বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা পালন করছি। এ সময়ে হিসেব নিকেশ করলে দেখা যাবে আমাদের প্রাপ্তির সীমা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। আমাদের নতুন প্রাপ্তি হলো, কমনওয়েলথভুক্ত দেশের সরকার প্রধানদের মধ্যে অন্যতম সফল এবং অনুকরণীয় তিনজন মহিলা সরকার প্রধানের একজন হলেন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষে নতুন এ প্রাপ্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
বিশ্ব নারী দিবসের দিনে কমনওয়েলথের মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড কিউসি কমনওয়েলথভুক্ত দেশের সরকার প্রধানের তিনজন অনুকরণীয় মহিলা সরকার প্রধানের নাম ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও অন্য দু’জন সরকার প্রধান হলেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অডুর্ন এবং বারবাডোজের প্রধানমন্ত্রী মিয়া আমোর মোতলি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এটিই প্রথম নয়। ইতিপূর্বে ফোর্বস ম্যাগাজিনসহ অনেক অনেক আন্তর্জাতিক মাধ্যমেই তিনি বিশ্বের সেরা নেতৃত্বের একজনের স্বীকৃতি পেয়েছেন। দেশের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ অনেক যুগান্তকারী অর্জন সাধিত হয়েছে তাঁর নেতৃত্বে। সাম্প্রতিক সময়ে পুরোবিশ্ব করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত, অর্থনীতি পর্যুদস্ত। এ সময়ে শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে করোনা মহামারী রোধসহ দেশের মানুষের মাঝে করোনা প্রতিরোধে ভ্যাকসিন প্রদানে দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী সফলতা এবং উন্নয়শীল দেশের স্বীকৃতি লাভের মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী অর্জন পুরোবিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে। শেখ হাসিনা কোন শক্তিশালী দেশের সরকার প্রধান না হয়েও তার ক্যারেশমেটিক নেতৃত্বের যোগ্যতার কারণে উন্নয়নশীল দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সফলতা এবং অর্জন এতটাই বেশি যে, বিশ্ব গণমাধ্যম নানাভাবে আলোচনা করতে বাধ্য হয়েছে। রিফিউজি বিষয়ক সমস্যা নিয়ে বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলো যেখানে ইউরোপের অনেক দেশের ব্যর্থতার জন্য সমালোচিত সেখানে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সমস্যা সফলভাবে ম্যানেজ করার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী উচ্ছ্বসিত প্রশংসা অর্জন করেছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সময়ে এতকিছু অর্জনের পরেও সমালোচনা এবং ষড়যন্ত্র থেমে নেই। ষড়যন্ত্রকারীরা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমকে ব্যবহার করে শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণে চরিত্র হনন করার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। তাঁর অর্জনগুলোকে ম্লান করার জন্য স্বার্থানেষী মহল দেশ-বিদেশে চক্রান্ত ও অপপ্রচার করেই চলেছে। আল-জাজিরার মতো বিতর্কিত সংবাদ মাধ্যম ব্যবহার করে সরকারের সকল অর্জন এবং সফলতাকে হেয় করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে অনেকে সরকারের ধারাবাহিক সফলতা ও অর্জন এবং সরকার প্রধানের পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের অর্থনৈতিক উন্নতি, শিল্প বিনিয়োগে অভাবিত সাফল্য দুষ্ট লোকদের মাঝে হিংসার উদ্রেক করে চলেছে। প্রতিনিয়ত এসব অর্জনকে ব্যর্থ করার হীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। সরকারের ধারাবাহিক সফলতার পাশাপাশি কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। নারী বৈষম্যের মাধ্যমে নারীদের যৌন হয়রানি, কিশোরী নির্যাতন সহ সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ‘কিশোর অপরাধ বা কিশোর গ্যাং’ বিষয়ক কাহিনী।
সংবাদপত্রে এ বিষয়ে যখনি নজরে আসে মনে হয় সরকারের সফলতাকে ম্লান করে দেয়ার জন্য এধরনের দুয়েকটি ঘটনাই যথেষ্ট। জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে কিশোর কিশোরীর সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখ। কিশোর অপরাধের হারে ২০১২ সালে ৪৮৪টি মামলা হয়েছে ৭৫১ জনকে আসামী করা হয়েছে। ২০২০ সালে এসে জানুয়ারি হতে জুন ছয়মাসের হারে লক্ষ্য করা যায় মামলার সংখ্যা ৮১২ টি, আসামীর সংখ্যা ১১৯১।
কিশোর অপরাধের ধরণ আমরা অতীতে দেখেছি, চুরি ও পকেটমারি। কিন্তু বর্তমানে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে হচ্ছে মাদক, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ও মারামারি। এছাড়াও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে এবং প্রশ্রয়ে তৈরী হচ্ছে “কিশোর গ্যাং”।
কিশোরেরা কেন অপরাধে জড়াচ্ছে? তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা থাকলেও সরকারের বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর তাতে কোন আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়না বা হচ্ছেনা। তাই ভালো ভালো আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হলেও সে সব আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ হতে জানানো হচ্ছে, কিশোরদের অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা কমেনি বরং প্রকোপ ও পরিধি দুই-ই বেড়েছে। এমন কি তারা “টিকটক লাইকি” এর ন্যায় বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন গ্যাং গড়ে তুলছে। ‘টিকটকের’ নায়িকা বানানোর টোপ দিয়ে কিশোরী ধর্ষণের মতো অপরাধের মামলাও হয়েছে। কিশোরেরা জড়িয়ে পড়েছে জঙ্গিবাদেও। ইমপ্লিকেশন অ্যান অ্যানথ্রোপনজিক্যাল স্ট্যাডি শিরোনামে এক গবেষণায় ২০১৭ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাবিনা শারমিন বলেছেন, সমাজ বিজ্ঞান বলছে, পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও বন্ধু বান্ধব, কিশোরদের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারে। একে বলা হয় সামাজিক নিয়ন্ত্রণ। এ নিয়ন্ত্রণ বর্তমানে বিনষ্ট হয়ে গেছে। আগে কিশোররা প্রকাশ্যে ধূমপান করলে পাড়ার মুরব্বিরা শাসন করতেন। এখন তারা নিজেরা ভয় পান। প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের সঙ্গে অভিভাবকেরা অনেক সময় তাল মেলাতে পারছেন না। সন্তান কি করে সময় কাটায়, ডিজিটাল ডিভাইসে কি কি করে তাঁরা বুঝে উঠতে পারেন না।
এ অঞ্চলে কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ নিয়ে প্রথম ১৯৬০ সালে গবেষণা করা হয়। তখন পুলিশের জন্য ‘স্ট্যাডিজ ইন জুভেলাইন ডেলিনকোয়েন্সি এ্যান্ড ক্রাইম ইন ইষ্ট পাকিস্তান’ শিরোনামে একটি গবেষণা করেন কলেজ অব স্যোশাল ওয়েলফেয়ার রিসার্চ সেন্টারের গবেষক সালাহ উদ্দিন আহমেদ।
পাকিস্তান আমলে কিশোরদের অপরাধে শীর্ষে ছিল, চুরি আর পকেটমার। বর্তমানে তারা ক্রমশ মাদক, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ও মারামারির ন্যায় অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।
সন্তানদের যদি আমরা সত্যিকারভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ মনে করি, তাহলে নিচ্ছুপ বসে থাকলে চলবেনা। যে অবস্থায় আমরা এখন আছি, একে সামাজিক অবক্ষয়ের বিপজ্জনক পর্যায় বলা যেতে পারে। এত্থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে হবে। কিশোরেরা যখন ভয়ানক সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তখন ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র কেউ মুখ ফিরিয়ে বসে থাকতে পারেনা। পরিবারের মাধ্যমে, স্কুল, কলেজ, পাঠশালায়, সমাজের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং ধর্মীয় ব্যবস্থাপনাকে কাজে লাগিয়ে এর প্রতিকার করা এবং সমাধান সম্ভব। শিশুদের নৈতিকতা শেখানো হবে, ভালো মন্দের পার্থক্য বোঝানো হবে যে, সেরকম আমরা বাল্য শিক্ষায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন নীতিবাক্য অতীতে পড়ে আসছি। বর্তমানে তা নতুনভাবে পড়াতে হবে ‘সদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা কথা মহাপাপ, গুরু জনকে ভক্তি করিবে।’ অতীতের এসব নৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষার স্থলে আজকাল আগডুম বাকডুম জাতীয় বিষয়ে পড়িয়ে শিশুদের মনোজগতকে অন্য দিকে ধাবিত করা হচ্ছে। নিয়মানুবর্তিতা, বড়দের সম্মান করা, মাদককে না বলার শিক্ষা দেয়া এখন জরুরি। ছেলে মেয়েরা যাতে একে অপরকে সম্মান করতে শেখে, ভিন্ন ধর্ম-বর্ণ মত বর্ণের প্রতি শিশু বয়সেই শ্রদ্ধাশীল হতে পারে সে বিষয়ে নিশ্চিত করে তা পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
শিক্ষকদেরকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত করতে হবে। ক্লাব বিষয়ে এবং ক্লাবের বা বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাদেরকে জড়িত করে তাদের অংশগ্রহণ এবং পাঠ্যসূচিতে তা অন্তর্ভুক্তি খুবই জরুরি।
আনন্দজনক ব্যবস্থাপনা, তরুণ ক্রীড়াবিদ, গায়ক, অভিনেতা, আবৃত্তিকার, কবি, সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণে শিক্ষা কার্যক্রমকে প্রাথমিক পর্যায় হতে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন সকলের আন্তরিকতা ও বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের সবার সদিচ্ছার প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে শিশুদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে গবেষণা কার্য্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি এবং শিশু মনোতোষ গঠনের কারিগর শিশু সাহিত্যিকরা এবিষয়ে জোড়ালো ভূমিকা রাখতে পারে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা, হেফজখানা, এতিমখানার ন্যায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের নজরদারিতে রেখে শিশুদের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক শিল্পকলা বিষয়ে তাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা পরিসংখ্যানে দেখেছি, যে সব শিশু কিশোর নাচ, গান, নৃত্যকলা, শিল্পকলা, লেখালেখি সহ খেলাধুলার মাঝে সম্পৃক্ত রয়েছে তাদের মাঝে অপরাধ প্রবণতা খুবই কম। গবেষণার মাধ্যমে আমাদের জনসংখ্যার ৩ কোটি ৬০ লাখ কিশোর কিশোরীদেরকে অপরাধ মুক্ত করতে পারলে উন্নয়নশীল দেশে কর্মীর ও সুনাগরিকের কোন অভাব হবে না। সুতরাং স্বাধীনতার এ সুবর্ণজয়ন্তীর এ সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনেক অর্জনের পাশাপাশি আমাদের কোমলমতি কিশোর কিশোরীদেরকে আদর্শিক ও নৈতিকতার শিক্ষায় শিক্ষিত করে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে উজ্জ্বলতর হবে। একটি সুন্দর সমাজ আমরা পরবর্তীদের জন্য উপহার দিতে পারব। আইনের কঠোরতায় এসব কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পাবে। সে পথে না গিয়ে সংশোধন ও ভালোবাসার হাত ধরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিবেন বলে আমরা আশা করি।
[সূত্র : ১৭ নভেম্বর ২০২০এ প্রকাশিত ‘প্রথম আলো’ এবং বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত গবেষণালব্ধ প্রবন্ধাদি এবং সংবাদপত্র।]
লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, শিল্পশৈলী