গেল কয়েকদিনে করোনার যে চিত্র বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, তাতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে লোকজন। গত পাঁচ দিনের মাথায় মৃত্যু এবং আক্রান্তের সংখ্যার এত বড় উল্লম্ফন আগে দেখেনি বাংলাদেশ। চলছে লকডাউন। তবু রাস্তা-ঘাট বা দোকানপাটে মানুষের অপ্রয়োজনে যাতায়াত রোধ করা যাচ্ছে না।
সামাজিক দূরত্ব বজায়সহ করোনা প্রতিরোধের অন্যান্য বিধিনিষেধ মানার বিষয়ে যদি আমরা নিজেরা সচেতন না হই, তাহলে নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো দশা হবে। আমরা লক্ষ্য করছি, বেশিরভাগ মানুষই অসচেতন। অধিকাংশ জনবহুল এলাকায় মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। অথচ সারাবিশ্বেই করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই এই জনবহুল এলাকাগুলো নিয়েই বেশি শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। এরপরও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা তো দূরের কথা, মাস্ক পরতেও অনীহা দেখা যাচ্ছে অনেকের মধ্যে। বিভিন্ন জায়গায় ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ লিখে রাখা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা স্রেফ লোক দেখানোর চেয়ে বড় কোনো ভূমিকা রাখছে না। কাঁচা বাজারগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি নেই বললেই চলে। অনেকেই মাস্ক পরলেও তা রাখছেন থুতনির নিচে। হাঁচি-কাঁশিও দিচ্ছেন প্রকাশ্য জনবহুল স্থানেই। অনেককে মাস্ক খুলে হাঁচি দিয়ে আবার মাস্ক পরতেও দেখা যায়। যার ফলে তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি।
এদিকে, দেশে মহামারি করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ অবস্থায় চলমান ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ আরও এক সপ্তাহ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সরকারের কাছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি এই প্রস্তাব দিয়েছে। তবে সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। তবে চলমান এই কঠোর লকডাউন আরও বাড়ানো হবে কি না, সে বিষয়ে আগামী ১৯ এপ্রিল সিদ্ধান্ত জানা যাবে। শনিবার জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির একজন সদস্য গণমাধ্যমকে বলেন, করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু কমছে না। তাই আরও এক সপ্তাহ সর্বাত্মক লকডাউন রাখার পরামর্শ দিয়ে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সরকারের কাছে। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক থাকায় চলমান লকডাউন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে এ বিষয়ে সোমবার সভা ডাকা হয়েছে। সেখানেই লকডাউনের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে।
প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে এবার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ বেশি তীব্র। মধ্যে কয়েক মাস ধরে শনাক্তের চেয়ে সুস্থ বেশি হওয়ায় দেশে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা কমে আসছিল। কিন্তু মার্চ থেকে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যাও আবার বাড়তে শুরু করেছে। গত বছরে এত মৃত্যুর সংখ্যা দেখেনি দেশ। তবে এ বছরই আক্রান্ত ও মৃত্যু রেকর্ড হারে বাড়তে থাকে।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় রোগীদের পোহাতে হচ্ছে চরম ভোগান্তি। নগরের কোনো হাসপাতালেই শয্যা খালি নেই। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল ঘুরেও গুরুতর অসুস্থরা আইসিইউ দূরের কথা, সাধারণ শয্যাও পাচ্ছেন না। এ এক গুরুতর পরিস্থিতি। ওদিকে নমুনা পরীক্ষা করাতে গিয়েও ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। হাসপাতালে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও পরীক্ষা করাতে না পেরে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন অনেকে। সমস্যার যেন কোনো অন্ত নেই। লকডাউনে সড়কে যানবাহন কম থাকায় করোনা রোগী ও তাদের স্বজনদের হাসপাতালে যেতে পড়তে হচ্ছে চরম বিড়ম্বনায়।
আক্রান্তের হার হ্রাস করার লক্ষ্যে সরকারের ‘লকডাউন’ ঘোষণা ছিল যৌক্তিক। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন ‘লকডাউন’ ও ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এটা কেউ মানতে চাইছে না। এত মৃত্যুর পরও মানুষের সচেতনতা বাড়েনি। মানুষ কোনো নির্দেশই মানতে চাইছে না। গাদাগাদি করে চলাচল করা যেন স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্য দিয়ে যে সংকট শুরু হয়েছে, তা দ্রুত শেষ হয়ে যাবে মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিতে হবে। সেই প্রস্তুতি বাংলাদেশ কতটুকু নিতে পেরেছে, নিশ্চিত নই। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউ যখন ইউরোপে আঘাত করেছে, তখন আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত তারা কতটুকু সচেতন ছিলেন, তা বলতে পারব না। আমাদের বিশেষায়িত রোগের জন্য চিকিৎসক, দক্ষ নার্স ও টেকনিশিয়ান দরকার। হাসপাতালগুলোতে ‘ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ’ বাড়ানো দরকার। করোনার ভয়াবহতা মোকাবেলার প্রস্তুতি রাখতেই হবে সরকারকে।