কয়েকদিন আগে পতেংগা সমুদ্র সৈকতের পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হলো। দেখছিলাম প্রচণ্ড বাতাসের সাথে সাগরের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছিলো উপকূলে। ঢেউয়ের উচ্ছ্বলতা উপভোগের জন্য সৈকতের পাশে বসতে গিয়ে পড়লাম বিপত্তিতে। দেখি সৈকতের গাইড ওয়ালের সাথে সারি সারি চেয়ার। কোথাও একটু ফাঁক নেই যে গাইড ওয়ালে বসে সমুদ্র দর্শন করবো। বাধ্য হয়ে চেয়ারে বসার সাথে সাথে এক যুবক এসে বললো কী খাবেন? হতচকিত হয়ে বললাম, আমি তো এখানে খেতে আসিনি। যুবক বললো চেয়ারে বসলে খাওয়ার অর্ডার করতে হবে। বললাম অর্ডার না করলে, সে বললো তাহলে চেয়ার থেকে উঠে যান। মান সম্মান রক্ষার্থে বললাম পেঁয়াজু নিয়ে এসো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই যে এখানে চেয়ার পেতে বসেছো, কেউ কিছু বলে না। সে বললো প্রতিদিন এখানে চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করতে হয়। আরো বললো এখানে চাঁদা সংগ্রহের লোক আছে। চাঁদা তুলে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসন, সিডিএ ও সিটি কর্পোরেশনের লোক সবাইকে ভাগ দেয়। ওখানে কিছুক্ষণ বসে সন্ধ্যার পর গেলাম নেভাল একাডেমি এলাকায়। সেখানেও দেখি সারি সারি চেয়ার পাতা। চেয়ারে বসলেই অর্ডার করতে হবে। খবর নিয়ে জানলাম সেখানেও চাঁদা তোলার লোক আছে। টাকা তুলে সব জায়গায় পৌঁছিয়ে দেয়। এটা যে শুধু পতেংগা এলাকার চিত্র তা কিন্তু নয়। পুরো চট্টগ্রাম শহরের অবস্থা একই রকম। শহরের যেই প্রান্ত বা এলাকায় যান না কেন, চোখে পড়বে ফুটপাত জুড়ে অসংখ্য দোকান। রাস্তার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে ভ্যানে করে পণ্য বিক্রি। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিকটু দৃশ্য দেখতে হয় নিউমার্কেট এলাকা। এর আশেপাশে শুধু হকার আর হকার, ভ্যান আর ভ্যান। হঠাৎ করে কেউ চট্টগ্রাম নিউমার্কেট এলাকায় গেলে মনে হবে কোনো বস্তির মধ্যে এসে পড়েছে। ওখানে এমন অবস্থা যে, ফুটপাতের অবৈধ দোকানের জন্য মূল বিল্ডিং পর্যন্ত দেখা যায় না। পুরানো রেল স্টেশন থেকে জুবিলী রোড়, কোর্ট রোড থেকে আন্দরকিল্লা হয়ে জামালখান রোডসহ পুরো এলাকার ফুটপাত ও রাস্তার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে অস্থায়ী দোকান আর ভ্যান। কোথাও এতোটুকু ফাঁকা জায়গা পাওয়া যাবে না পথচারী হাঁটার। ভাবতে অবাক লাগে, একেবারে প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে এই নৈরাজ্য। অথচ এই এলাকা দিয়ে প্রতিদিন প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের লোকজন থেকে শুরু করে শহরের মেয়র সিডিএর চেয়ারম্যান ও জন প্রতিনিধিরা চলাচল করেন। মাঝে মধ্যে জানতে ইচ্ছে করে, ফুটপাত ও রাস্তা দখলের বিষয়টা কি ওনাদের নজরে পড়ে না? নাকি পড়লেও ইচ্ছে করে না দেখার ভান করেন।
যদিও এগুলো অবৈধ দখল করে জীবিকা নির্বাহ করছে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া বহু মানুষ, যা চাইলে উচ্ছেদ করা যায়। কিন্তু বিভিন্ন সরকারি কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার আয়ত্তে থাকা খালি জায়গাগুলোরও অবস্থা আরো খারাপ। কোথাও কোনো খালি জায়গা থাকলেই স্থাপনা তৈরী করতে উঠেপড়ে লাগে। সেটি প্রশাসন বা সিটি কর্পোরেশন বা সিডিএ যার অধীনে থাক না কেন। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো শহরের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি এলাকাটি। বোধহয় রেলওয়ের আয়ত্তে থাকার কারণে এটি এখনো অটুট আছে। না হলে বহু আগে এতে বহুতলা বিল্ডিংসহ নানান বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরী করা হতো।
একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, এক দশক আগেও চট্টগ্রামে যে পরিমাণ খালি জায়গা বা গাছগাছালি ছিলো বর্তমানে তার প্রায় সবই বিলীন এবং এর সবগুলোতে স্থায়ী স্থাপনা তৈরী করা হয়েছে। আর যেগুলোতে আগে স্থাপনা তৈরী করা হয়েছিলো বর্তমানে ঐসব স্থাপনা আরো বর্ধিত করা হচ্ছে বা হবে। কারণ স্থাপনা তৈরী করলেই বাণিজ্যটা ভালো হয়। অর্থাৎ যারা রক্ষক তারাই ভক্ষক হয়ে যায়। ফলে সাধারণ মানুষের প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। তারই প্রতিফলন দেখা যায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিশুকের নেতৃত্বে করা এক জরিপে। গত মে মাসে এই জরিপটি করা হয়। এতে দেখা যায়, চট্টগ্রাম নগরের ২ নম্বর গেটের বিপ্লব উদ্যানের কংক্রিট অবকাঠামোর পরিমাণ প্রায় ৫৫ শতাংশ। অথচ ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী যে কোনো উদ্যানে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের বেশি কংক্রিট অবকাঠামো থাকতে পারবে না। আর আন্তর্জাতিকভাবে ২ শতাংশও অনুমোদন করে না। এই অবস্থায় আবার নতুন করে স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সিটি করপোরেশন। বর্তমানে যে অংশে একতলা দোকান রয়েছে সেটি বর্ধিত করে দোতলা করা হবে। অথচ ওখানে কংক্রিটের চাপে কোনোরকমে টিকে আছে সবুজ।
১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম শহরের গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম ২ নম্বর গেট এলাকায় গাছ গাছালিতে ভরা ২ একরের এই উদ্যানটি গড়ে তোলা হয়েছিলো। এটি ছিলো আশপাশের মানুষের স্বস্তির একটি স্থান। অনেকে সকাল ও বিকেলের সময়টুকু কাটাতেন এখানে। সেই স্বস্তি এখন কেড়ে নিয়েছে কংক্রিটের যন্ত্রণা।
একসময় উদ্যানটি রক্ষণাবেক্ষণ করত সিটি করপোরেশন। ২০১৮ সালে সৌন্দর্য বর্ধনের নামে রি ফর্ম লিমিটেড ও স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেড নামে দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ২০ বছরের জন্য ইজারা দিয়ে দেয় সংস্থাটি। এ জন্য বছরে রাজস্ব ধরা হয় নগণ্য অংক মাত্র এক লাখ টাকা।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইজারা পেয়ে শুরু করে বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরির কাজ। এতে উদ্যানের মূল চরিত্রই পাল্টে যায়। এখন উদ্যানের মূল অংশে গড়ে উঠেছে প্রচুর খাবারের দোকান। একটি–দুটি নয়, এক সারিতেই আছে ১৯টি দোকান। উদ্যানের বড় অংশজুড়ে রয়েছে এসব দোকান ও ক্রেতাদের জন্য বসার স্থান।
দেখা গেছে, উদ্যানের বড় অংশজুড়ে মানুষের যাওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। শুধু হাঁটার পথগুলো খোলা। সেগুলোও কংক্রিটের তৈরি। সবুজের চিহ্ন নেই। উদ্যানে থাকা চারটি বড় গাছও মরে গেছে। এ ছাড়া হাঁটাপথের পাশে একটু পরপর বসার আসন রাখা হয়েছে। দোকানগুলোর সামনের অংশ ঢালাই করা। এর সামনে সারি সারি বসার আসন। উদ্যানের মাঝখানে রয়েছে পানির ফোয়ারা। নিয়মিত পরিষ্কারের অভাবে ময়লা হয়ে আছে সেই ফোয়ারার পানি।
চুয়েটের গবেষক দলের জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদ্যানটিতে সবুজায়নের পরিমাণ বাড়াতে হবে। যেহেতু এই উদ্যানে সব শ্রেণির মানুষের যাতায়াত রয়েছে। সেখানে বাচ্চাদের জন্য আলাদা করে খেলার জায়গা থাকার দরকার ছিল, যা বর্তমানে নেই। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী মানুষদের চলাচলের জন্য যে ধরনের সুবিধা (র্যাম্প) থাকা দরকার, যা অনুপস্থিত।
জরিপ পরিচালনা করা চুয়েটের সহকারী অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সাবেক বোর্ড সদস্য মো. শাহ জালাল মিশুক বলেন, সামপ্রতিক সময়ে বন্দর নগর চট্টগ্রামে প্রকৃতি–পরিবেশকে প্রাধান্য না দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত অবকাঠামো নির্মাণ ও কংক্রিটের ব্যবহারের মাধ্যমে পার্ক–উদ্যানের চরিত্র পরিবর্তন করে ফেলা হচ্ছে। এর ব্যতিক্রম হয়নি বিপ্লব উদ্যানেও। নগরবাসী স্বস্তির জন্য খোঁজে সবুজের সমারোহ সমৃদ্ধ উদ্যান। বিপ্লব উদ্যানে একসময় তাই ছিল। কিন্তু এখন তা হারিয়ে গেছে। তাই নগরবাসীর জন্য এই উদ্যানের আগের চেহারা ফিরিয়ে আনা জরুরি।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।