স্বপ্ন থেকে বাস্তবের পথরেখা

| শনিবার , ২৫ জুন, ২০২২ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

দক্ষিণাঞ্চলকে গোটা দেশের সঙ্গে বাঁধতে পদ্মার বিশাল জলরাশির ওপর সেতুর স্বপ্ন বহু দিনের, যা আজ বাস্তব। খবর বিডিনিউজের।
কাজ শুরুর আগে : ১৯৯৮-৯৯: পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা।
৪ জুলাই ২০০১ : পদ্মা সেতুর ভিত্তিস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

২০০৩-০৫ : সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়। ২০০৪ সালে জাইকা একটি সমীক্ষা চালিয়ে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়।
২০০৬ : পদ্মা সেতুর জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়। অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালে।
২৮ আগস্ট ২০০৭ : অনেক দিন চাপা থাকার পর পদ্মা সেতু প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একনেক। তখন প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।

স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে যাত্রা :
২০০৯-১১ : সরকার গঠনের পর পুরোদমে কাজ শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। এই সময়ে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন করা হয়। দায়িত্ব পায় নিউজিল্যান্ডভিত্তিক মাউনসেল লিমিটেড।
১১ এপ্রিল ২০১০ : মূল সেতুর দরপত্র আহ্বান করে আওয়ামী লীগ সরকার।
১১ জানুয়ারি ২০১১ : রেলপথ যুক্ত করে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকায় পদ্মা বহুমুখী সেতু সংশোধিত নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। ডলারের হিসাবে এই অংক ছিল ২৯১ কোটি। প্রকল্প অনুমোদনের আগেই দাতাদের ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছিল সরকার।
বিশ্ব ব্যাংকে ঘূর্ণিপাক

২৮ এপ্রিল ২০১১ : পদ্মার বুকে ভাষাশহীদ বরকত ফেরিতে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে আসা সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনগোজি ওকোনজো ইউয়েলা বলেন, বাংলাদেশের স্বপ্নে অংশীদার হতে পেরে তারা গর্বিত।
১৮ মে ২০১১ : জাইকার সঙ্গে সরকারের ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ঋণচুক্তি।
২৪ মে ২০১১ : আইডিবির সাথে ১৪ কোটি ডলার ঋণচুক্তি করে সরকার।
৬ জুন ২০১১ : এডিবির সাথে ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ঋণচুক্তি।

৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ : বিশ্ব ব্যাংকের অনুরোধে কানাডায় এসএনসি লাভালিনের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহ ও সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেপ্তার করে রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ। এরপর টরোন্টোতে তাদের বিচারও শুরু হয়।
১০ অক্টোবর ২০১১ : অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করেছে বিশ্ব ব্যাংক। ঢাকায় বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন জানান, ‘দুর্নীতির’ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত তারা নেবেন না।
১৪ নভেম্বর ২০১১ : দুদকের তদন্তের মধ্যে সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে বদলি করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান নিয়োগ।

৫ ডিসেম্বর ২০১১ : যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে।
৩ ডিসেম্বর ২০১২ : পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘দুর্নীতির’ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে যান সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন।
২৯ জুন ২০১২ : ঋণচুক্তি বাতিলের কথা জানায় বিশ্ব ব্যাংক। পরে অন্যান্য দাতা সংস্থাগুলোকে একই পথ ধরতে হয়।
২৩ জুলাই ২০১২ : বিশ্ব ব্যাংকের চার শর্তের একটি ছিল দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগের মুখে থাকা কেউ সরকারি দায়িত্বে থাকতে পারবে না। সেই শর্ত মেনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে পদত্যাগ করেন আবুল হোসেন।

২৪ জুলাই ২০১২ : আগেই সেতু সচিব থেকে সরিয়ে দেওয়া মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে ওএসডি করে ছুটিতে পাঠায় সরকার।
২৫ জুলাই ২০১২ : লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিশ্ব ব্যাংক আসুক আর না আসুক। আমরা পদ্মা সেতু করব। আমাদের নিজেদের প্রস্তুতি আছে।’
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ : বিশ্ব ব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজর মসিউর রহমানকে ছুটিতে পাঠানোর খবর প্রকাশিত হয়।
২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ : ওয়াশিংটনে বিশ্ব ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী মুহিতসহ অন্যরা। পদ্মা সেতুতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত জানায় বহুজাতিক এই আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

১৪ অক্টোবর ২০১২ : পদ্মা সেতু নির্মাণে ‘দুর্নীতির’ তদন্ত পর্যবেক্ষণে তিন দিনের সফরে ঢাকায় আসে লুই গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পো নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিশ্ব ব্যাংক প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টং এবং যুক্তরাজ্যের দুর্নীতি দমন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান।

দুর্নীতি দমন কমিশনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আলোচনা হয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে তারা নানা রকম পরামর্শ প্রদান করেন। তারা আরও জানান যে বিশ্বব্যাংকের হাতে আরও কিছু তথ্য-প্রমাণ তারা দেখেছেন এবং সেগুলো তারা দুদককে সরবরাহ করার জন্য ব্যবস্থা নেবেন।

১৮ নভেম্বর ২০১২ : বিশ্ব ব্যাংক থেকে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষ্য-সাবুদ পাওয়ার পরে নতুনভাবে দুর্নীতির অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শুরু করে দুদক।
১ ডিসেম্বর ২০১২ : দ্বিতীয় দফায় ঢাকায় আসে বিশ্ব ব্যাংকের তদন্ত পর্যবেক্ষক দল। দুদকের সঙ্গে তদন্ত বিষয়ে এবং ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নিয়ে তাদের বিস্তৃত আলোচনা হয়। তবে মামলার আসামি কাদের করা হবে, তা নিয়ে মতভেদ নিয়েই তারা ঢাকা ছাড়ে।

২ ডিসেম্বর ২০১২ : তদন্ত এবং প্রকল্পের কাজ একসঙ্গে চালাতে সরকার চাইলেও বিশ্ব ব্যাংক জানিয়ে দেয়, মামলা না হলে ঋণ মিলবে না।
১৭ ডিসেম্বর ২০১২ : সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে সাতজনের বিরুদ্ধে বনানী থানায় মামলা করে দুদক।
১৭ ডিসেম্বর ২০১২ : মামলার পর ঢাকায় বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন বিবৃতিতে জানান, ওকাম্পো নেতৃত্বাধীন প্যানেল মামলার এজহার পর্যবেক্ষণ করবে। তারপর প্রতিবেদন দেবে। ওই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই বিশ্ব ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেবে, তারা পদ্মা প্রকল্পে থাকবে, না কি থাকবে না।
২৬ ডিসেম্বর ২০১২ : রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয় দুদক। গ্রেপ্তার করা হয় আরও দুজনকে।
১৬ জানুয়ারি ২০১৩ : মোশাররফকে সাময়িক বরখাস্ত করে সরকার। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামিনে মুক্ত হয়ে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের আবেদন জানান তিনি।

৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ : পদ্মা সেতু নিয়ে সংসদে বিবৃতি দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। নিজস্ব অর্থায়নের পদ্মা সেতু নির্মাণের দিকে যাওয়া এবং তদন্ত ও বিচারের বিভিন্ন দিক সেখানে তুলে ধরেন তিনি।
২৬ অক্টোবর ২০১৪ : চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ হওয়ার মধ্য দিয়ে আদালতে পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলার অবসান হয়। আগের মাসের ১৭ সেপ্টেম্বর আদালতে জমা দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দুদকের পক্ষে বলা হয়েছিল, পদ্মা সেতু নির্মাণে ‘দুর্নীতি বা ষড়যন্ত্রের’ কোনো প্রমাণ তারা পায়নি।

১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ : কানাডার গণমাধ্যম জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক ঋণ বাতিল করেছিল তার প্রমাণ পায়নি কানাডার আদালত। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে এই মামলার তিন আসামিকে আদালত খালাস দিয়ে আদালত বলেছে, ফোনে আড়ি পেতে সংগ্রহ করা যে তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রসিকিউশন মামলা সাজিয়েছিল তা গাল-গল্প ও গুজব।

নতুন পথে সাহসী যাত্রা
৪ জুলাই ২০১২ : অর্থায়ন নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে টানাপড়েনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে।
৮ জুলাই ২০১২ : নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার রূপরেখা জাতীয় সংসদের সামনে দেন শেখ হাসিনা।
৯ জুলাই ২০১২ : নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য এই মুহূর্তে অনুরোধ জানানো হবে না বলে মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিলেও সংস্থাটি চাইলে আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে অর্থায়ন করতে পারবে।
৯ জুলাই ২০১২ : মন্ত্রিসভার বৈঠকে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয় এবং আগ্রহীদের কাছ থেকে অনুদান নিতে দুটি ব্যাংক হিসাব খোলা হবে বলে জানানো হয়। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে অনুদান ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি আসা শুরু হয়।
৯ জুলাই ২০১২ : মন্ত্রিসভায় নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তের পর অর্থমন্ত্রী মুহিত জানান, দাতাগোষ্ঠীর স্থানীয় প্রতিনিধিদের সাথে বসবেন তিনি। পরে তাদের সাথে বৈঠক করে সরকারের অবস্থান জানান তিনি।

৩১ জানুয়ারি ২০১৩ : সরকার জানায়, পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থ আর নেওয়া হবে না।
১৭ জুন ২০১৪ : সেতু নির্মাণে চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করে সেতু বিভাগ।
২৬ নভেম্বর ২০১৪ : মূল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
১২ ডিসেম্বর ২০১৫ : পদ্মার মূল সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ : মোট ৪১টি স্প্যানের মধ্যে প্রথমটি বসে সেতুর পিয়ারে।
১০ ডিসেম্বর ২০২০ : শেষ স্প্যান বসানোর মাধ্যমে সংযুক্ত হয় মাওয়া-জাজিরা।
১০ নভেম্বর ২০২১ : পদ্মা সেতুতে পিচ ঢালাইয়ের কাজ শুরু হয়।
৪ জুন ২০২২ : সেতুর ল্যাম্পপোস্টে প্রথম জ্বলল বাতি।
৯ জুন ২০২২ : পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে সংসদে প্রস্তাব গ্রহণ।
১৪ জুন ২০২২ : সেতুর মাওয়া থেকে জাজিরা পর্যন্ত ৪১৫ বাতি একযোগে জ্বলল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বপ্নপূরণের উৎসব চট্টগ্রামেও
পরবর্তী নিবন্ধখুলছে স্বপ্নের দুয়ার