স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রসেনানী আবদুল্লাহ আল হারুন

হাসানুল হক ইনু | বুধবার , ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:৩৮ পূর্বাহ্ণ

এই বাংলাদেশ আমরা একদিনে অর্জন করিনি।এর অতীতে বহু কষ্টকর রাজনৈতিক সংগ্রাম ছিল। ছাত্রযুবকদের দৃঢ়চেতা আন্দোলন ছিল এবং সবকিছুর উপরে বঙ্গবন্ধুর সাহসী, দূরদর্শী বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছিল। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, স্বাধীনতাপূর্ব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কার্যকলাপে বহু পার্থক্য রয়েছে। আবদুল্লাহ আলহারুন সাহেবের বিশেষত্ব এখানে, তিনি স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। যদিও উনি ঢাকাতে অবস্থান করতেন না তবুও বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দরনগরী চট্টগ্রামে থেকেও তিনি জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোতধারায় বিভিন্নভাবে তিনি সামনের কাতারে নিজের অবস্থান তৈরী করেছিলেন। আমি ষাটের দশকে বুয়েটে ছাত্র হিসাবে ছাত্রলীগের কর্মীর দায়িত্ব পালন করতাম। কিন্ত তৎকালীন রাজনৈতিক মূল বিষয়টি অর্থাৎ পাকিস্তান থাকবে কি থাকবে না সে বিষয়টি ওপর যখন সারা বাংলাদেশে আলোচনা, তর্কবিতর্ক চলছিল তখন চট্টগ্রামের কতিপয় নেতার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। তারা হলেন, এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম .. হান্নান । তারপরে নামটা বলতে হলে আবদুল্লাহ আল হারুনের নামটা আমাকে বলতে হয়।

আজকের বাংলাদেশে আমি তৎকালীন আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের বহু কর্মীকে বঙ্গবন্ধু বলতে অজ্ঞান হতে দেখি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের এক একজন সৈনিক হিসাবে দাবিও করেন। ষাটের দশকের ছবিটা ভিন্ন রকমের ছিল।এদের বহুজনই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং ৬ দফার বিরুদ্ধে কেউ কেউ অবস্থান নিয়েছিলো। কারো কারো নিষ্ক্রিয় ভূমিকা ছিল। আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্য হলেও, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সেই ধারার সাথে যুক্ত ছিলাম, যে ধারা বঙ্গবন্ধুর প্রণীত ছয় দফা দাবির উপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বপ্ন দেখে। ব্যক্তিগতভাবে আমি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতাম এবং ৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র তৈরীর অবৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডকে অস্বীকার করতাম।

ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগে দুই ধারায় বিভক্ত ছিল। একটি ধারা পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে বাঙালীর অধিকার রক্ষা করা তথা পকিস্তানকে স্বীকার করে নিয়ে রাজনীতি চর্চা করা । আর দ্বিতীয় ধারাটি ছিল পাকিস্তানি কাঠামোর ভেতরে থেকে বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়,এই মতাবাদের বিশ্বাসী। একমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশেই হচ্ছে রাজনৈতিক সমাধান। ৬৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাহোরে ৬ দফা প্রকাশ করার মধ্যদিয়ে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল স্বাধীন বাংলাদেশেই হচ্ছে রাজনৈতিক সমাধান। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বীজ বপন করলেন।

তৎকালীন পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা ঝড় উঠলো এবং আওয়ামী লীগছাত্রলীগ সবাইকে একটা অগ্নিপরীক্ষায় নিক্ষেপ করলো। ঢাকাতে পরিষ্কারভাবে আওয়ামী লীগছাত্রলীগের বিভক্তি দেখা দিলো। ৬ দফার পক্ষবিপক্ষে এ দুইটি ধারা পরিষ্কার হয়ে উঠলো। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার দৃঢ় ঘাঁটিতে পরিণত হলো। তখন চট্টগ্রাম আমাদের সবার দৃষ্টি কাড়লো। আমরা দেখলাম চট্টগ্রামের ছয়জন নেতা ৬দফাকে সমর্থন জানিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকে একটি বিবৃতি দেন । বিবৃতিদাতাদের মধ্যে অত্যতম ছিলেন আবদুল্লাহ আল হারুন । এই বিবৃতি সারা দেশে ৬দফার আন্দোলকে নতুন পথের সন্ধান দেয় ও আন্দোলনকে বেগবান করে। শুধু তাই নয় ৬৬ সালের ২৫ ফেবু্রয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে আবদুল্লাহ আল হারুন, এম এ আজিজের নেতৃত্বে বিশাল জনসভার আয়োজন করলেন। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার পক্ষে বক্তব্য রাখলেন তারা। এইভাবে জাতীয় রাজনীতিতে আবদুল্লাহ আল হারুন একজন বলিষ্ঠ, দৃঢ়চেতা নেতা হিসাবে অগ্নিপরীক্ষার উত্তীর্ণ হলেন।

এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল হারুন ও এম এ হান্নানের মত নেতারা যদি চট্টগ্রামে না থাকতো তাহলে চট্টগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রামের শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হতো না । এদের কারণে ৭০ এর নির্বাচনে চট্টগ্রামের রাউজান হতে ফজলুল কাদের চৌধরী বিজয়ী হতে পারিনি। লালদিঘির জনসভা,৬ দফার সমর্থনে বিবৃতি ইত্যাদি ঘটনাগুলো ছোট ছোট মনে হলে ও সেই সময়ের মাপকাঠি বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর কাছে এ ঘটনা ছিল বিশাল। চট্টগ্রামের এসব দৃঢ়চেতা নেতাদের পেয়েছিলেন বলে বঙ্গবন্ধু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন। আবদুল্লাহ আল হারুন সেজন্য ছাত্রলীগআওয়ামী লীগ সবার কাছে একজন প্রিয়ভাজন নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। ছাত্রলীগের যে ধারাটা ৬ দফার পক্ষে ছিল,স্বধীনতার পক্ষে ছিল তাদের সাথে আবদুল্লাহ আল হারুনের সম্পর্ককে আরো গভীর করেছে। চট্টগ্রামের ছাত্রযুব সমাজকে নেতৃত্ব দিয়ে,অর্থ দিয়ে স্বাধীনতা স্রোতধারা বেগবান করলেন। সেই দিকে আমি মনে করি স্বাধীনতা যুদ্ধের, সংগ্রামের একজন অগ্রসেনা আবদুল্লাহ আল হারুন।

আমি ঢাকাতে বসবাস করলেও ’৭০ এর নির্বাচনে কেন্দ্রের নির্দেশে সাতকানিয়ার পাকিস্তান গণপরিষদে এম এন এ প্রার্থী আবু সালেহ’র পক্ষে একমাস নির্বাচনী কাজে সাতকানিয়া ঘাটিঁ গেড়েছিলাম। এম এ আজিজ, আবদুল্লাহ আল হারুন,সালেহ ভাই এসব ব্যক্তিবর্গ যারা ৬ দফার পক্ষে দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করবেন তাদেরকে নির্বাচনে বিজয়ী করা তখন ছাত্রযুবসমাজের ঐতিহাসিক দায়িত্ব ছিল। তখন তারা সবাই বিজয়ী হয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে’৭০ এর নির্বাচন হচ্ছে পাকিস্তান পতনের মূল রাজনৈতিক করচা। ’৭০ নির্বাচনে প্রার্থীরা জনগণের কাছে বাঙালীদের স্বাধীনতা পক্ষে গণরায় তুলে ধরে । পাকিস্তানিরা এটা বাস্তবায়ন করেনি বলে যুদ্ধ হয়েছে। সুতরাং এ গণরায় বাস্তবায়ানে ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়।

আবদুল্লাহ আল হারুন ৬ দফাকে জনপ্রিয় করার জন্য যেভাবে সামনে থেকে কাজ করেছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধকে ও সংঘটিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। ২৮ মার্চ ১৯৭১ সালে আবদুল্লাহ আল হারুন, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকীসহ আগরতলায় যান এবং সেখানকার মুখ্যমন্ত্রির সাথে দেখা করে বাঙালিদের পক্ষে সমর্থন চান। শুধু তাই নয়, তিনি সেখান থেকে ২ এপ্রিল জাতিসংঘের মহাসচিব উ. থান্টকে বাংলাদেশের গণহত্যার বিবরণ দিয়ে চিঠি লেখেন। এই যে চিঠি লেখা, যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো তাহলে উনি আর বাংলাদেশে ফিরতে পারতেন না । তিনি এতটা দৃঢ়চেতা ছিলেন। তিনি ঝুঁকি নিয়ে জাতিসংঘে চিঠি লেখেন এবং এ চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। তখন বাংলাদেশের এতোজন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন, কিন্তু তিনিসহ কয়েকজন মিলে জাতিসংঘে এ চিঠি লেখেন। এ থেকে বুঝা যায়, কত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা ছিলেন তিনি। এসব কারণে আবদুল্লাহ আল হারুনকে মু্‌্‌কি্তযুদ্ধের একজন বীর সেনানী হিসাবে জানি।

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতেহাস লিখতে হলে পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের এই যে পাকিস্তানের রিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং স্বাধীন বাংলাদেশের যে প্রস্তুুতি ,এ প্রস্তুতিতে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, অবশ্যই তারা ‘নমস্য’ ব্যাক্তি এবং তাদের কর্মকান্ড বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস যারা লেখার চেষ্টা করেন তারা খন্ডিত ইতিহাস লেখেন। আমি মনে করি রাজনৈতিক যুদ্ধে আমরা পাকিস্তানিদের পরাজিত করেছি। তারপরে সামরিক যুদ্ধে পরাজিত করেছি। তার আগে রাজনৈতিক যুদ্ধে, রাজনৈতিক চালে নির্বাচনী যুদ্ধে,আন্দোলন যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়েছি। তারপরে ১৯৭১ সালে আমরা সামরিক যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি।

আবদুল্লাহ আল হারুন নির্বাচনী যুদ্ধের নেতা, ষাটের দশকের আন্দোলনের নেতা এবং রাজনৈতিক চালচলনের ও নেতা। যথাযথভাবে এ তিন স্তরের সফল নেতা হিসাবে তিনি ৭১ এর সামরিক যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বীর বেশে ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে প্রবেশ করেন। আবদুল্লাহ আল হারুন নতুন প্রজন্মের কাছে একজন অনুকরণীয় নেতৃত্ব। নীতির প্রশ্নে কখনো ছাড় দিতে হয় না, এ শিক্ষা আবদুল্লাহ আল হারুন দিয়ে গেছেন।

নেতার প্রতি অবিচল আস্থা রাখতে হয় এই শিক্ষা ও তিনি দিয়ে গেছেন। কৌশলে এদিকসেদিক হতে পারে কিন্ত নীতিতে কোন ছাড় দেয়া যাবে না। নেতার প্রতি অবিচল বিশ্বাস রাখতে হয় এবং নীতি বাস্তবায়নের সাহস দেখাতে হয় । এ তিনটা গুণই তার মধ্যে ছিল। আবদুল্লাহ আল হারুন বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।

লেখক : সাবেক তথ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, সভাপতিজাসদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ