স্মরণকালের ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী অগ্নিকাণ্ড

ডা. দুলাল দাশ | বৃহস্পতিবার , ১৬ জুন, ২০২২ at ৮:৪৯ পূর্বাহ্ণ

সীতাকুণ্ডের বি.এম কনটেইনার ডিপোতে স্মরণ কালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হাসপাতালে লাশের মিছিল ও আহতদের আর্তনাদ বিশ্ববাসী দেখেছে। চোর চুরি করলে কিছু হলেও অবশিষ্ট থাকে কিন্তু আগুন লাগলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। সব ছাঁই হয়ে যায়। তাতে থাকে প্রাণহানির আশঙ্কা। সম্প্রতি এমনি একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ডে ‘বি. এম ডিপো’ নামক একটি প্রাইভেট কনটেইনার ডিপোতে। এই অগ্নিকাণ্ডে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। তদন্তে দেখা গেল ‘হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড নামক রাসায়ানিক পদার্থে ভর্তি ছিল ৩৭টি কনটেইনার (তদন্ত রিপোর্ট) যেগুলো আগুনের সংস্পর্শে এসে ভয়ানকভাবে বিস্ফোরিত হয়।

আগুনের বিস্তৃতি এতই ছিল যে আশেপাশের পাড়াগুলোর বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিস্ফোরণ ৫ কিঃমিঃ পর্যন্ত অনুভূত হয়। ইহার ব্যাপকতা এতই ছিল যে আগুন নিভাতে ৯০ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। অদ্যাবধি কনটেইনার উদ্ধার করতে গেলে ধোয়া বের হয়। এই কেমিক্যাল মিশ্রিত ধোঁয়ায় গ্রামের মানুষদের শ্বাসকষ্ট ও শরীরের চামড়ার জ্বালা করার কারণ। এই কারণে অনেকেই তাদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। খুবই মর্মান্তিক যে এই আগুন নিভাতে গিয়ে এই পর্যন্ত ১০ জন অগ্নিনির্বাপক নিবেদিত কর্মীর জীবনাবসান হয়। ফাইয়ার সার্ভিসের এতগুলো লোকের মৃত্যু খুবই হৃদয়বিদারক ও একটা বিরল ঘটনা। দেশবাসী খুবই অনুতপ্ত। এই অগ্নিকাণ্ডে সরকারি হিসাবে আজ পর্যন্ত সর্বমোট মারা গেছে ৪৭ জন। ২০০ জনের উপর আহত হয়েছে এবং তারা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল, কিছু প্রাইভেট ক্লিনিক সহ বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসাধীন আছেন। বেশ কিছু জটিল বার্ন রোগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারী ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে। ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকা বার্ন ইউনিট হাসপাতালের প্রধান ডা. শামন্তলাল ও তাঁর টিম চট্টগ্রাম মেডিক্যাল হাসপাতাল পরিদর্শন করে গেছেন। ডা. শামন্তলাল বলেন যাদের শ্বাস নালীতে দাহ হয়েছে তারা সবাই শংকা মুক্ত নয়। ফায়ার যোদ্ধারা মারা যাওয়ার পিছনে কারণ ছিল তারা প্রথমে মনে করেছিল অন্যান্য অগ্নিদুর্ঘটনার মত। তাই তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগুন নিভাতে ঝাপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ৪০ মিনিট পর যখন বিস্ফোরণ ঘটল তখন তারা দিশেহারা হয়ে গেল।

কারণ মালিকপক্ষ তথ্য গোপন করে বলেছিল কনটেইনারে শুধু তৈরী পোশাক ছিল। কিন্তু পরে তদন্ত রিপোর্টে দেখা গেল ৩৭টি কনটেইনারে মজুত ছিল হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড কেমিক্যাল। পরবর্তীতে এও জানা গেল এই গুলির কোনো অনুমোদন ছিল না। সাধারণত কেমিক্যালের এই আগুন নির্বাপণ করতে ফোম, পাউডার বা কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহার করতে হয়। পানিতে আগুন আরও বেড়ে যায়। কারণ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড নিজে দাহ্য নয়। কিন্তু এটা উৎকৃষ্ট জারক। আগুনের সংস্পর্শে এসে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড জ্বলতে জ্বলতে তাপমাত্রা ১৫০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গিয়ে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ভেঙ্গে অক্সিজেন ও পানি তৈরি হয়। এখন এই অক্সিজেন (O2) প্রচণ্ড দহন বিক্রিয়া শুরু করে ও প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায়। সেদিন সীতাকুণ্ডে এটাই ঘটেছিল। যারা আগুনে পুড়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় দগ্ধ হয়েছে এবং চিকিৎসায় আছেন তাদের কারো কারো চোখের ক্ষতি হয়েছে এবং তাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পাঠানো হয়েছে। মনে রাখতে হবে আগুনে পুড়ে যাওয়া ক্ষত সহজে নিরাময় যোগ্য নয়। এমনকি দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে যেতে পারে। আর যাদের হাত, পা, গলা, বুকের অংশ পুড়েছে তাদের সুস্থপরবর্তী সময়ে ডাক্তারী ভাষায় ‘পোস্ট বার্ন কনট্রাকচার’ হতে পারে। অর্থাৎ লেগে যাওয়া, বাঁকা হওয়া প্রভৃতি। সারা জীবনের জন্য এই অঙ্গগুলি পূর্বের নিয়মে ফিরে নাও আসতে পারে। বিকলাঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। ঘাড় নাড়তে পারে না। হাত পা স্বাভাবিক ভাবে মেলতে পারে না। জয়েন্টগুলি শক্ত হয়ে যায়।

২০১০ সালে ৩ জুন ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যাল গুদামে অগ্নিকাণ্ডে ১২৩ জন লোক প্রাণ হারায়। চুড়ি হাট্টার ঘটনা সবার মনে আছে। কিছুদিন আগে সুগন্দা নদীতে কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে ৩৮ যাত্রীর মৃত্যু হয়। আমরা আরো দেখেছি তাজরীন গার্মেন্টস আগ্নিকাণ্ড, সাভারের রানা প্লাজা ধস, চকবাজার অগ্নিকাণ্ড। প্রতিটি ঘটনায় ফাইয়ার যোদ্ধারা আগুন প্রতিরোধী ব্যবস্থার অপ্রতুলতা সত্ত্বেও জীবন প্রাণ বাজি রেখে অগ্নিনির্বাপণে ঝাপিয়ে পড়েন। নিমতলীর ঘটনা এক যুগ পার হয়ে গেছে। কিন্তু গড়ে উঠেনি অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা, বাড়েনি কর্মদক্ষতা, বাড়েনি জনবল ও সক্ষমতা। অগ্নিদুঘটনা নিয়ন্ত্রণে বর্তমান অত্যাধুনিক শহরগুলিতে সব চেয়ে কার্যকরী পন্থা হলো ফায়ার হাইড্রেন্ট। অর্থাৎ যেখান থেকে দুর্ঘটনা চলাকালে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। বর্তমানে দেশে ৪৮৯টি ফায়ার স্টেশন আছে। তবে জনবল মাত্র ১৩৫০০ শত অথচ জার্মানিতে ৯ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে অগ্নিনির্বাপক কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ। আমাদের দেশে বিল্ডিং নির্মাণের সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রাখা হয় না। ঘন ঘন ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা দেশের আর্থিক এবং অবকাঠামোগত ক্ষতির কারণ। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা কর্তৃক অনুসন্ধান টিম গঠিত হয়েছে। সেখানে বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন কাজ করছেন শীঘ্রই জানা যাবে ক্ষতির পরিমাণ এবং এটা আদো দুর্ঘটনা না আত্মঘাতি কিছু ছিল কিনা। ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানা যায় গত দশ বছরে দেশে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৮টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।

নিহতের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার এবং আর্থিক ক্ষতি ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এখানে উল্লেখ্য আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা প্রণীত ‘আই.এম.ডি.জি’ কোড অনুযায়ী জাহাজে পরিবহনের জন্য বিপজ্জনক পণ্যের নয়টি শ্রেণী রয়েছে। সমুদ্র পথে জাহাজ পরিবহনের জন্য- লেভেলিং, প্যাকেজিং, মারকিং, লোডিং-আনলোডিং ইত্যাদি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। সীতাকুণ্ডের ঘটনা তদন্তে দেখা যায় কিছুই মানা হয় নি। বড়ই দুঃখের সাথে বলতে হয় এই অনিয়মগুলি উদঘাটিত হয় যখন ঘটনা ঘটে যায় ও অনেক নিরীহ লোকের প্রাণহানী ঘটে। প্রতিটি ঘটনা পর্যালোচনা করলে বেরিয়ে আসে কারো না কারো অবহেলা জনিত কারণ। সেটা হোক ডিপার্টমেন্টেল দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অতি মুনাফা, ফাঁকি দেওয়া প্রভৃতি। ঘটনা ঘটে যায়, সম্পদ-মানুষ হারিয়ে যায়, তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, অনেক কিছুর প্রতিশ্রুতি আসে। কিছুদিন যেতে না যেতেই সব বিস্মৃতির অতল তলে হারিয়ে যায়। পরবর্তীতে কেউ আর খোঁজ খবর নেয় না। আবার ঘটলে আবার তোলপাড় শুরু হয়। এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যার গেছে বা যার হারিয়ে গেছে তার শতভাগ গেছে।

অভিযোগ উঠেছে সেইসময় লোকজনকে নিরাপদ অশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয় নি, গেইট তালাবদ্ধ থাকায় অনেক লোক বাহির হতে পারেনি। অতি উৎসাহি কিছু লোক লাইভ ভিডিও প্রচার করার সময় বিস্ফেরণে প্রাণ দিতে হয়েছে।

ভবিষ্যতে ইনল্যাণ্ড কনটেইনার ডিপোতে যাতে এ ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে তার জন্য প্রশিক্ষিত লোকবল নিয়োগ ও বিশেষ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করা জরুরি। দাহ্য পদার্থ বহন এবং মজুত সংক্রান্ত প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রিন্ট ইলেকট্রেনিক মিডিয়া প্রচারণা, সেমিনার এবং কর্মশালার মাধ্যমে অগ্নিনিরাপত্তায় সচেতনতা বাড়াতে হবে ও দুর্ঘটনায় নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থায় জনগণকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। প্রমাণ সাপেক্ষে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা দরকার।

লেখক : প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাগারাগি করা বা উত্তেজিত হওয়া ক্ষতিকর
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল