স্বামী বিবেকানন্দ শুধু একজন দার্শনিক নন, তিনি ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক নেতা। বিবেকানন্দের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত ছিল ১৮৯৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর শিকাগো বিশ্ব ধর্ম মহাসভা–য় প্রদত্ত ভাষণ। হাজারো দেশ–বিদেশের প্রতিনিধি সমাবেশে তিনি তাঁর বক্তব্য শুরু করেছিলেন এই শব্দ দিয়ে-“আমেরিকার বোন ও ভাইদের প্রতি আমার প্রণাম।” আন্তরিক ও হৃদয়গ্রাহী এই সম্ভাষণ মুহূর্তেই উপস্থিত জনতাকে আবেগে আপ্লুত করেছিল। শিকাগো ভাষণ মুলত ইতিহাসের এক মোড়। সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, কোনো ধর্মই অন্য ধর্মের থেকে শ্রেষ্ঠ বা নিকৃষ্ট নয়। প্রতিটি ধর্মই একই পরম সত্যের পথে একটি বৈধ দিশা। তিনি সতর্ক করেছিলেন যে গোঁড়ামি, অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণাই মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রু, যা ইতিহাসে অসংখ্য যুদ্ধ ও দুর্ভোগের কারণ। এর একমাত্র প্রতিকার হলো সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধের স্বীকৃতি। তাঁর এই বক্তব্য শুধু বেদান্ত দর্শনের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকেই বিশ্বের সামনে তুলে ধরেনি, বরং শান্তি ও ঐক্যের এক কালজয়ী বার্তাও প্রদান করেছে।
বিবেকানন্দের সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধের ধারণা মূলত বেদান্ত দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। বেদান্ত বলে প্রতিটি মানুষের মধ্যে একই দৈব সত্তা বিরাজমান। জাতি, ধর্ম কিংবা শ্রেণি–এসব ভেদাভেদ কেবল বাহ্যিক; আসল সত্য হলো মানবজাতি মূলত এক ও অভিন্ন। এই বিশ্বাসই তাঁর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গড়ে তুলেছিল এবং জাতি ও জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের আহ্বানকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন, যখন আমরা এই মৌলিক সত্য ভুলে যাই, তখনই বিভেদ ও অসহিষ্ণুতা জন্ম নেয়। নিজের ও অপরের মধ্যে দেবত্বকে চিনতে পারলেই আমরা স্বাভাবিকভাবেই সম্মান, সহানুভূতি ও ভালোবাসা বিকশিত করি। তাঁর কাছে ভ্রাতৃত্ব কোনো আবেগপ্রবণ কল্পনা নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক সত্য, যা প্রতিদিনের জীবনে উপলব্ধি ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিবেকানন্দের কাছে সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব মানে একরূপতা নয়, বরং ভ্রাতৃত্ব সীমারেখার ঊর্ধ্বে । তিনি কখনোই মানুষকে নিজের সংস্কৃতি বা ধর্মীয় পরিচয় ত্যাগ করতে বলেননি। বরং তিনি প্রচার করেছিলেন বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য–এর ধারণা। স্বামী বিবেকানন্দ অন্যান্য ধর্মের সহিষ্ণুতা ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে খুবই শক্তিশালীভাবে মতপ্রকাশ করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি হলো সত্য এক, কিন্তু বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশিত হয়। তিনি বিশ্বের সামনে স্মরণ করিয়েছিলেন যে কোনো এক ধর্ম সত্যের একমাত্র ধারক নয় এবং সব ধর্মই একই দৈবিক বাস্তবতার দিকে যাওয়ার বৈধ পথ। তিনি বলেছিলেন, কেবল সহিষ্ণুতা যথেষ্ট নয়; বরং প্রয়োজন গ্রহণযোগ্যতা। সহিষ্ণুতা বলতে বোঝায়-“আমি আপনাকে থাকতে দিচ্ছি, যদিও আমি মনে করি আপনি ভুল।” আর গ্রহণযোগ্যতা মানে হলো অন্য ধর্মকে সমানভাবে সত্য ও মূল্যবান হিসেবে সত্যিকারভাবে সম্মান করা। এটি তখনকার সময়ে বিপ্লবী ধারা হিসেবে দেখা যেত, যখন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সংঘাত সাধারণ ছিল।
বিবেকানন্দ তাঁর গুরু, শ্রী রামকৃষ্ণ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন, যিনি বিভিন্ন ধর্ম–হিন্দুধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলাম–অনুশীলন করেছিলেন এবং উপসংহার টেনেছিলেন যে সব ধর্মই একই ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যায়। এই ঐতিহ্য অনুসরণ করে, বিবেকানন্দ ঘোষণা করেছিলেন যে ধর্মীয় সম্প্রীতি কেবল তখনই সম্ভব যখন আমরা বৈচিত্র্যকে উদযাপন করি, একরূপতা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা না করি। তাঁর মতে, বিশ্ব হলো একটি বিশাল ক্ষেত্র, যেখানে বিভিন্ন ধর্ম বিভিন্ন ফুলের মতো–প্রতিটি নিজস্ব সুবাস, সৌন্দর্য ও বিশেষত্বের অধিকারী। একত্রে তারা মানবতার বাগানকে সুন্দর করে তোলে। তাঁর বার্তা স্পষ্ট ছিল: “আমরা কেবল সর্বজনীন সহিষ্ণুতায় বিশ্বাস করি না, আমরা সমস্ত ধর্মকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করি।” তিনি ভ্রাতৃত্বের এই ধারণাকে শুধু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং প্রাণী ও পরিবেশের প্রতিও সহানুভূতি প্রসারিত করেছিলেন। তাঁর কাছে সমস্ত জীব ও প্রকৃতি ছিল পবিত্র ও আন্তঃসম্পর্কিত। প্রকৃতি ও জীবের যত্ন নেওয়া মানে ছিল সৃষ্টির মধ্যে বিরাজমান ঈশ্বরকে সম্মান জানানো।
স্বামীজীকে তৎকালীন সমাজে শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবিক ঐক্যের দূত হিসেবে জানতেন সবাই। সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আজ যেমন প্রাসঙ্গিক, উনিশ শতকের শেষ ভাগেও তেমনই ছিল। যখন সমাজ জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও জাতীয়তার বিভাজনে ক্ষতবিক্ষত ছিল, তখন বিবেকানন্দ সাহসের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন–মানবজাতি এক বৃহৎ পরিবার, যা একই দৈব সত্তায় আবদ্ধ। তাঁর জীবন, শিক্ষা ও বাণী–বিশেষত শিকাগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ–আজও দাঁড়িয়ে আছে সহিষ্ণুতা, সহানুভূতি ও পারস্পরিক সম্মানের চিরন্তন প্রতীক হিসেবে।
স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন, সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব কেবল কথার মাধ্যমে নয়, কর্মের মাধ্যমে প্রকাশ পেতে হবে। তাই তিনি কর্মেও ভ্রাতৃত্ববোধ খুঁজতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন-“মানবসেবাই ঈশ্বরসেবা।” তাঁর কাছে অন্যকে সেবা করা ছিল সর্বোচ্চ উপাসনা। এই বিশ্বাসই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল দরিদ্রের উন্নয়ন, সাধারণ শিক্ষার প্রসার ও নারীর ক্ষমতায়নের ওপর জোর দিতে। তিনি মনে করতেন, যতদিন না দারিদ্র্য, অজ্ঞতা ও বৈষম্য দূর হবে, ততদিন ভ্রাতৃত্বের আদর্শ পূর্ণতা পাবে না। এই লক্ষ্য পূরণে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রামকৃষ্ণ মিশন, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ত্রাণ ও সামাজিক উদ্যোগে নিয়োজিত। এর মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছিলেন, সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব কেবল আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা নয়, বরং বাস্তব কর্মের মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
একবিংশ শতাব্দীতে বিবেকানন্দের বার্তা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। আজও পৃথিবী ধর্ম, জাতি, জাতীয়তা ও মতাদর্শের বিভাজনে জর্জরিত। সংঘাত, বৈষম্য ও অসহিষ্ণুতা এখনও ব্যাপক কষ্টের কারণ। এই প্রেক্ষাপটে বিবেকানন্দের সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ এক আশার আলো। তিনি আমাদের শেখান, শান্তি কখনো জোরজবরদস্তি বা আধিপত্যের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা যায় না; এটি কেবল পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার মাধ্যমেই সম্ভব। বিশ্বায়নের যুগে, যখন মানবসমাজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি আন্তঃসংযুক্ত, তখন তাঁর বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য–এর আহ্বান আরও জরুরি হয়ে ওঠে। সহিষ্ণুতা, সহানুভূতি ও নিঃস্বার্থ সেবার মাধ্যমে ব্যক্তি ও জাতি এক ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ সমাজের পথে এগোতে পারে।
স্বামী বিবেকানন্দের সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিটি সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রতি সম্মান, সকল জীবের প্রতি সহানুভূতি এবং মানবসেবাকে সর্বোচ্চ উপাসনা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তাঁর ঐতিহাসিক শিকাগো ভাষণ এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক হয়ে আছে এবং আজও বিশ্ববাসীকে অনুপ্রাণিত করে। আজকের বিভক্ত পৃথিবীতে তাঁর চিরন্তন বার্তা আমাদের আহ্বান জানায় সংকীর্ণ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে এক বিশ্ব পরিবারের সদস্য হিসেবে বাঁচতে। তাঁর শিক্ষাকে গ্রহণ করেই মানবজাতি শান্তি, সহিষ্ণুতা ও সর্বজনীন ভালোবাসার উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারে। আজকের এই দিনে এটাই হোক স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং তাঁর সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের স্বপ্ন পূরণের পথ।
লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, চুয়েট। এবং বিভাগীয় সম্পাদক (চট্টগ্রাম), বিবেকানন্দ শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরিষদ, বাংলাদেশ।