জনরোষ আর সশস্ত্র বিদ্রোহের মুখে সিরিয়ার ‘স্বৈরশাসক’ প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। দীর্ঘ দুই যুগের প্রেসিডেন্ট আসাদ গতকাল রোববার দেশ ছেড়েছেন ‘অজানা গন্তব্যে’। ফলে সিরিয়া এখন ‘মুক্ত’ বলে ঘোষণা করেছেন দেশটির বিদ্রোহীরা। বিদ্রোহী যোদ্ধারা দামেস্কের কেন্দ্রস্থলে প্রবেশের পর আরব দেশটিতে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে জানিয়ে প্রবাসী সিরিয়ানদের দেশে ফেরার আহ্বান জানিয়েছে। বিদ্রোহীরা বলছে, আসাদ সরকারের নিপীড়নের শিকার শত শত মানুষ যারা কারাবন্দি ও বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন তারা এখন নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরতে পারেন।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর দাবি, এক প্রকার বিনা বাধায় রাজধানী দখল করে নেন বিদ্রোহীরা। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি সরকার। বিদ্রোহের ফলে দেশ জুড়ে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। গতকাল সকালেও সিরিয়ার সেনা দাবি করেছিল, বেশি কিছু অঞ্চলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ জারি রয়েছে। হামা, হোমস এবং ডেরায় বিদ্রোহীদের ঠেকানোর চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেছিল সেনা। কিন্তু তারপর থেকে সেনার তরফে আর কোনও বিবৃতি পাওয়া যায়নি। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা দ্যা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (এসওএইচআর) খবর দিয়েছে, সিরিয়ার সেনাবাহিনী ও অন্য নিরাপত্তা বাহিনীর শত শত সদস্য তাদের সামরিক পোশাক খুলে ফেলেছে। এর আগে তাদের বলা হয়েছে যে সরকারের পতন হয়েছে এবং তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট আসাদ পালিয়ে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ঢুকে ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছে জনতা। ওদিকে, আসাদের পতনে কেবল সিরিয়াতেই নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও সিরীয়রা উল্লাসে ফেটে পড়েছে। আসাদের পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই দামেস্কের রাজপথে নেমে উল্লাসে মেতে ওঠে সিরিয়াবাসী। এর মধ্যেই দলে দলে মানুষ আসাদের প্রাসাদে ঢুকে প্রায় সবই লুট করে নিয়ে গেছে। তছনছ করে দিয়েছে গোটা ভবন। লুটপাট চালানো এই মানুষদের বেশির ভাগই এসেছে গ্রামাঞ্চল থেকে। তারা প্রতিশোধের আগুন নিয়ে প্রসাদের দিকে ছুটে যাচ্ছে। আর সেখানে ঢুকতে পেরে আনন্দে ফেটে পড়ছে। ভেতরের পরিস্থিতি খুবই বিশৃঙ্খল। মানুষজন ভেতরে যাচ্ছে। হাতে করে যা পারে তাই–ই নিয়ে যাচ্ছে। আবার জিনিস নিয়ে যাওয়ার সময় ছবিও তুলছে। আসাদ ও তার বাবার বছরের পর বছরের নিপীড়নমূলক শাসনের প্রতিশোধই এভাবে নিচ্ছে তারা।
বিদ্রোহী যোদ্ধারা যখন রাজধানী দামেস্কে ঢুকছিল, ঠিক তখন ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে দেশ থেকে পালিয়ে যান সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ। টানা ২৪ বছর সিরিয়ার ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে আসাদ পরিবারের দীর্ঘ শাসনের অবসান হয়েছে। দামেস্কের আগে আলেপ্পো, হামা ও হোমস নগরীর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল বিদ্রোহীরা। আসাদের পতনের জেরে গতকাল খুশিতে রাস্তায় নেমে আসে সিরীয়রা। সেনাবাহিনীর ট্যাংকের ওপর উঠে উল্লাস করেন অনেকে। বিদ্রোহী যোদ্ধাদের সঙ্গে উল্লাসে মাতে সাধারণ মানুষ। সিরিয়ার বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও সিরীয়রা এই উল্লাসে একাত্মতা প্রকাশ করে রাস্তায় নেমেছে। বার্লিনে হাজার হাজার সিরিয়ান রাস্তায় নেমে নগরীর বিভিন্ন স্থানে পতাকা উড়িয়ে উল্লাস করেছে। তুরস্কের ইস্তম্বুলেও সিরীয়রা ‘সিরিয়ার বিপ্লবের সঙ্গে একাত্মতা’ প্রকাশ করে রাস্তায় নেমে উল্লাস করেছে। একই দৃশ্য দেখা গেছে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে, লেবাননের রাজধানী বৈরুতেও।
এদিকে, রাজধানীর সবচেয়ে বড় কারাগার সেদনায়া থেকে হাজার হাজার বন্দিকে মুক্ত করেছে বিদ্রোহীরা। সিরিয়া বিভিন্ন শহর থেকে হেজবুল্লাহ বাহিনী তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করেছে। সিরিয়ার বিদ্রোহী নেতা আহমেদ আল–শাহা জানিয়েছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত ‘প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী’ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দেখভাল করবেন। ঘটনাচক্রে গতকাল রোববার সকালে আসাদ রাজধানী ছাড়ার পরে প্রধানমন্ত্রী জালালি জানান, বিদ্রোহীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে প্রস্তুত বাশারের সরকার। তবে তিনি চান, বিষয়টি শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হোক।