স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ

জাবি ছাত্রলীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার ৪ জন রিমান্ডে ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজ ও মামুনকে সহায়তা করেন চারজন জড়িতদের সনদ স্থগিত, ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত

| সোমবার , ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৬:৩০ পূর্বাহ্ণ

জাবি ছাত্রলীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার ৪ জন রিমান্ডে ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজ ও মামুনকে সহায়তা করেন চারজন জড়িতদের সনদ স্থগিত, ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত

আজাদী ডেস্ক 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীকে হলে আটকে স্ত্রীকে জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করেন ছাত্রলীগ নেতা ও এক বন্ধু। আর তাদেরকে নানাভাবে সহায়তা করেন আরও চারজন। শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলসংলগ্ন জঙ্গলে এ ধর্ষণের ঘটনার পর ভুক্তভোগীর স্বামী বাদী হয়ে সাভার থানায় ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও জাবি শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমানসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার বালিয়াহাটি গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

গ্রেপ্তার অন্য তিনজন হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বগুড়ার শেরপুর উপজেলার পারভবানিপুর গ্রামের সাব্বির হাসান সাগর, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার নেওয়াশী গ্রামের সাগর সিদ্দিকী এবং রংপুরের কোতোয়ালী সদর থানার গন্দাদাশ গ্রামের হাসানুজ্জামান। পলাতক রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার আমন্ত গ্রামের মুরাদ হোসেন এবং একই গ্রামের বাসিন্দা মো. মামুনুর রহমান মামুন।

এদিকে গণধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানসহ চার শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের হেফাজতে পেয়েছে পুলিশ। গতকাল ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম রাবেয়া বেগম শুনানি শেষে তাদের রিমান্ডে নেওয়ার অনুমোদন দেন। খবর বিডিনিউজের।

ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিতের পাশাপাশি সনদ স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গতকাল বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম জানান। এছাড়া সিন্ডিকেট সভায় পরীক্ষা শেষ হওয়া শিক্ষার্থী এবং পোষ্য কোটায় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে হল ছাড়তে নির্দেশনা দেওয়াসহ চারটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ধর্ষণ, ধর্ষণের কাজে সহযোগিতা করায় জন্য দেশের প্রচলিত আইনে মামলা করার সিদ্ধান্তও হয়। পাশাপাশি ধর্ষণের ঘটনা খতিয়ে দেখতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান সিন্ডেকেট সদস্য ও কমিটির প্রধান অধ্যাপক অজিত কুমার মজুমদার। তদন্ত কমিটিকে আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

গতকাল রোববার দুপুরে আশুলিয়া থানায় এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস) আব্দুল্লাহিল কাফি বলেন, ভুক্তভোগীর স্বামী রাতেই বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন। আমরা সাভার ও আশুলিয়া থানা সমন্বয় করে আসামিদের চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। বাকি দুজনকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। মামলায় মোস্তাফিজ ও মামুনুর রশীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া বাকি চারজনের বিরুদ্ধে মারধর ও আসামিদের পালাতে সহায়তা করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

আব্দুল্লাহিল কাফি বলেন, ১৯ বছর বয়সী ওই তরুণীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে পাঠানো হয়েছে।

শনিবার রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ আবাসিক হলে ‘এ’ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে কৌশলে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন আসামি মোস্তাফিজ ও মামুনুর রশীদ মামুন। ওই নারীর অভিযোগ, মামুন আমাদের বাসায় ভাড়া থাকত। সে আমার স্বামীর মাধ্যমে ফোন দিয়ে আমাকে তার রেখে যাওয়া জিনিসপত্র নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বলে। আমি তার জিনিসপত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে যাই। তখন সে আমাদের বাসায় থাকবে না, মোস্তাফিজ ভাইয়ের কাছে থাকবে বলেও জানায়। এরপর মামুন আমার কাছ থেকে তার জিনিসপত্রগুলো নিয়ে হলে রেখে আসে। পরে আমার স্বামী অন্যদিক থেকে আসবে বলে আমাকে হলের সামনে থেকে পাশের জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যায়। তার সঙ্গে মোস্তাফিজ ভাইও ছিল। তখন তারা আমাকে ধর্ষণ করে।

গতকাল ভোরে এক বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সব কার্যক্রম থেকে আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নীতি, আদর্শ ও সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। এছাড়া স্থায়ী বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রে সুপারিশ করা হলে কেন্দ্রীয় কমিটির উপদপ্তর সম্পাদক সাদি মোহাম্মদ আকাশের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তাকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, উত্থাপিত অভিযোগের ভিত্তিতে মোস্তাফিজকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাব্বির আলম বলেন, অপরাধী যেই হোক তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজউলহাসান বলেন, পুলিশ আমাদের কাছে যে কোনো ধরনের সহযোগিতা চাইলে আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি। হলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অভিযুক্তদের শনাক্ত করা হয়েছে।

আশুলিয়া থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ বলেন, পলাতক মামুনুর রহমান মামুন ও মুরাদকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

চার শিক্ষার্থী ৩ দিনের রিমান্ডে : গণধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানসহ চার শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের হেফাজতে পেয়েছে পুলিশ। গতকাল ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম রাবেয়া বেগম শুনানি শেষে তাদের রিমান্ডে নেওয়ার অনুমোদন দেন।

ধর্ষণের এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. মিজানুর রহমান সাত দিনের রিমান্ড চেয়েছিলেন। মামলার ছয় আসামির মধ্যে চারজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, যাদের জিজ্ঞাসাবাদে তিন দিনের রিমান্ডে পেল পুলিশ। তারা হলেন মোস্তাফিজুর রহমান, সাব্বির হাসান, সাগর সিদ্দিকী ও হাসানুজ্জামান।

গ্রেপ্তারদের এদিন বিকাল ৫টার দিকে আদালতে হাজির করে ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। শুনানিতে আইনজীবী খালিদ হোসেন তাদের রিমান্ড আবেদন বাতিল চান। রাষ্ট্রপক্ষে রিমান্ড চেয়ে শুনানি করেন অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকউটর আনোয়ারুল কবীর বাবুল।

বিক্ষোভে উত্তাল জাহাঙ্গীরনগর : ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে বিভিন্ন বিভাগের শতাধিক শিক্ষার্থী নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একটি দল বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য নূরুল আলমের সঙ্গে দেখা করে তিনটি দাবি পেশ করেন। দাবিগুলো হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে মামলা করা, তিন দিনের মধ্যে হলগুলোতে থাকা অছাত্রদের বের করা, ধর্ষক ও তাদের সহযোগীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।

এদিকে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আনিছা পারভিন বলেন, আমরা তিনটি দাবি জানিয়েছি। উপাচার্যকে বলেছি, জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে বিষয়গুলো সমাধান করার জন্য। উপাচার্য আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। বিকাল ৩টায় জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী অবস্থান করে বিক্ষোভ করেন। এ সময় তারা ‘ক্যাম্পাসে ধর্ষক কেন, প্রশাসন জবাব চাই’; ‘ধর্ষণমুক্ত ক্যাম্পাস চাই’; ‘ধর্ষকদের পাহারাদার, হুঁশিয়ার সাবধান’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। এর মধ্যে অভিযুক্তদের খুঁজতে কর্তৃপক্ষ ওই হল থেকে বের হওয়ার চারটি ফটক বন্ধ করে দেন। কিন্তু একটি ফটকের তালা ভেঙে দুই অভিযুক্তকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন শাখা ছাত্রলীগের কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী সাগর সিদ্দিকী। আরেকজন শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির ও তাদের সঙ্গে সহযোগী হিসাবে ছিলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী হাসান।

হাসান সাংবাদিকদের বলেন, আমি এটা জানতাম না। ছাত্রলীগের সহসভাপতি শাহ পরাণ ভাইয়ের নির্দেশে আমি তালা ভাঙতে যাই। গিয়ে দেখি সাগর সিদ্দিকী ও সাব্বির সেখানে উপস্থিত আছে। আমরা তিনজন মিলে তালা ভেঙে ফেলি।

অভিযুক্তরা সবাই শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। হলের নিরাপত্তারক্ষী দুলাল মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, আমি তাদেরকে তালা ভাঙতে দেখেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাব্বির আলম বলেন, ঘটনাটা শুনেছি। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বামীর অবৈধ আয় দিয়ে সম্পদ করেছেন স্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধঅপরিকল্পিতভাবে বাঁধ কাটায় বিপর্যয়