মহাকালের মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জ্ঞানেন্দ্রিয় বুদ্ধিমত্তার অপরিসীম বোধালয়ে ধারণ করতে পেরেছিলেন স্বাধীন মাতৃভূমি ছাড়া বাঙালির আর্থ–সামাজিক মুক্তি কোনভাবেই সম্ভব নয়। বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিক শাসন–শোষণের উৎপীড়ন নির্বাণে আপামর জনশক্তির সম্মিলন ছিল অনিবার্য নির্যাস। এই লক্ষ্যেই ১৯৬৯, ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে এই অঞ্চলের নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। ১৯৭০, ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় এবং ২৮ অক্টোবর বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে বাঙালির মুক্তিসনদ ছয় দফা বাস্তবায়নে আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। এটি সকলেরই জানা যে, ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ একক ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ৩ জানুয়ারি, ১৯৭১ রেসকোর্সের জনসভায় সকল নির্বাচিত সদস্যদের ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি আনুগত্য থাকার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শপথ অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়।
২৮ জানুয়রি, ১৯৭১ ভুট্টোর সাথে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী আলোচনা ব্যর্থ হলে ১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহবান করে ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য বৈঠক স্থগিতের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সামরিকজান্তার অপশাসন অব্যাহত রাখার কূটচক্রান্তের বিরুদ্ধে দেশবাসী প্রকম্পিত প্রক্ষোভে বজ্রকঠিন ব্রত সঞ্চারিত হয় এবং ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহবানে দেশব্যাপী স্বত:স্ফূর্ত হরতাল পালন করেন। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লক্ষাধিক বাঙালির সম্মুখে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু প্রকৃত অর্থেই বাঙালি জাতি–সত্তার উন্মেষ ঘটিয়ে দীর্ঘ অহিংস স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে অর্জিত স্বাধীনতাকেই অর্থবহ আনুষ্ঠানিকতা প্রদান করেন। এটি কালপরিক্রমায় খ্যাতিমান রাজনীতিক, গবেষক, বুদ্ধিজীবীসহ সকল মহলে কালজয়ী, যুগান্তকারী ও বিশ্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে সমাদৃত এবং সর্বোপরি বিশ্বসভায় ঐতিহাসিক নান্দনিক ঐতিহ্যিক দলিল হিসেবে গৃহীত।
পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ২৫ মার্চ কালো রাত্রে বিশ্ব ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা শুরু করে লক্ষ লক্ষ বাঙালির প্রাণসংহারে মেতে ওঠে। সে রাতেই পাকিস্তানি জান্তার হাতে গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা–বার্তায় পুরোবিশ্বকে অবহিত করে বলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ ১০ এপ্রিল ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে প্রবাসী সরকার ঘোষিত হয় এবং এই সরকার কুষ্টিয়ার মেহেরপুর, বৈদ্যনাথতলায় ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করেন। শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সহ–রাষ্ট্রপতি এবং শহীদ তাজউদ্দিন আহম্মদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁদের নেতৃত্বে সশস্ত্র মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর প্রায় একানব্বই হাজার পাকিস্তান সেনা বাহিনীর দানব সদস্যদের আত্নসমর্পণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
মুক্তির মহানায়ক জাতির জনকের নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধীকার ও স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রাম বঙ্গবন্ধুর ভাষায় -‘অবর্ণনীয় দুঃখ–দুর্দশা, অত্যাচার, নীপিড়ন– নির্যাতন, গণমানুষের রক্তক্ষরণ ও মুমূর্ষ নরনারীর আর্তনাদের করুণ ইতিহাস।’ অহর্নিশ ত্যাগঋদ্ধ বঙ্গবন্ধুর জীবনগাঁথা। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে তৎকালিন রেসকোর্স ময়দানে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি তোফায়েল আহমদের আহবানে প্রায় দশ লক্ষ ছাত্র–জনতা কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে অভিষিক্ত করেন। ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বনেতার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ অর্পণ করেন। চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে প্রাপ্ত এই বিরল সম্মান বঙ্গবন্ধুর আগে অর্জন করেছিলেন কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো, চিলির সার্ভে আলেন্দে, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, ভিয়েতনামের হো চি মিন, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসেন ম্যান্ডেলা, ভারতের মুলকরাজ আনন্দ ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী।
১৯৭৩ সালের ২৩ মে ঢাকায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণে বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মানিত মহাসচিব রমেশচন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বশান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নির্ভিক কান্ডারী এবং বিশ্বের সকল নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষণবঞ্চনার শিকারে বিপন্ন জনগণের অধিকার আদায়ে তৎকালীন সময়ের জীবন্ত কিংবদন্তী বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ববন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেদিন থেকেই বাঙালির বঙ্গবন্ধু নতুন অভিধায় বিশ্বপরিমন্ডলে আবাহিত হলেন ‘বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিব’। নিঃসন্দেহে দৃঢ়তার সাথে বলা যায়, বঙ্গবন্ধু যে গণতান্ত্রিক–অসাম্প্রদায়িক–শোষণমুক্ত–মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাঙালিকে প্রস্তুত করেছিলেন। মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর পেয়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত এক ক্ষত–বিক্ষত ধ্বংসযজ্ঞের অবশিষ্ট দেশ–মাটি ও মানুষ। তীব্র খাদ্য–বস্ত্র–বাসস্থান, কলকারখানায় শূন্য উৎপাদন, পরিপূর্ণ বিপর্যস্ত সকল পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনসহ বহুমুখী সংকটের ক্ষুধিত কাঠিন্য। ১৯৭২, ১০ এপ্রিল গণপরিষদের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ছিল, ‘আমার যারা পশ্চিম পাকিস্তানে আছে, তারা যুদ্ধাপরাধী নয়। তারা সেখানে কাজ করছিলেন, তাদের ফেরত দিতে হবে। এখানে পাকিস্তানের যারা আছে তারা যদি এখানে থাকবার না চায় তাদেরও আমি ফেরত দিতে রাজি আছি। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী যারা এদেশে পাশবিক অত্যাচার করেছে, লুট করেছে, হত্যা করেছে এবং যারা ইন্টারন্যাশনাল আইন মানে নাই, তাদের এখানে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে।’
জাতি বিস্মৃত নয় যে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর একাত্মা দর্শন বিশ্বে সমাদৃত। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে চরম অর্থনৈতিক নাজুক অবস্থায়ও বঙ্গবন্ধু বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণে বলেন, ‘নীতিগত প্রশ্নে সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ওপর জবরদস্তি কিছু চাপিয়ে দেয়া চলবে না। দেশের এই মুহূর্তের অবস্থা যাই হোক না কেন–দেশের স্বার্থেই স্বাধীন ভূমিকার কোনো হেরফের হবে না। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ কর্মশক্তিতে বলিয়ান – দেশকে গড়ে তুলতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। আমাদের প্রত্যেকের আছে দুটি বাহু। আমাদের বাহুর সাহায্যে প্রকৃতির অকৃপণ দান উর্বর মাটি থেকে আমরা আমাদের গ্রাসাচ্ছাদন যুগিয়ে নিতে পারব। দাতামহল দাবি না ছাড়লে আগামীকালই তারা চলে যেতে পারেন। আমরা সাহায্য নেব না। ওইসব শর্তে আমরা সাহায্য নিতে পারি না।’
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মহান স্বাধীনতার অব্যবহিত–স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সূচনা থেকেই দেশ পুনরুদ্ধারে সামগ্রিক সকল খাতকেই বিবেচনায় এনেছেন। দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে নির্মিত উন্নয়ন–ধর্মীয়–স্বজাত্যবোধ–দেশপ্রেম–দুর্নীতি নির্মূল–কৃষি ও শিল্প উৎপাদন–অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধি–সোনার বাংলা বিনির্মাণের প্রতিটি দার্শনিক ভিত্তিকে উম্মিলিত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি নির্দেশনার আলোকে বর্তমান সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কর্মযজ্ঞ সুচারুরূপে সুসম্পন্ন করার লক্ষ্যে অদম্য অগ্রগতিতে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ব্রত গ্রহণ করেছেন। বিগত একযুগ ধরে প্রজ্ঞা–মেধা–সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কার্যকর বাস্তবায়নে দেশ আজ বিশ্ব পরিমন্ডলে উন্নয়নের রোল মডেলের অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর অধিকতর শক্তিমানতায় সকল অপশক্তির অশুভ অপপ্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ বিজয়ী থাকবেই। এই প্রত্যাশায় খ্যাতিমান কবি অজয় দাশগুপ্ত রচিত ‘বঙ্গবন্ধু: আদিগন্ত যে সূর্য’ কবিতার পংক্তি উপস্থাপনে নিবন্ধের ইতি টানছি। “বাঙালি কি বাঙালি হয় শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি ছাড়া/ থাকে না তার বর্গ কিছুই না থাকলে টুঙ্গিপাড়া/ সুর–অসুরে হয় ইতিহাস, নেই কিছু এ দু’জীব ছাড়া/বাংলাদেশের ইতিহাসে দেবতা নেই মুজিব ছাড়া/ …. বাংলাদেশের মুক্তিও নেই মুজিব নামের সূর্য ছাড়া”।
লেখক
শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়