স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি কারা করে? স্বাস্থ্যখাতের বড় বড় প্রকল্পগুলো সাধারণত মন্ত্রী পরিষদ সদস্যরা নীতিনির্ধারনীতে থেকে পাশ করে দেন। কিন্তু প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসাবে বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকেন সচিবরা যাদের হাত দিয়ে বড় বড় দুর্নীতি হয়। আজ পর্যন্ত একটি নজিরও নেই যে একজন প্রকল্প পরিচালক বা একজন সচিব যার দায়িত্বে অবহেলার জন্য দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি হয়েছে। কারণ আমাদের আমলাতন্ত্র এতো শক্তিশালী যে তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকেন।
স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন কেন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে? (ক) স্বাস্থ্যখাতের কর্মকর্তাদের মধ্যে আমলাতান্ত্রিক সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্স মনোভাবের প্রাধান্য থাকা এবং পেশাদার মনোভাবের অভাব থাকা ঃ বাংলাদেশে ক্যাডার সৃষ্টির শুরু থেকে সচিবালয় ক্যাডার ও প্রশাসন ক্যাডার সবচেয়ে প্রভাবশালী ক্যাডারে পরিনত হয়। সচিবালয়ে সরকারের সহকারী সচিব থেকে সচিব এবং সমমর্যাদার প্রায় সবকয়টি পদ একচেটিয়া প্রশাসন ক্যাডারের দখলে যায়। একটি ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডার হিসাবে আখ্যায়িত করার অর্থ হলো অন্য কোনো ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রশাসনিক কাজের সংগে যুক্ত নন বা বাকী ২৮টি ক্যাডারে কোনো প্রশাসন ও প্রশাসনিক কাজ নেই। অথচ অন্য ২৮টি ক্যাডার স্ব স্ব কর্মস্থলে অবশ্যই প্রশাসনিক কাজ করে থাকেন। উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের পরিচালনায় প্রশাসন ক্যাডারের সচিব বা অতিরিক্ত সচিবদের বসিয়ে দেয়া হয়। অচিকিৎসক এই সচিবদের মধ্যে স্বাস্থ্যখাতের বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকাতে তাঁরা পেশাদারী মনোভাবের থেকেও আমলাতান্ত্রিক খবরদারীর মাধ্যমে কাজ চালাতে আগ্রহী থাকেন। ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ সম্পর্কে টেকনিকেল ধারনা বিহীন একজন যদি ইঞ্জিনিয়ারকে শিখান কি করে তার কাজ করতে হবে কিংবা ডাক্তারকে যদি একজন নন–ডাক্তার শিখান কিভাবে তার কাজ করতে হবে সেটা যেমন অবাস্তব তেমনি অপমানজনক। এর ফলে উন্নয়ন কার্য ব্যাহত হয়। (খ) মাঠ পর্যায়ে আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা না থাকাঃ একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় কোটি টাকার বাৎসরিক বাজেট থাকলেও এই টাকা খরচ করার সামর্থ্য কমপ্লেক্সের থাকে না। একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্স–রে যন্ত্র, আলট্রাসাউন্ড যন্ত্র, ইসিজি মেশিন ইত্যাদি থাকে। এগুলো নষ্ট হলে মাত্র পাঁচ হাজার টাকার মেরামতি কাজের জন্যও ফাইল তৈরী হয়। সে ফাইল উপরে গিয়ে আটকে থাকে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতার কারণে। এভাবে বছর গড়ায়। রোগীরা, চিকিৎসকরা ভুগতে থাকেন। (গ) আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতার কারণে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হয়: বিগত ২০২০–২১ অর্থবছরে জরুরি কোভিড–১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় যেখানে ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ অব্যবহৃত ছিল, সেখানে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার অভাবে রোগী মারা গেছেন বেশুমার। সে সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ পাওযার পরেও দেশজুড়ে অসুস্থ মানুষ অবর্ণনীয় কষ্ট পেয়েছিল। সে সময় গবেষণার জন্য বরাদ্দ করা ১০০ কোটি টাকা অব্যবহৃত ছিল, কারণ আমলারা গবেষণা প্রক্রিয়ার বিষয়ে একমত হতে পারছিলেন না। অভিষ্ট লক্ষ্যকে কিভাবে প্রক্রিয়ার কাছে হেনস্তা হতে হয় এটা ছিল তার একটি উজ্বল উদাহরণ। (ঘ) আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বিএমআরসি দেশের স্বাস্থ্য গবেষণায় কোনো অবদান রাখতে পারছে না: বিএমআরসি বা বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল হচ্ছে দেশের স্বাস্থ্য গবেষণায় অগ্রাধিকার ক্ষেত্রগুলো নির্ধারণ ও সহজতর করার বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা। ২০২১–২২ অর্থবছরের বাজেটে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। স্বাস্থ্যখাতে গবেষণা তহবিল সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির একটি সূত্র মতে, ৬০০ টিরও বেশি গবেষণা প্রস্তাব জমা দেয়া হয়েছিল সেবারে। প্রস্তাবগুলো যাচাই করতে আমলাদের প্রায় ১১ মাস সময় লাগায় বিগত অর্থ বছরের ন্যায় সেবারও ১০০ কোটি টাকা ফেরত দিতে হয়েছে [ টিবিএস,১৪–০৪–২২]।”
স্বাস্থ্যখাতকে আমলাতন্ত্রের প্রভাবমুক্ত করতে করণীয়: (ক) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজের সংগে অবশ্যই একটি আমলাতান্ত্রিক কাঠামো এবং বিবিধ কার্যধারা জড়িত থাকবে। কিন্তু এ কাঠামোর প্রতিটি ধাপে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন স্বাস্থ্যকর্মীর মনোভাবসম্পন্ন পেশাদার কর্মী জড়িত থাকতে হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ পরিহার করে জরুরি সেবামূলক পদক্ষেপকে গুরুত্ব দিতে হবে। (খ) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো একটি সংস্থার প্রধানকে অবশ্যই একজন পেশাদারী স্বাস্থ্যকর্মী হতে হবে। এ ব্যাপারটা কোভিডের কারণে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছভাবে দেখা গিয়েছে। স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন পদে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চিকিৎসকদের নিয়োগ দিতে হবে। (গ) বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারকে ভেঙে বিসিএস ক্লিনিক্যাল, বিসিএস মেডিকেল এডুকেশন এবং বিসিএস মেডিক্যাল প্রশাসন এরূপ তিন ভাগে ভাগ করতে হবে । ডাক্তারী পাশ করার পর যে সমস্ত চিকিৎসক বিসিএস ক্লিনিক্যাল–এ যাবেন তাঁরা প্রচলিত ক্লিনিক্যাল সাবজেক্ট যেমন, মেডিসিন, সার্জারী, গাইনী ইত্যাদি বিষয়ে পোস্ট গ্রেজুয়েশন করবেন এবং পর্যায়ক্রমে মেডিকেল অফিসার থেকে জুনিয়র কনসালটেন্ট বা সহকারী অধ্যাপক, সিনিয়র কনসালটেন্ট বা সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক, সিনিয়র অধ্যাপক হিসাবে প্রমোশন পাবেন। ডিগ্রি না হলে মেডিকেল অফিসার থেকে সিনিয়র মেডিকেল অফিসার, চীফ মেডিকেল অফিসার, ডিষ্ট্রিক্ট বা জেলা মেডিকেল অফিসার ইত্যাদি পদে প্রমোশন নিয়ে বেতনের প্রতিটি গ্রেডে পৌঁছানোর সুযোগ তাদের জন্য থাকবে। বিসিএস মেডিকেল এডুকেশন ক্যাডারে যারা যাবেন তাঁরা মূলতঃ নন ক্লিনিক্যাল সাবজেক্ট যেমন, এনাটমী, ফিজিওলজি, বায়োকেমিষ্ট্রি ইত্যাদি বিষয়ে পোস্টগ্রেজুয়েশন করবেন এবং প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক, সিনিয়র অধ্যাপক হিসাবে প্রমোশন পাবেন। বিসিএস মেডিক্যাল প্রশাসন ক্যাডারে যারা যাবেন তাঁরা হেলথ মেনেজমেন্ট, কম্যুনিটি মেডিসিন, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ের উপর লেখাপড়া করবেন। তাঁরা সহকারী ইউএইচএ বা সহকারী উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক, ইউএইচএ বা উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক, ডেপুটি সিভিল সার্জন, সিভিল সার্জন, ডিভিশনাল ডিরেকটার, ডিরেকটার জেনারেল বা মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সব পদে পর্যায়ক্রমে প্রমোশন পাবেন। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় যেমন ক্লিনিক্যাল মনিটরিং, ডায়াগনস্টিক মনিটরিং, ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি তদারকিতে তাঁদের ম্যাজিস্ট্রেসী ক্ষমতা দিতে হবে। যিনি স্বাস্থ্য সার্ভিসের ক্যাডারভুক্ত হবেন তিনিই অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ও পদোন্নতি লাভ করে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যন্ত সমুদয় পদে যাবার অধিকারী হবেন এমনি ব্যবস্থা থাকতে হবে। (গ) চিকিৎসকদের জন্য স্বতন্ত্র হেলথ সার্ভিস কমিশন গঠন করতে হবে, (ঘ) আন্তঃক্যাডার বৈষম্য রোধ করতে হবে। (ঙ) চিকিৎসকদের নিরাপত্তা বিধান সরকারকেই করতে হবে। স্বাস্থ্য সিকিউরিটি আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে। “একদিকে সরকারের আমলারা বন্দুকসহ নিরাপত্তা পাচ্ছেন, আরেকদিকে চিকিৎসকদের শার্টের কলার চেপে ধরছেন রোগীর স্বজনরা (বিএমএ এর মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী, ৭১বিডিনিউজ, ১৫–০৩–২২)।” (চ) মানবজীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নয় এমনি মন্ত্রণালয়সমূহের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো একটি জনসেবামূলক সংস্থাকে কার্যকর উদ্দেশ্যে ছাড়া শুধু আমলাতান্ত্রিক মূলনীতির ভিত্তিতে চলতে দেয়া যেতে পারে না।
উপসংহার: এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা হলো তার সারমর্ম হিসাবে বলতে চাই যে, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য রোধ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতি নির্ধারণীতে স্বাস্থ্য সেবাদানকারীদের প্রতিনিধিত্ব থাকার ব্যবস্থা করলে স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির নিষ্ক্রিয়তা ও সাংসদদের আমলানির্ভরতা এবং আমলাতন্ত্রের অযৌক্তিক দাপটের অবসান হবে। এর ফলে স্বাস্থ্যখাতের যুগোপযোগী পরিবর্তন এবং উন্নয়ন ত্বরাম্বিত হবে বলে মনে করি।
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে, স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক।