স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র ১ শতাংশ বরাদ্দ, অপ্রতুল অবকাঠামো, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে পশ্চাৎপদতা, দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি, সেবা গ্রহণে উচ্চ ব্যয়, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং বিদ্যমান নীতিমালা তদারকির অভাবে খাতটিতে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয়নি। তাই স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ের পাশাপাশি জনগণের সম্পৃক্ততাও বাড়াতে হবে। দেশীয় স্বাস্থ্যসেবায় আস্থা বৃদ্ধিতে কাঠামোগত সংস্কার ও কার্যকর প্রয়োগের বিকল্প নেই। গত ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে আস্থা বৃদ্ধি: মান নিয়ন্ত্রণে কৌশলগত কাঠামো নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক সেমিনারে আলোচকরা এসব কথা বলেন।
ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউনাইটেড হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘দেশে মানসম্মত ও রোগীবান্ধব সেবা নিশ্চিতে এখনো কাঠামোগত ঘাটতি রয়ে গেছে, এছাড়া সরকারি–বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবা মানের অসমতা, প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের ঘাটতি, অনুমোদনহীন ক্লিনিক ও ফার্মেসি, ভুল ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা এবং সর্বোপরি বিদ্যমান আইন বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা আমাদের জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও খাতের প্রতি জনগণের আস্থাকে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থাপনার কার্যকর ব্যবহার না থাকার কারণে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় ৭৪ শতাংশ ব্যক্তিকে বহন করতে হয়। এর ফলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের জনগোষ্ঠী আর্থিকভাবে বড় ঝুঁকিতে পড়ে। এ অবস্থায় দেশে একটি টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিতের লক্ষ্যে এ খাতে বিদেশী বিনিয়োগ, সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্ব জোরদার, আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি, নার্সিং, ল্যাব সায়েন্স ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষ জনবল উন্নয়ন, সঠিক নীতিমালা বাস্তবায়ন এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার সমন্বিত প্রয়োগ অপরিহার্য। পাশাপাশি বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের স্বাস্থ্যবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে একটি শক্তিশালী হেলথ রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে তোলা জরুরি।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু রূঢ় সত্য হলো, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। আর যারা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন তাদেরও বড় অংশ সন্তুষ্ট নয় প্রাপ্ত সেবায়। কারণ দেশে মানসম্মত ও রোগীবান্ধব সেবা নিশ্চিতে এখনও কাঠামোগত ঘাটতি রয়েছে। চিকিৎসার চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেসরকারি ব্যবস্থা বাড়লেও বাড়েনি সরকারি ব্যবস্থা। ফলে সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে বর্তমানে সেবার যে পরিকাঠামো, তাও যথেষ্ট নয়। এমনকি আমাদের জনসংখ্যার অনুপাতে হাসপাতালগুলোতে শয্যা এবং কত চিকিৎসক ও নার্স প্রয়োজন, সে বিষয়ে যদি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সূচক মানা হয়, তাহলেও সংখ্যাটি যে একেবারেই অপ্রতুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে আমাদের সামগ্রিক চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়েই রয়েছে একধরনের অনিশ্চয়তা। আর সেই অনিশ্চয়তার ধাক্কা পড়ছে দেশের অর্থনীতিতেও।
সেবা পাওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকার–এতে কোনো ছাড় নেই। এটা কোনো দয়াও নয়। মনে রাখা দরকার সেবা প্রদানকারীরা জনগণের ট্যাক্সের অর্থে বেতন পান। তাই তাদের দায়িত্ব জনগণকে সম্মান ও সহানুভূতির সঙ্গে সেবা দেওয়া। নাগরিক যদি সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হন, তাহলে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি তার আস্থা নষ্ট হয়। আমরা মনে করি, সেবা খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলেই খাতটি দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্ত করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি এ কে আজাদ খান বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় বেশ অর্জন রয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে এ খাতে কাঙ্ক্ষিত মান নিশ্চিত করা যায়নি। দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত দেশগুলোর মতো নয়, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়েও আমরা পিছিয়ে রয়েছি। বাংলাদেশের পক্ষে এখনই ইউনিভার্সাল স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়তো সম্ভব নয়। তবে আমাদের প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের ওপর বেশি জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নের পাশাপাশি বিকেন্দ্রীকরণের কোনো বিকল্প নেই।’ তাই সবকিছু রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি।








