স্বাধীন সংবাদপত্র অসহায় মানুষের সহায় হয়ে দাঁড়াতে পারে

আজাদী-আমার আবেগের প্রান্তর

মেজর মো: এমদাদুল ইসলাম (অব:) | শুক্রবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১১:২১ পূর্বাহ্ণ

 

 

 

 

 

 

গুগুল সার্চ দিয়ে আজাদী শব্দের যথার্থ অর্থ খুঁজে নিলাম। শব্দটি পারস্য ভাষার। উর্দু হিন্দি বাংলা তথা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এর ব্যাপক প্রচলন। আজাদী অর্থ মুক্ত স্বাধীন অবারিত। এই অর্থ আমাকে দারুণ আলোড়িত করে। আমি পিছন ফিরে আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব আবদুল খালেকের মনোজগত নিয়ে ভাবি। তাহলে মানুষটি কি তার সময়ের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষের অবারিত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় আজাদী’র প্রকাশনা শুরু করেছিলেন। না হয় অভিধানে এত এত শব্দ থাকতে আজাদী শব্দটি তিনি বেছে নিয়েছিলেন কেন? তার অন্তর মননে তার বিশ্বাস আর বোধে কি অনুরণিত হয়েছিল, মানুষের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি এবং অবারিত স্বাধীনতা প্রয়োজন

সে মুক্তি দারিদ্র্য এবং ক্ষুধা থেকে

সে মুক্তি মানুষের চিন্তার দৈন্যতা থেকে

সে মুক্তি মানুষের প্রতি মানুষের নির্যাতন নিপীড়ন অবজ্ঞা থেকে

সে মুক্তি মানুষের অশিক্ষা সকল মূর্খতা থেকে

সে মুক্তি মানুষের যাবতীয় বঞ্চনা থেকে

সে মুক্তি মানুষের চিন্তা চেতনার

সে অবারিত স্বাধীনতা সত্য প্রকাশের, সত্য বিনির্মাণের

সে অবারিত স্বাধীনতা একটি জাতিসত্তার মনন গঠনের

সে অবারিত স্বাধীনতা একটি জাতির অর্ন্তজগতে ক্রমে বোধ আর বিশ্বাসে স্বাধীন স্বকীয়তার বীজ প্রোথিত করা এবং একসময় সমস্বরে নির্ভয়ে অকুতোভয় উচ্চারণ আমরা ‘স্বাধীন’।

আজাদী তার জন্মলগ্ন থেকে প্রতিষ্ঠাতার স্বপ্ন পূরণে অবিরাম পথ পরিক্রমণ করে এসেছে, এ আমার একান্ত প্রত্যয়।

এ কঠিন কঠোর দুর্গম পথ পরিক্রমণের স্বীকৃতি দেশ এবং জাতি আজাদীকে দিয়েছে। তার প্রমাণ আজাদীর দুজন সম্পাদক মরহুম মোহাম্মদ খালেদ স্বাধীনতা পুরস্কার এবং বর্তমান সম্পাদক জনাব এম এ মালেক একুশে পদকে ভূষিত। সংবাদ পত্রের ইতিহাসে এটি একটি বিরল ঘটনা এবং এক অনন্য অর্জন।

এ দুজন সম্পাদকের কাছেই আমার ব্যক্তিগত ঋণ অপরিশোধ্য। কেন সে কথা উল্লেখ না করলে নয়।

আমি যখন কলেজ ছাত্র তখন এক রচনা প্রতিযোগিতায় আমার লেখা প্রথম হয়, সে লেখা জনাব খালেদ সাহেবের উৎসাহে এবং উদ্যোগে আজাদিতে প্রকাশিত হয়েছিল। সেটি ছিল তিনটি উপ সম্পাদকীয়ের মাধ্যমে। পরবর্তীতে আমি সেনাবাহিনীর কঠিন কঠোর অনুশাসনের জীবনে প্রবেশ করি। সেনাবাহিনী থেকে ছুটিতে আসি। জনাব খালেদ অসুস্থ। তিনি চেরাগি পাহাড়ের মোড়ে সেন্টার পয়েন্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সে খবর পেয়ে আমি অসুস্থ খালেদ সাহেবকে দেখার জন্য ঐ হাসপাতালে যাই। সাথে আমার দুই ভায়রা জনাব এস এম ফজলুল হক (চাকসুর সাবেক ভিপি এবং বি জি এম এ সভাপতি) এবং জনাব জহিরুল আলম দোভাষ (প্রাক্তন সি ডি এ চেয়্যারম্যান)। কুশল বিনিময়কালীন এক পর্যায়ে জনাব খালেদ সাহেব একটু কথা আছে বলে আমাকে তার রুমের একপাশে ডেকে নেন। আমি কিছুটা হতচকিত। তিনি কি আলাপ করতে চাচ্ছেন সেই ভেবে। তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে অনকেটা অনুযোগের স্বরে বললেন ‘আপনি লেখালেখি করছেন না কেন’? আমি বিস্ময়ের ঘোর কেটে উত্তর দিই ‘সেনাবাহিনীতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিত লেখালেখি করা যায় না’। ‘ডাইরীতে লেখাও কি নিষেধ?’ ‘না তা লেখা যায় তবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ছাড়া প্রকাশ করা যায় না’। ‘তাহলে ডায়েরীতে লিখতে থাকেন’। সেই অনুপ্রেরণার ফলশ্রুতি আমার ডায়রী লেখা। যা পরবর্তীতে আমার প্রথম ছোট গল্পের বই ‘খরস্নায়ূ’ হিসাবে প্রকাশিত।

আমার ‘অশ্রু’ বইটির প্রকাশনা উপলক্ষ্যে জনাব রাশেদ রউফের সাথে সাক্ষাৎ করতে আমি আজাদী’তে যাই। এই সূত্রে আজাদী সম্পাদক জনাব এম এ মালেক সাহেবের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ। উনার সাথে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপান্তে তিনি আমাকে আজাদীতে নিয়মিত একটি কলাম লেখার অনুরোধ করেন। আমি বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে সম্মতি জানিয়ে উনার অফিস থেকে বেরিয়ে আসি।

৩১ জানুয়ারি ২০২৩ প্রকাশিত ‘কঠিনেরে ভালবাসিলাম’ লেখার মাধ্যমে আজাদীর সাথে আমার দ্বিতীয় এবং নিয়মিত পথ চলা শুরু। সেই থেকে আজাদীতে ‘সমকালের দর্পণ’ শিরোনামে লেখা। এ শিরোনাম জনাব রাশেদ রউফ’এর দেওয়া। প্রকাশিত লেখার সূত্রে পাঠকদের মন্তব্যে, উচ্ছ্বাসে, ভালোবাসায় যখনই আপ্লুত হয়েছি অন্তর থেকে তখনই আজাদী সম্পাদক জনাব এম এ মালেকের প্রতি তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টির জন্য শ্রদ্ধায় আমি আনত হয়েছি। এই শ্রদ্ধাবোধ আমার প্রতি তার আস্থার জন্য, তার অকুণ্ঠ ভালোবাসার জন্য, আমার জন্য পাঠকদের সামনে প্রকাশিত হওয়ার, বিচরণের এক দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তরের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। সেই থেকে এবং এখন আজাদী আমার আবেগের এক প্রান্তর।

এবার আসি সংবাদ পত্র বিষয়ক কিছু একাডেমিক আলোচনায়। খৃষ্টপূর্ব প্রায় ৫৯ সালে রোমে প্রথম হস্ত লিখিত সংবাদ পরিবেশিত হওয়ার ইতিহাস জানা যায়। তবে আরো অনেক পরে আধুনিক সংবাদপত্রের প্রচলন শুরু হয় ভেনিস থেকে ১৫৬৬ সালে। প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু ১৬০৫ সালে জার্মানীতে। বৃটেনে ১৬৬৫ সালে প্রথম সংবাদ পত্র লন্ডন গেজেট প্রকাশিত হয়। ১৭৮০ সালে ভারতের প্রথম পত্রিকা বেঙ্গল গেজেট প্রকাশিত হয়। এ প্রসঙ্গে আনন্দ এবং গৌরবের বিষয় হল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক ‘দৈনিক আজাদী’। এ গৌরব তিলক একটি দৈনিকের জন্য এক পরম পাওয়া।

প্রসঙ্গক্রমে সংবাদ পত্র বিষয়ক কিছু উল্লেখযোগ্য বক্তব্য নিয়ে এখানে একটু আলোচনা করতে চাই। এ আলোচনার কারণ বিদগ্ধজনেরা একটি আদর্শ সংবাপত্র কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেছেন তা পাঠকদেও সামনে তুলে ধরা। যেমন : জোসেফ পুলিটজার’ যার নামে এখন সংবাদপত্র জগৎ এর সবচেয়ে অভিজাত পুরস্কারটি প্রচলিত তার এ কথাটি একটি সংবাদ পত্রের অভিযাত্রায় পথরেখা হিসাবে গণ্য হওয়া সমীচীন পুলিটজার’ সেই বাক্য News papers should have no friends অর্থাৎ একটি সত্যিকারের সংবাদপত্র হবে নির্মোহ, তার কোন দল মত বা কারো সাথে কোন বিশেষ সম্পর্ক হবে দোষণীয়।

জোসেফ পুলিটজার’ এর এ কথাটিও একটি মননশীল, দায়িত্ববান সংবাদ পত্রের জন্য অতি অবশ্য অনুসরণীয় বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। What newspaper needs in its news, in its headlines, and on its ediorial page is terseness, humor descriptive power satire originality, good literary style cleaver condensation, and accuracy accuracy accuracy ! একথার গূঢ়রাত্ব হল একটি সংবাদপত্র তার শিরোনাম এবং সম্পাদকীয়তে হবে বাহুল্য বর্জিত, সংবাদ পরিবেশনের বর্ণনায় শক্তিশালী, হিউমারাস তথা ব্যঙ্গরসাত্বক, শব্দ চয়নে সাহিত্যাশ্রয়ী, সংবাদ সংক্ষেপে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সর্্বোপরি নির্ভুল, নির্ভুল, নির্ভুল।

আর্থার মিলার সংবাদপত্রকে চমৎকার ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তার দৃষ্টিতে একটি উৎকৃষ্ট সংবাদপত্র হল: A good newspaper is a nation talking to itself. কী চমৎকার বর্ণনা। একটি ভালো সংবাদপত্র হল একটি জাতি সংবাদপত্রের মাধ্যমে নিজের সাথে নিজের কথা বলা বা কথোপকথন তুল্য।

আসলেই উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলির যথার্থতা আমরা খুঁজে পাই বা খুঁজে পেতে চেষ্টা করি যখন সাত সকালে আমরা সংবাদপত্রের পাঠকেরা কাঙ্ক্ষিত সংবাদ পত্রটি হাতে নিই। আমরা সংবাদ পাঠ করি আবার কোন কোন পাতায় পরিবেশিত সংবাদের তথা ঘটে যাওয়া ঘটনার পিছনের ব্যাখ্যা পাওয়ারও চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে একটি সংবাদপত্র প্রথমত পাঠককে তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে যেমন সমৃদ্ধ করে তেমনি একই সাথে সংবাদের পিছনের কারণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাঠকের মনে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তার মনন গঠনেও ভূমিকা রাখে।

আমরা সংবাদপত্র পাঠকেরা দৈনিকের পাতায় পাতায় চোখ রাখি পাঠ করি সেই পাঠ থেকে আত্মজিজ্ঞাসায় নিমগ্ন হই পরিবেশিত সংবাদটি সত্য কিনা? এই যাচাইয়ের মাঝে দৈনিকটির অবস্থান নির্ণীত হয়, পাঠকের কাছে গ্রহণ অথবা অগ্রহণযোগ্য হয়। এন্ডমন্ড মরো নামক ভদ্রলোকের সংবাদপত্র বিষয়ক এই কথাটি আমার খুবই পছন্দের। Most of us probably feel we could not be free with out newspaper and that is the real reason we went newspapers to be free . কথাটির তাৎপর্য এরকম সংবাদপত্র বিহীন আমাদের স্বাধীন থাকা অসম্ভব আর তাই আমরা স্বাধীন সংবাদপত্র চাই।

একটি স্বাধীন সংবাদপত্র অসহায় মানুষের সহায় হয়ে দাঁড়াতে পারে, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারে। দিশাহীন একটি জাতির দিক নির্দেশক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে মরো’র কথামত সংবাদপত্রটিকে স্বাধীন হতে হবে।

আমাদের আজাদীও তার প্রতিষ্ঠাতার স্বপ্ন বুকে ধারণ করে ‘মুক্ত স্বাধীন অবারিত’ এক অবিরাম পথ চলুক।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষা খাতকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে : মেয়র
পরবর্তী নিবন্ধআবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার : তাঁকে স্মরণ করি শ্রদ্ধায়