স্বপ্নে সংযোগের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:৩৪ পূর্বাহ্ণ

উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশও প্রবেশ করলো নতুন এক উড়াল সড়কের জগতে। এ সড়কে কোনও ট্রাফিক সিগন্যাল নেই। নেই কোনও গতিরোধক। বিরতীহীনভাবে চলবে গাড়ি। ‘স্বপ্নে সংযোগে অগ্রযাত্রা’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ শনিবার বিকেলে রাজধানীর উত্তরা বিমান বন্দরের কাওলায় দেশের সবচেয়ে বড় এই উড়াল সড়ক আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দ্রুতগতির উড়াল সড়ক ঢাকা এলিভেটের এক্সপ্রেসওয়েকে রাজধানীবাসির জন্য নতুন উপহার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর ফলে রাজধানীর যানজট কমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা অনুযায়ী স্মার্ট সড়ক ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনাকে সামনে নিয়ে উন্নয়নের মহাসড়কে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা একদিকে উন্নত চিন্তা চেতনা নিয়ে উড়াল সড়ক বা বড় বড় সড়ক মহাসড়ক নির্মাণ করে চলেছি যা দেশের উন্নয়নের একটি রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অন্য দিকে নগর মহানগরের সড়ক ব্যবস্থাপনা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা পৌরানিক পর্যায়ে ফিরে যাচ্ছে। উন্নয়নের আলোর ঝলকানি মহানগরের অন্ধকার ব্যবস্থাপনার কারণে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এদিকে নজর দেয়ার প্রয়োজনও কেউ মনে করছে না। এ যেন চেরাগের নিচে অন্ধকার। বর্তমানে মহানগরীতে অভ্যান্তরীণ সড়ক ব্যবস্থাপনা ও ট্রাফিক সিস্টেম নেই বললেই চলে। আমার মনে পড়ে, আমি যখন স্কুলের ছাত্র ১৯৭২৭৩ সালের দিকে চট্টগ্রামের নিউমার্কেটের মোড়ে ট্রাফিক লাইটের ব্যবস্থা ছিল। গোল চত্বরের মধ্যখানে সিগন্যাল লাইট পোস্ট ছিল যা নিউমার্কেট হতে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। পরবর্তীতে ট্রাফিক পুলিশ বক্স নির্মাণ করা হলে সেখান হতে তা নিয়ন্ত্রণ হতো। বর্তমানে যখন আমরা আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, স্মার্ট বাংলাদেশের, স্মার্ট সড়ক ব্যবস্থা নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানে পৌরানিক আমলের হাত উচিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে যা খুবই দুঃখজনক।

চট্টগ্রামের সড়ক ব্যবস্থাপনার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের বিষয় বলতে গেলে তা খুবই হতাশাব্যাঞ্জক। পাশের দেশ ভারতের কলকাতায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এতো আধুনিক হয়েছে তা আমাদের জন্য অনুকরণযোগ্য। আমাদের দেশে আমরা পারছি না কেন? আমাদের সমস্যাটা কোথায়? চিহ্নিত করা প্রয়োজন।

চট্টগ্রামে যানজট পরিস্থিতি ভয়াবহ। বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনাও। উড়াল সড়কের কারণে যানজট কিছুটা কমলেও নামার স্থানে সংযোগ সড়কে তীব্র যানজট লক্ষ্যনীয়। অপরিকল্পিত বাসস্ট্যান্ডের কারণে নগরীর চার প্রবেশমুখ কার্যত অবরুদ্ধ থাকে। নগরীর অঙিজেন মোড়, শাহ আমানত সেতু সড়ক, কাপ্তাই রাস্তার মাথা এবং সিটি গেইট, কর্ণেল হাট, মইজ্যারটেক সহ প্রভৃতি স্থানে যানজট ও নগরী দুর্ভোগের অন্যতম স্থান। নগরীর বেশির ভাগ সড়কের দুই পাশের ফুটপাত দখল করে চলছে ব্যবসা বাণিজ্য, যত্রতত্র যানবাহন দাঁড়িয়ে থেকে, যাত্রাী উঠানামা করানোর কারণে প্রতিটি মোড়েই এক ধরণের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। সড়কের প্রশস্থতা বেড়েছে কিন্তু শৃঙ্খলা ফিরেনি। দিন দিন ভেঙে পড়েছে চট্টগ্রামের ট্রাফিক ব্যবস্থা। হাঁটা পথ ও যানবাহনে পাড়ি দিতে সময় লাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এজন্য ট্রাফিক পুলিশের অব্যবস্থাপনাকে দায়ি করছেন নগরবাসী। আধুনিক বাংলাদেশে একমাত্র ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সেকেলে রয়ে গেলো যা বিশ্বের অন্য কোথাও নেই।

চট্টগ্রামের সড়কে দেখা যায় অবৈধ মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন। সড়ক দখল করে গাড়ি পার্কিং, উন্নয়নের কাজের জন্য যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি, লক্ষাধিক অবৈধ রিঙার দাপট, ফুটপাত বেদখল এবং সড়কের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যানবাহন চলাচল প্রভৃতি কারণে ট্রাফিক ব্যবস্থা এক প্রকার ভেঙে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাফিক পুলিশের মামলা বাণিজ্য, টোকেন ও স্লিপ বাণিজ্য বর্তমানে খুবই বেশি লক্ষ্যণীয় চাঁদাবাজি ও ব্যবসার কারণে যানজন নিরসনের দিকে তাদের নজর কম। চট্টগ্রাম নগরীতে কোথাও একটি সিগন্যাল লাইটও সচল নেই।

ট্রাফিক পুলিশ বাধ্য হয়ে হাতের ইশরায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে। যা বর্তমান সময়ের আধুনিক স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য লজ্জাকর বিষয়। বর্তমানে মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের গতিনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র যেন চাঁদাবাজি ও যানবাহন হয়রানির অপর নাম। এর প্রকৃত সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। চট্টগ্রামের গাড়ি বা রেজিস্ট্রেশন নাম্বারের গাড়ি ঢাকা মহানগরে গেলে দেখা গেছে প্রতিটি মোড়ে দাঁড় করিয়ে কাগজপত্র দেখার নামে হয়রানি, খুবই কষ্টদায়ক।

প্রকাশিত সূত্র ও বিশেষজ্ঞর মতে, নগরীর ৭৫% নগরবাসীর ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাতায়াতের সুযোগ নেই। সর্ব্বোচ্চ প্রায় ১৫% নগরবাসীর সুযোগ হয় ব্যক্তিগত গাড়িতে যাতায়তের। ২০% নগরবাসী সিএনজি কিংবা রিক্সায় যাতায়াত করে। অন্যদিকে ৪০% নগরবাসীর যাতায়াত হয় অনির্ভরযোগ্য অনিরাপদ ও নিম্নমানের বাস টেম্পোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ গণপরিবহনে। এদের সাথে ২৫% নগরবাসীর পথ চলার অন্যতম মাধ্যমে হলো হাঁটাপথে পথ চলা। বন্দরনগরী ও বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামের গণপরিবহনের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণে এবং বিশেষজ্ঞদের তথ্য মতে, নগরীতে তিন ধরনের গণপরিবহনের জন্য ৪৬টি অনুমোদিত রুট আছে। এর মধ্যে অটো টেম্পো রুট ১৬টি, হিউম্যান হলারের রুট ১৬টি এবং বাসমিনিবাসের রুট আছে ১৪টি। প্রত্যেকটি অনুমোদিত রুটের বাইরে বিভিন্ন শ্রমিকমালিক সংগঠন মর্জিমাফিক আরও অন্তত ৪০টি অবৈধ রুট তৈরি করেছে বলে জানা গেছে। এই সব অনুমোদনহীন রুটে চলছে হাজার হাজার যানবাহন। যার অধিকাংশই ত্রুটিপূর্ণ ও বিআরটিএ এর নিবন্ধন নেই। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে, নগরবাসীকে যানজটের মতো ভয়াবহ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে, যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নয়নে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে টেকসই নগর যাতায়াতকে প্রাধান্য দিতে হবে। বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে, নগরীর ৫৩টি মোড়ে অত্যাধুনিক সিগন্যাল স্থাপনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু তা আদৌ আলোর মুখ দেখেনি, দেখবে কিনা সন্দেহ। তবুও আমরা আশাবাদী। উন্নয়নের মহাসড়কে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে উড়াল সড়ক, পাতাল সড়ক, টানেল প্রভৃতি নির্মাণ করা হলেও নগরের জন্য আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা এখনো অধরাই রয়ে গেল।

ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন ‘আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ আমাদের দেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশের পর স্মার্ট বাংলাদেশের পরিকল্পনা এই শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত, কেননা উন্নত বিশ্বের দেশগুলো তো এরই মধ্যে স্মার্ট দেশে রূপান্তরিত হয়েছে, এমনকি অনেক উন্নয়নশীল দেশও স্মার্ট দেশে রূপান্তরের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, তাই দেশের উন্নতি এবং অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে হলে দেশকে অনেকটাই উন্নত বিশ্বের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে।’

স্মার্ট বাংলাদেশের ঘোষণা দিলেই তো আর স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর ঘটানো সম্ভব না। এটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ, যেখানে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের এবং উপযুক্ত লোকবলের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেই সাথে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ এবং লক্ষ্যে পৌঁছাতে থাকা চাই সঠিক ও বাস্তব সম্মত রোড ম্যাপ। সরকার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছার কোন কমতি নেই। কিন্তু এ কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে যাঁরা দায়িত্বে থাকবেন তাঁদের দক্ষতা, দূরদৃষ্টি এবং আন্তরিকতার ওপরই নির্ভর করবে ২০৪১ সাল নাগাদ সত্যিকার স্মার্ট। এই স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সম্পূর্ণ প্রযুক্তি নির্ভর না ম্যানুয়াল পদ্ধতির এক এলোমেলো স্মার্ট বাংলাদেশ হবে? সেটি নির্ভর করবে চিন্তা চেতনা ও আন্তরিকতার উপর।

লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক, শিল্পশৈলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিজেকে ভালো রাখার ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে তুলতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধবিষয় যখন ‘শিশুসাহিত্য’ এবং একই সঙ্গে ‘মুক্তিযুদ্ধ’…