আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেয়। স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে আগামী দিনের দিকনির্দেশনা, সাংবিধানিক ও যৌক্তিক অধিকার রক্ষা এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের জন্য মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। পরিস্থিতি ও ঐতিহাসিক বিবেচনায় অনেকেই এ সরকারকে বিপ্লবী ও প্রবাসী সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত এবং নির্দেশিত পথে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের জন্যই মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি), তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। এ সরকার প্রথমেই বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে সমর্থন ও অনুমোদন করে।
মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের পর মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ পরিচালনার জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। মুজিবনগর সরকারই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। মুজিবনগর সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করতে ভারত রাজি হয়। তাজউদ্দিন আহমেদ যখন ১৯৭১ এর ৪ এপ্রিল ভারত সরকারের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সহায়তার জন্য গিয়েছিলেন তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য কোন সরকার গঠিত হয়েছে কিনা। তখন তাজউদ্দিন জবাব দিয়েছিলেন- মুজিবনগর সরকার গঠনের কথা। মূলত ৪ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে এই সরকারের কার্যক্রম শুরু হয়।
এ দিনটি এবারও এসেছে নজিরবিহীন এক সঙ্কটের মধ্যে। বিশ্বজুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করা নভেল করোনাভাইরাস বাঙালিকেও ঘরে থাকতে বাধ্য করছে। এর আগে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। সারা দেশে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন। এ অবস্থায় দিবসটি আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালিত না হলেও এর গুরুত্ব অত্যধিক। কেননা মুজিবনগর সরকার স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের শেকড়। এই সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বে বৈধতা পেয়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সঠিক পথে পরিচালিত করে বাঙালি জাতির বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সরকারের নয় মাসের কার্যক্রম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাই এই দিবসে আমাদের প্রতিজ্ঞা হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে আত্মনিয়োগ করা।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। এইচটি ইমাম ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫’ নামে যে তথ্যবহুল বইটি লিখেছেন, সেখানে বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কবলমুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। এই ইতিহাসের সঙ্গে প্রথম বাংলাদেশ সরকার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, শরণার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা মেটানো, অধিকৃত বাংলাদেশে প্রশাসন ব্যবস্থাপনা সামলানো, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, খাদ্য রশদ সংগ্রহ, চিকিৎসাসেবা দান, পররাষ্ট্রবিষয়ক তৎপরতা সচল রাখা ইত্যাদি যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় প্রথম বাংলাদেশ সরকারের যেসব মন্ত্রী, কর্মকর্তা, কর্মী, কর্মচারী সংশ্লিষ্ট ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে তাদের নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি মাইলফলক। তাই আজকের মুজিবনগর দিবসে আমাদের শপথ হোক- বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে যাবো। মনে রাখতে হবে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ে দেয়। এই সত্যকে যারা অস্বীকার করে তারা বাংলাদেশকেও স্বীকার করে না। প্রজন্মের সন্তানদের ইতিহাসের সত্য সঠিকভাবে ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিবেদিত হতে হবে।