পারিবারিক কলহের জেরে ২০১৭ সালে রাউজানের চিকদাইর ইউনিয়নের দক্ষিণ সর্তা গ্রামে নাছিমা আকতার নামে এক নারী প্রবাসী স্বামী নাদিমকে খুনের পর লাশ বস্তাবন্দি করে ফেলে দেন। এ ঘটনার প্রায় আট বছর পর স্ত্রীসহ দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। খুনের পর লাশটি ফেলা হয়েছিল বাড়ির পাশে একটি জঙ্গলে। পরে গলিত লাশ কুকুরের টানাটানিতে এসে পড়ে পাশের সর্তাখালে। ঘটনার পর ওই নারী এলাকাবাসী ও নিজ সন্তানের কাছে প্রচার করে আসছিলেন স্বামী রাগ করে বিদেশ চলে গেছেন।
জানা যায়, খালে পচে গলে যাওয়া বস্তাবন্দি লাশ দেখে এটি কার বা কোত্থেকে এলো কেউ বলতে পারছিলেন না। স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। পরে লাশটির পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। জানা যায়, প্রবাসী নাদিম নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে স্থানীয় জনসাধারণের সন্দেহ ছিল স্ত্রী নাছিনার প্রতি। কারণ সকলে জানে, নাছিমার সাথে তার দেবর জসিমের পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল। নাদিম দেশে আসার পর থেকে নানা কারণে নাছিমার সাথে স্বামীর ঝগড়ার কথা সবার জানা ছিল।
এলাকায় কানাঘুষার মধ্যে খালে লাশ পাওয়ার পর নাদিমের ভাই জসিম তার ভাই নিখোঁজ হয়েছেন মর্মে থানায় জিডি করেছিলেন। জিডি পেয়ে পুলিশ ঘটনার অনুসন্ধানে নামে। দীর্ঘ সময় অনুসন্ধান চালিয়ে কোনো ক্লু না পাওয়ায় এই ঘটনার তদন্তের ভার পায় সিআইডি। পুলিশের এই বিভাগ মামলাটি হাতে পেয়ে নানা তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করে। এসবের মধ্যে বিভিন্ন কারণে এক সময় তদন্ত কাজ স্থবির হয়ে পড়ে।
জানা যায়, দুই মাস আগে সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেন ছত্রধর ত্রিপুরা। তিনি পুরাতন মামলার রেকর্ডপত্র পর্যালোচনাকালে রাউজানের ওই ঘটনাটি পেয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেন। পরে ঘটনা তদন্তের ভার দেন একজন কর্মকর্তাকে। সর্বশেষ নানা কৌশলে ওই নারীর সাথে সখ্য থাকা নোয়াখালী জেলার হাতিয়া থানার আব্দুল আলীর ছেলে সিএনজি চালক আবুল কালামকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করে গ্রেপ্তার করে স্ত্রী নাছিমা আক্তার (৪২) ও তার দেবর জসিম উদ্দিনকে (৫২)।
বিশেষ পুলিশ সুপার ছত্রধর ত্রিপুরা বলেন, নিহত প্রবাসীর স্ত্রী নাছিমা আক্তার স্বামীকে খুনের বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে পারিবারিক কলহের জেরে স্বামীকে খুন করার কথা স্বীকার করেছেন। খুনের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, হত্যার পর লাশ সাত দিন ঘরে কম্বল মুড়িয়ে সুগন্ধি লাগিয়ে রেখেছিলেন।
সিআইডি সূত্রে জানা যায়, নিহত নাদিম উদ্দিন দীর্ঘ সময় সংযুক্ত আরব আমিরাতে ছিলেন। এর আগে তার উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া এক ছেলে নিখোঁজ হয়েছিল। পরে বিষয়টি জানতে পেরে স্ত্রীকে না জানিয়ে ২০১৭ সালের জুনে রাউজানের দক্ষিণ সর্তা গ্রামের বাড়িতে আসেন নাদিম। ছেলে নিখোঁজের বিষয়টি না জানানোয় স্ত্রীর ওপর ক্ষুব্ধ হন তিনি। পরকীয়ায় লিপ্ত স্ত্রীকে না জানিয়ে স্বামীর দেশে আসার বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। এর বাইরে সংসার খরচ চালানোর টাকা ও ঋণ করা টাকা পরিশোধ নিয়ে স্বামীর সাথে তার ঝগড়া লেগে থাকত।
সূত্র মতে, ঘটনার দিন ২০১৭ সালের ১৮ আগস্ট নাছিমাকে ঝগড়ার এক পর্যায়ে চড় মারেন স্বামী নাদিম। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নাজিমকে ঘরের দরজার চৌকাঠের সঙ্গে ধাক্কা দেন নাছিমা। মাথায় আঘাত পেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন নাদিম। সে সময় রক্তক্ষরণে মারা যান তিনি। ওই সময় ঘরে স্বামী–স্ত্রী ছাড়া কেউ ছিলেন না। স্ত্রী নাছিমা স্বামীর লাশ পার্শ্ববর্তী মালামাল রাখার ঘরে নিয়ে যান। কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা লাশ থেকে কোনো দুর্গন্ধ যাতে বের না হয়, এজন্য নানারকম সুগন্ধি ব্যবহার করেন। এভাবে সাত দিন ওই ঘরে রেখে দেন। মেঝেতে পড়ে থাকা রক্ত মুছে ফেলেন। পুড়িয়ে ফেলা হয় নাদিমের পাসপোর্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। স্কুলপড়ুয়া দুই মেয়ে ঘরে এলে তাদের জানানো হয় তাদের বাবা আবার বিদেশ চলে গেছেন।
পুলিশ কর্মকর্তা ছত্রধর ত্রিপুরা বলেন, প্রথমে মামলাটি থানা পুলিশ তদন্ত করে। দুই বছর পর সিআইডিতে আসে তদন্তের জন্য। সর্বশেষ খুনি ও জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় সিআইডি।