স্বর্ণ আমদানির সরল পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা দরকার

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ৭ অক্টোবর, ২০২৫ at ১১:১০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের মহিলাদের জন্য সোনা আভিজাত্যের প্রতীক। দেশে এমন একজন মহিলাও পাওয়া যাবে না, যার কাছে কিছু পরিমাণ সোনা না আছে। অথচ দেশে বিক্রিত সোনার পুরোটাই অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করে। বিষয়টি দেশের নীতিনির্ধারকরা সবাই জানেন। এরপরেও বিগত ৫৪ বছরে সোনা আমদানির একটি টেকসই পদ্ধতি আমরা চালু করতে পারিনি। যা সত্যিই দুঃখজনক। বাংলাদেশে বৈধভাবে সোনা আমদানির নির্দিষ্ট কোনো বার্ষিক পরিমাণ উল্লেখ নেই, তবে ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিলেও সেগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সরকার যাত্রীদের ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমে সীমিত পরিমাণে সোনা আনার সুযোগ দিয়ে থাকে, কিন্তু এই পদ্ধতিতে আসা সোনার পরিমাণ খুবই নগণ্য এবং যা মোট চাহিদার অতি সামান্য।

বর্তমান ব্যাগেজ রুলসের আওতায় একজন যাত্রী বছরে একবার সর্বোচ্চ ১০ ভরি (প্রায় ১১৭ গ্রাম) ওজনের গহনা, স্বর্ণবার বা স্বর্ণপিণ্ড আনতে পারেন, যার জন্য শুল্ক দিতে হয় না। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে সোনা আমদানির লাইসেন্স দিয়েছিল, ২০২৩ সালে সেগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ঐ চার বছরে বৈধ পথে দেশে মাত্র ১৪৫ কেজি সোনা এসেছে। এরপর ২০২০ সালের জুনে আনুষ্ঠানিকভাবে সোনা আমদানি শুরু হয়। এর আগেও সোনা আমদানি করার সুযোগ ছিল। তবে কঠিন শর্তের কারণে বৈধভাবে সোনা আমদানি হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালে ১০ টন সোনা কিনেছিল আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) থেকে। যা এখন পর্যন্ত এক বছরে সর্বোচ্চ আমদানির রেকর্ড। অথচ ইএসসিডব্লিউএর হিসাবে আরব আমিরাত বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সোনা রপ্তানি করেছে ২০১৯ সালে। ডলারের হিসাবে তা ৬০ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। যদিও বাংলাদেশে ওই বছর বৈধ পথে কোনো সোনা আমদানির রেকর্ড নেই।

এদিকে দুবাই হতে অবৈধভাবে বিগত ১০ বছরে ৪৪ হাজার কোটি টাকার সোনা আর বৈধ পথে মাত্র ৮২ লাখ ডলার মূল্যের সোনা আমদানি হয়েছে। ২০২২ সালে ঢাকা কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দা অভিযানে আটক হয়েছে আনুমানিক এক টন সোনা। তবে অবৈধভাবে আসা বেশির ভাগ সোনা ধরা পড়ে না। এরপরও অবৈধ পথেই অবাধে আমদানি হচ্ছে শত শত কেজি সোনা। এদিকে এ বছর জুলাই থেকে কড়াকড়ি করা হয়েছে সোনার গয়না আনার ক্ষেত্রেও। আগে একজন যাত্রী বিদেশ থেকে ফেরার সময় যতবার খুশি ততবার ১০০ গ্রাম ওজনের সোনার গয়না বিনা শুল্কে আনতে পারতেন। এবার সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে একজন যাত্রী বছরে ১ বার এ সুযোগ পাবেন।

এদিকে দেশে সোনার চাহিদা বছরে ১৮ থেকে ৩৬ টন।কিন্তু ২০২২ সালে বৈধভাবে দেশে সোনা এসেছে অন্তত ৫৪ টন। সেই হিসাবে চাহিদার ৩৬ টন সোনার তুলনায় বেশি আমদানি করা হয়েছে।

এদিকে সংযুক্ত আরবআমিরাতের দুবাই থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ সোনার বার রপ্তানি হয়। দেশটি থেকে সোনার বার রপ্তানির শীর্ষ ১০ গন্তব্যের একটি বাংলাদেশ। অবশ্য বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশে সোনা আমদানি হয় খুব সামান্য। দুই দেশের সোনাবাণিজ্যের হিসাবে এই গরমিলের কারণ, বেশির ভাগ সোনার বার আসে ‘অবৈধভাবে’। অবৈধ সোনাবাণিজ্যের কারণে বাংলাদেশ প্রচুর রাজস্ব হারায়। অন্যদিকে অপরাধ ও চোরাচালানে ব্যবহার করা হয় অবৈধভাবে আসা এসব সোনা। জাতিসংঘের পশ্চিম এশিয়াবিষয়ক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইএসসিডব্লিউএ) তথ্যভাণ্ডারে থাকা হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে সংযুক্ত আরব আমিরাত ৩৬৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের সোনা রপ্তানি করেছে বাংলাদেশে।

বিশ্বব্যাংকের বছরভিত্তিক গড় মূল্য ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, দুবাই থেকে আনা সোনার পরিমাণ ৭৮ টন বা ৭৮ হাজার কেজির বেশি। ডলারের গড় দাম অনুযায়ী এই পরিমাণ সোনার দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, এই ১০ বছরে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বৈধ পথে মাত্র ৮২ লাখ ডলার মূল্যের সোনা আমদানি হয়েছে। অর্থাৎ ৩৬৫ কোটি ৮২ লাখ ডলারের সোনা বৈধভাবে দেশে ঢোকেনি।এই হিসাবের মধ্যে যাত্রীর নিয়ে আসা সোনার বার বা গয়না অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

জানা যায়, বাংলাদেশে যে সোনা অবৈধভাবে আসে, তার বড় অংশ পাচার হয় ভারতে। আরব আমিরাত সোনা রপ্তানির হিসাব ঠিকই রাখে। কিন্তু বাংলাদেশে অবৈধভাবে আসে বলে এ দেশের সরকারি সংস্থার হিসাবে তা থাকে না। সংযুক্ত আরবআমিরাত থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন পণ্য আমদানি হয়। এনবিআরের হিসাবে, ২০২৩ সালে আমিরাত থেকে আমদানি পণ্যের শীর্ষে ছিল সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার। এ সময়ে দেশটি থেকে ১১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ক্লিংকার আমদানি হয়। দেশটি থেকে ওই বছর কোনো সোনা আমদানি হয়নি। তবে ইএসসিডব্লিউএর তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। জাতিসংঘের এই সংস্থার তথ্য অনুযায়ী,২০২৩ সালে আমিরাত থেকে বাংলাদেশে শীর্ষ রপ্তানি পণ্য ছিল সোনা। এই বছর দেশটি থেকে ৫৩ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের সোনা আমদানি করেছে বাংলাদেশ। ক্লিংকার ছিল দ্বিতীয় শীর্ষ আমদানি পণ্য। শুধু ওই এক বছরই নয়, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের মধ্যে ৯ বছরই আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে সোনা। ইএসসিডব্লিউএ আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানির যে হিসাব দিয়েছে, তাতে সোনা ছাড়া অন্য পণ্যের বাণিজ্যের হিসাব কাছাকাছি। রপ্তানি পণ্য পাঠানো এবং আমদানি পণ্য খালাসের পর বাংলাদেশের হিসাবের ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধানের কারণে হিসাবে কিছুটা কমবেশি হয়। ইএসসিডব্লিউএর হিসাবে আমিরাত বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সোনা রপ্তানি করেছে ২০১৯ সালে। ডলারের হিসাবে তা ৬০ কোটি ৫৭ লাখ ডলার।

আসলে বাংলাদেশে সোনার বাজার দেশের বাইরে থেকে অবৈধভাবে আসা সোনার ওপর নির্ভরশীল।দেশে এই সোনা আসে তিনভাবে। এক. যাত্রীদের মাধ্যমে, দুই. বৈধভাবে ব্যবসায়ীদের আমদানির মাধ্যমে এবং তিন. অবৈধভাবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশাপাশি আরব অঞ্চলের দেশ কুয়েত থেকেও সোনা আমদানির তথ্য রয়েছে জাতিসংঘের সংস্থাটির তথ্যভাণ্ডারে। সেখানে দেখা যায়, ২০২৩ সালে কুয়েত থেকে বাংলাদেশে ১৯ লাখ ডলারের সোনা রপ্তানি হয়। তবে বাংলাদেশের সরকারি হিসাবে কুয়েত থেকে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে এক তোলা সোনা আমদানির রেকর্ড নেই।

অবশ্য দেশে অবৈধভাবে আনা সোনা জব্দের ঘটনাও নিয়মিত ঘটছে। ২০২৩ সালে তিন বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এবং কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের জব্দ করা সোনার পরিমাণ ৮৮৪ কেজি। সোনা ব্যবসায়ী ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের ধারণা, যে পরিমাণ সোনা ধরা পড়ছে, তা অবৈধভাবে আনা সোনার সামান্য অংশ। এনবিআরের চেয়ারম্যান সম্প্রতি এক বৈঠকে বলেন,‘আমরা ১০০টার মধ্যে ১টা ধরতে পারি, ৯৯টা ধরতে পারি না।’

জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) গত বছরের ৯ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ধারণার ভিত্তিতে দাবি করেছিল, বছরে ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার সোনা ও হীরা চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে। স্বর্ণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে নতুন সোনার চাহিদা ১৮৩৬ টন। অর্থাৎ গড় হিসাবে বছরে নতুন সোনার চাহিদা ২৭ টন। তবে তিন বছরে (২০২১২০২৩) যাত্রীদের হাত ধরে গড়ে বছরে প্রায় ৪৪ টন সোনা এসেছে।এর মানে যাত্রীদের আনা সোনাও দেশে থাকছে না।সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন,অবৈধভাবে আনা সোনা দেশে থাকে না।

বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) সীমান্ত দিয়ে ভারত ও মিয়ানমারে পাচারের সময় নিয়মিত সোনা জব্দ করে। বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, সীমান্ত এলাকা থেকে সবচেয়ে বেশি সোনা জব্দ করা হয়েছে ২০২৩ সালে, পরিমাণ ২৬০ দশমিক ৫৬ কেজি। সব মিলিয়ে গত চার বছরে গড়ে প্রতিবছর ১৫৯ কেজি সোনা জব্দ করা হয়েছে।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ‘সুইসএইড’ গত বছরের ৩০ মে আফ্রিকার সোনা নিয়ে ‘অন দ্য ট্র্যায়াল অব আফ্রিকান গোল্ড’ নামে এক সমীক্ষা প্রকাশ করে। তাতে আফ্রিকার সোনাবাণিজ্যের আন্তর্জাতিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে দুবাইকে চিহ্নিত করা হয়। সমীক্ষায় বলা হয়, আফ্রিকা থেকে উড়োজাহাজে করে দুবাইয়ে সোনা পাচার করা হয়। সে ক্ষেত্রে নিয়মিত ফ্লাইট বা ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ ব্যবহার করা হয়। আমিরাতে সোনা শোধনাগার শিল্প রয়েছে। সেখান থেকে বিভিন্ন দেশে সোনা রপ্তানি হয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সোনার বাজারবিষয়ক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ভারতের অবৈধ পথে আসা সোনার ৪০৫০% আসে পশ্চিমবঙ্গ, মণিপুর ও মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে। আর এই অবৈধ সোনার বড় উৎস বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন।

বিশ্বজুড়ে অবৈধ বাণিজ্যের লেনদেন ও নানা দেশে সশস্ত্র গোষ্ঠীর অর্থায়নে সোনা ব্যবহার করা হয়। দুতিন কেজি সোনা লুকিয়ে বহন করা যত সহজ, সে তুলনায় সমমূল্যের মুদ্রা সহজে লুকিয়ে বহন করা যায় না।এ কারণে অবৈধ লেনদেন ও আমদানি বাণিজ্যে আন্ডার ইনভয়েস (কম মূল্য ঘোষণা) করা পণ্যের দাম পরিশোধে সোনা ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশে আমদানিরপ্তানিতে প্রচুর আন্ডার/ওভার ইনভয়েস হয়, যার বেশিরভাগ হয় ভারতের সংগে। সে সুযোগে ভারতে প্রচুর পরিমান সোনা অবৈধভাবে পাচার করা হয়। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে সোনা আনা হয় তার জন্য কোটি কোটি ডলার হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা হয়। ফলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে কাঙ্ক্ষিত ডলার আসে না। যাতে দেশের ভয়াবহ ক্ষতি সাধিত হয়। তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে সোনা আমদানির সহজ সরল পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা দরকার। প্রয়োজন বোধে বৈধ বৈদেশিক মূদ্রা দিয়ে আনা সোনা, নির্দিষ্ট পরিমাণ ট্যাক্স আদায় করে দ্রুত ছাড় দেওয়া দরকার। আর যত দ্রুত দেশে সোনা আমদানির বৈধ পদ্ধতি ইমপ্লিমেন্ট করা যাবে ততই দেশ ও জাতির মঙ্গল হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমনজুর-উল-আমিন চৌধুরীর ‘বাংলাদেশে শিশুশ্রম : সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ’
পরবর্তী নিবন্ধআমরা স্রোত অতিক্রম করবো