একজন আলোর দিশারী। শিক্ষকতা মানুষ গড়ার পেশা। তিনি সেটাই জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নেন এবং তাতে তিনি হয়েছেন সম্পূর্ণ সফলকাম।
তিনি আমাদের জাতীয় জীবনের তিনটি আমলকে দেখেছেন– বৃটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ আমল। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন তথা শেষ অবধি নিয়োজিত ছিলেন একান্ত আন্তরিকতার বাহনে। তিনি দলইনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান শিক্ষক। আদর্শ শিক্ষক হওয়ায় ছাত্র/ছাত্রীদের আপন ছেলে মেয়ে হিসেবে মনে স্থান দিয়ে আদর সোহাগে শিক্ষা দান করতেন বিধায় কোন পক্ষ থেকে তাঁর ব্যাপারে কোন অভিযোগ ছিল না। সরকারি চাকুরি ট্রান্সফার একটি রুটিন। কিন্তু অভিভাবকরা তাঁর ট্রান্সফারের পক্ষে ছিলেন না। শুনেছি তাই মরহুম জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেবের স্নেহ ছায়ায় বদলিও হননি কোনদিন। শুধু এ পেশায় নয়, সমাজ জীবনের নানা অঙ্গনেও তাঁর সরব বিচরণ ছিল। তাঁর মধ্যে প্রবল আত্মবিশ্বাস সকল সময়ে কার্যকরী ছিল। তাঁর মধ্যে এ মানসিক সাহস ছিল যে, সামাজিক মানুষ হিসেবে তাঁর চিন্তাধারা ও কর্মদক্ষতাকে একটি আলোক ধারাতে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নিজগ্রাম দলইনগরের পটে প্রাথমিক বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে তিনি সামাজিক সংযোগসহ সকল প্রেক্ষিতে বিস্তারিত থেকেছেন। সৌভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠার প্রতি তাঁর বিশেষ লক্ষ্য ছিল। সেই সৌভ্রাতৃত্ববোধ জনগণের সামাজিক শৃঙ্খলা, একতা ও বিশ্বাসকে তিনি এগিয়ে যাবার প্রেরণা হিসেবে উপস্থাপিত করার প্রয়াসী ছিলেন। তিনি সফলকাম হয়েছিলেন বলেই মৃত্যুর পরও তাঁকে স্মরণ করার প্রয়োজন থাকছে। কারণ তাঁর জীবনকাল থেকে আমরা সুস্থ, সামাজিক জীবনের প্রেক্ষাপট নিতে পারি। বলা আবশ্যক আমি গহিরা উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য পদের জন্য পাঁচবারের মত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম। শুধু চাইতাম দোয়া। তিনি সরল ভাষায় শুধু বলতেন তোমার জন্য দোয়া আছে, দোয়া থাকবে। এমনতর অনুপম চরিত্র, শিক্ষাঙ্গনে ও সমাজ জীবনে বিভিন্ন পরিসরে অবদান দৃষ্টান্ত আমাদের আগত বংশধরদের অনুরূপ জীবন গঠনে অনুকরণীয় অনুসরণীয় পথ নির্দেশিকা হতে পারে।
তিনি ছিলেন সাধারণ জনগণের কাছের মানুষ। তাঁর স্বগ্রামের দলইনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ছিদ্দিক মাস্টারের স্কুল হিসেবে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে। সর্বশ্রেণীর লোকজনের সাথে তাঁর মেলামেশা ছিল। ঐ গুণটি সকলের মধ্যে থাকে না। এ ধরনের লোক বর্তমানে বিরল। তিনি একটি গতিবান কর্মময় জীবন যাপন করে গেছেন। তিনি স্বধর্মনিষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে কোনরূপ গোঁড়ামি ছিল না। কায়িক পরিশ্রমের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। বৃহত্তর পরিমন্ডলে তিনি রাজনীতির জনসেবার দিকটিকে সঙ্গ দিয়েছেন। নিজের সাধ্য সাপেক্ষ বিভিন্ন Village Aids programme কে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সর্বাংশে তাঁর মধ্যে আমরা নৈর্বক্তিক মননশীলতাকে পেয়েছি। তিনি দলইনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছাড়াও গহিরা শান্তির দ্বীপ কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি ও ব্যাংক লিঃ এর চেয়ারম্যান ও তৎকালীন গহিরা ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ছিদ্দিক আহমদ মাস্টার একজন আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন। রাউজানের গহিরা ইউনিয়নের দলইনগর গ্রামে খন্দকার হামিদ আলী মুন্সির বাড়ী মোহাব্বত আলী’র ওরসে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর কোনো ভাই–বোন ছিল না। গ্রামের জায়গা–জমির উৎস থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে সংসার চলতো। তাঁকে সমাজের একজন অপরিহার্য ব্যক্তি হিসেবে সমাজ গ্রহণ করেছে। বিজ্ঞজনেরা তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের আসনে স্থান দিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত পরিস্কার–পরিচ্ছন্নভাবে চলাফেরা করতেন।
৩ রমজান, ১৪২২ হিজরী ইফতারের সময় ছিদ্দিক আহমদ মাস্টার ৯৯ বছর বয়সে অনেকটা সুস্থ অবস্থায় সকল কর্মমায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা তাঁর পবিত্র স্মৃতিকে পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
লেখক: সাবেক সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।