বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান পাবে ২০২৬ সালের নভেম্বরে। একটি দেশের মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও জলবায়ু এসব সূচকের উপর ভিত্তি করে এ তালিকা করে জাতিসংঘ। এসব সূচকে সক্ষমতা অর্জন করলে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটে। ১৯৭৫ সালে এলডিসি তালিকাভুক্ত হয় বাংলাদেশ। এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা, সহজ শর্তে ঋণসহ নানা রকম সুবিধা পেয়ে থাকে। এসব দেশ যাতে এগিয়ে যেতে পারে সেইজন্য উন্নত দেশগুলো উক্ত সুবিধা দিয়ে থাকে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে একটি দেশের মান–মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক পরিমলে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক ঋণ দাতা সংস্থাগুলোর কাছে ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা বাড়ে। বিদেশী বিনিয়োগও আকৃষ্ট হয়। অবশ্য বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ পরিবেশ বড় ভূমিকা পালন করে।
একটি দেশের সমৃদ্ধি বিবেচনা করা হয় দেশটি কোন শ্রেণিতে আছে তার উপর। অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় উন্নয়নশীল ও উন্নত এই দুই শ্রেণিতে সব দেশকে ভাগ করে থাকে জাতিসংঘ। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যেসব দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম তাদের নিয়ে ১৯৭১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা হয়। বর্তমান বিশ্বে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশ রয়েছে। এলডিসি থেকে কোন দেশ বের হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। পরপর দু’টি ত্রি–বার্ষিক মূল্যায়নে উত্তীর্ণ হলেই এলডিসি থেকে বের হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ করে সিডিপি। এজন্য দেশগুলোকে অবশ্য প্রস্তুতির জন্য তিন বছর সময় দেওয়া হয়। তিন বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অনুমোদিত হলে চূড়ান্ত উত্তরণ ঘটে। সেই হিসেবে ত্রি–বার্ষিক মানদণ্ড উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশ ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু কোভিডের কারণে প্রস্তুতির জন্য আরও দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। এখন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এলডিসি থেকে উত্তরণের সময় আরও পেছাতে চায়। তাদের যুক্তি হলো উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হলে সমস্যায় পড়তে পারে রপ্তানি খাত। বর্তমানে যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পায় বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের পর তা বন্ধ হয়ে যাাবে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপি সুবিধা থাকায় ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে। তবে এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের ঔষধ প্রস্তুতকারক কোম্পানীগুলোকে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য কোন অর্থ দিতে হয় না। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যেকোন দেশ তার দেশে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার উপর নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দিতে পারে। বাংলাদেশ রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স উপর প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা দিয়ে থাকে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে এই প্রণোদনা দিতে পারবে না।
আবার ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা মনে করেন এলডিসি পেছানো গেলে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আঘাত মোকাবিলায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্য, আসিয়ান জোট ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিশ্চিত করা যাবে। কিন্তু বাস্তব কথা হলো বাংলাদেশ এত বছর চেষ্টা করেও কোন একটি দেশের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষর করতে পারেনি। শুধু ভুটানের সাথে একটি পিটিএ বা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। অথচ আমদের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের ৪০টি দেশের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। এতদিন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর না করার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে যেসব দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হবে সেসব দেশকেও সমপরিমাণ শুল্ক ছাড় দিতে হবে। অর্থাৎ আমাদের শুল্ক কাঠামো কমিয়ে আনতে হবে। আমরা এখন যে শুল্ক সুবিধা পেয়ে থাকি এফটিএ স্বাক্ষরিত দেশগুলোও একই রকম শুল্ক সুবিধা পাবে। যে কারণে যেসব দেশের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরিত হবে তাদের কাছ থেকে আমরা কতটুকু লাভবান হতে পারব সেটাও একটা বিবেচ্য বিষয়।
এখন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দেশের রপ্তানী পণ্যে নতুন করে যে শুল্কারোপ করেছে তার সঙ্গে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের কোন সম্পর্ক নেই। আমাদের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় অবদান তৈরিপোশাক খাতের। একসময় বাংলাদেশ শুধু পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করত। মোট রপ্তানি আয়ের ৯৭ শতাংশই আসত এ খাত থেকে। এজন্য পাটকে ‘সোনালী আশ’ হিসেবে অভিহিত করা হতো। তবে কালক্রমে পাটের স্থান দখল করেছে তৈরিপোশাক। বর্তমানে তৈরিপোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ চায়নার পরে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানে রয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ৩ হাজার ৯৩৪ কোটি ৭০ লাখ ডলারের তৈরিপোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ সময়ে মোট রপ্তানির ৮১.৪৯ শতাংশ অবদান ছিল তৈরি পোশাক খাতের। অন্যদিকে গত দুই দশকে চামড়া ও জুতার রপ্তানি বাড়েনি। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ১১৪ কোটি ৫১ লাখ ডলারের চামড়া ও জুতা রপ্তানি হয়েছে। এ সময়ে মোট রপ্তানিতে খাতটির অবদান ২.৩৭ শতাংশ। প্রতিবছর পশু কোরবানীর কারণে আমাদের দেশে চামড়ার প্রাপ্যতা সহজতর হলেও লবণের মূল্যবৃদ্ধিসহ ট্যানারীসমূহে সংরক্ষণ জটিলতার কারণে সেই চামড়া থেকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ থাকলেও তা কাজে লাগাতে পারছি না। এছাড়াও আমাদের এক্সপোর্ট ডাইবারসিফিকেশনের মাধ্যমে রপ্তানি আয় বাড়ানোর জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ প্রচেষ্টা থাকলেও সেটা সম্ভব হয়নি। বরং রপ্তানিতে হিমায়িত খাদ্য, পাট ও চামড়া খাতের অবদান ক্রমেই হ্রাস পেয়েছে। বিপরীতে তৈরিপোশাক খাতের আধিপত্য প্রবল হয়েছে। রপ্তানি আয়ের একক নির্ভরতা দেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে শুল্ক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের দর কষাকষিতে তৈরিপোশাক খাত নির্ভরতা ও ভূ–অর্থনৈতিক সমীকরণের পাশাপাশি ভূ–রাজনৈতিক বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। আমাদের দেশকে বোয়িং ক্রয় ও তুলাসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রকে একচেটিয়াভাবে প্রাধান্য দিতে হয়েছে। এছাড়াও এ খাতে শুল্ক সুবিধা পেতে শুধু অর্থনৈতিক নয় রাজনৈতিক ও মানবাধিকার সংক্রান্ত শর্তও মানতে হয়। রপ্তানির ক্ষেত্রে তৈরিপোশাক খাতের উপর অতি নির্ভরতা একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বৃহৎ রপ্তানির গন্তব্য হওয়ার কারণে অন্য সবকিছু ছাপিয়ে তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের জন্য ভূ–রাজনীতির অংশ হয়ে উঠেছে। তবে ভারতের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ কার্যকর হওয়ায় বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারতের তৈরিপোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আবার ভারতসহ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের এক্সপোর্ট বাস্কেট বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়ায় তারা দর কষাকষিতে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের তালিকায় আরও দুটি দেশ লাওস ও নেপাল আছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২৮২০ ডলার। লাওস ও নেপালের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে কম। এখন বাংলাদেশের থেকে কম মাথাপিছু আয় হওয়া সত্ত্বেও এই দু’টি দেশ এলডিসি থেকে ২০২৬ সালে বের হয়ে যাবে।
বিশ্ব দরবারে আমাদের দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা সূচকে যে উন্নতি হয়েছে সেটাকে পাশ কাটানোর কোন সুযোগ নেই। কারণ পরপর দু’বার ত্রি–বার্ষিক মূল্যায়নে বাংলাদেশ সবগুলো সূচকে উত্তীর্ণ হয়েছে। ব্যবসায়ীরা তিন থেকে পাঁচ বছর এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পিছিয়ে দেয়ার যে দাবী জানিয়েছেন তার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতিসংঘে আবেদন করতে হবে এবং তা সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ অধিবেশনে অনুমোদিত হতে হবে। এই অনুমোদন পেতে বর্তমান সরকারকে বাস্তবসম্মত যুক্তি উপস্থাপন করে কুটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তবে অর্থনৈতিক সূচক বিবেচনায় কতটা সফল হবে জাতিসংঘের মূল্যায়নের উপর তা নির্ভর করবে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের দেশ বৈশ্বিক বাণিজ্যে কতটা লাভবান হবে তাও বিবেচনায় রাখা দরকার। লেখক : নাট্যকার ও উপ–সচিব, সিসিসিআই।