আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ল্যান্ডমার্ক ব্রিজটির নাম গোল্ডেন গেট ব্রিজ। ক্যালফোর্নিয়ার প্রধানতম ডেসিগনেটেট আকর্ষণীয় স্থাপনা। এটি এই অঙ্গরাজ্যের সানফ্রান্সিসকো শহরের একটি ঐতিহাসিক পর্যটক আকর্ষণকারী সেতু। এই ব্রিজটিকে ‘সোনালী দুয়ার’ নামেও ডাকা হয়ে থাকে। এই ব্রিজটি সানফ্রান্সিসকো শহরের ‘একতার আইকন’ হিসেবে খ্যাত। আমাদের আমেরিকা পৌঁছানোর দ্বিতীয় সপ্তাহে আমরা সপরিবারে এই ল্যান্ডমার্ক খ্যাত সানফ্রান্সিসকোর একতার আইকন নামে পরিচিত গোল্ডেন গেট ব্রিজ পরিদর্শন করে অপূর্ব অনুভূতি নিয়ে চোখ জুড়ালাম এবং মন ভরালাম।
গোল্ডেন গেট ব্রিজের আকার আকৃতি, গঠন স্থাপত্যশৈলী, আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, পাহাড়–পর্বত, সাগর–মহাসাগর, পর্যটকের উপস্থিতি, সরকারি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সব মিলিয়ে এক অভূতপুর্ব অনুভূতি নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতার এক স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে জমা রইল আমার মানসপটে। ভালোলাগার মুগ্ধতা থেকে জেনে নিলাম ব্রিজটির খুঁটিনাটি বিষয়।
মজার ব্যাপার হলো, ব্রিজটি তৈরির আগ পর্যন্ত নাকি আমেরিকানবাসীদের ধারনায় ছিল না যে এই গোল্ডেন গেট নামক স্থানটিতে এ রকম একটি ব্রিজ তৈরি হতে পারে, যা সানফ্রান্সিস্কো এবং মেরিন কাউন্টিকে সংযুক্ত করা যায়, যোগাযোগ ব্যবস্থার এই অন্যতম নিদর্শন ব্রিজটি তৈরি হওয়ার আগে এই দু’জায়গার যোগাযোগ হতো ফেরি বা ব্যক্তিগত নিজস্ব যোগাযোগ মাধ্যমে। আঠারো শতকের পরবর্তী সময়েও আমেরিকানবাসীর গোল্ডেন ব্রিজ তৈরির ভাবনা নাকি অসম্ভব ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, গোল্ডেন গেটে অবস্থিত প্রশান্ত মহাসাগর থেকে সানফ্রান্সিসকো উপসাগরের প্রবেশ দ্বারটি শান্ত কিন্তু গভীরতম প্রশান্ত মহাসাগরের ২.৭ কিলোমিটার প্রায় তিন মাইল দৈর্ঘ্য এবং এক মাইল প্রশস্ত এই প্রণালীটি যার স্রোত ছিল ৪.৫–৭.৫ নটিকেল। এই দুর্গম জলরাশি নিয়ে বিস্তৃত প্রণালীটি দুই দিকের দুই জায়গা যথা গোল্ডেন গেট ও মেরিন কাউন্টিকে পৃথক করে রেখেছিল প্রায় আঠারো শতকের শেষ পর্যন্ত।
১৯১৬ সালে এই ব্রিজের ভিত্তিপ্রস্তর করা হয়, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তদকালীন প্রেসিডেন্ট এই ব্রিজ তৈরিতে মনোযোগ দিতে পারেননি। পরবর্তী কালে ১৯৩৩ সালের ৫ জানুয়ারি এই গোল্ডেন গেট স্থানের নাম অনুযায়ী ‘দ্য গোল্ডেন গেট ব্রিজ’ তৈরির কাজ শুরু করেন। গোল্ডেন গেট ব্রিজের নকশাকার ছিলেন, জোশেফ স্ট্রস ইরভিং মরো, এবং চার্লস এলিস। চীনের দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং সাহসী শ্রমিকদের কঠোর দুঃসাহসিক পরিশ্রমের ফসল নাকি এই ব্রিজ। ইতিহাসের কথন অনুযায়ী চীনা শ্রমিকের অবর্ণনীয় এবং অমানবিক পরিশ্রম এর ফলে এই ব্রিজ তৈরি হয়েছিল বলে ব্রিজটির পাশে অবস্থিত পাহাড় চূড়ার কক্ষে তাঁদের একটি কক্ষ স্মৃতিস্বরূপ এখনও রাখা আছে। আমরা এবং পর্যটকগণ সেটা দেখেই তাদের কষ্ট এবং পরিশ্রমের তীব্রতা অনুভব করতে পারি। কথিত আছে যে, চীনা শ্রমিকেরা ব্রিজ তৈরির পর সানফ্রান্সিসকো শহরের মাঝখানে একটি জায়গা আমেরিকান সরকার থেকে অধিকার হিসেবে আদায় করে নেন স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য। সেটি এখন চায়না টাউন নামে খ্যাত, এটিও এখন পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত।
অবশেষে ছয় লাইন বিশিষ্ট ব্রিজ তৈরির কাজ শেষ হয়েছিল ১৯৩৭ সালের ১৯ এপ্রিল। ২৭ মে ১৯৩৭ সালে তদকালীন প্রেসিডেন্ট, ’ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট এটি উদ্বোধন করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। ব্রিজটির স্থাপত্য শৈলী এক কথায় অপূর্ব। এটি প্রস্থে ৯০ ফুট, দৈর্ঘ্যে ৮৯৮১ ফুট এবং উচ্চতায় ৭৪৬ ফুট। ব্রিজটি মূলতঃ একটি ঝুলন্ত সেতু। এটি তৈরিতে তখনকার সময়ের বিশ্বের বৃহত্তম সাসপেনশন স্প্যান লাগিয়েছিল, যেটার দৈর্ঘ্য চিল ৪২০০ ফুট। আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা পদ্মা সেতুর তৈরির সময় এ রকম স্প্যানের কথা শুনেছিলাম, তবে পদ্মাসেতুতে ব্যবহৃত স্প্যানগুলো অত দীর্ঘ ছিল না। আজ থেকে সাতাশি বছর আগে এই ল্যান্ডমার্ক খ্যাত ব্রিজটি তৈরি করে ক্যালিফোর্নিয়াকে একতার আইকন হিসেবে, ঝুলন্ত সেতু হিসেবে, সোনালী সেতু, এবং দ্য গোল্ডেন গেট ব্রিজ বা ল্যান্ডমার্কব্রিজ হয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে, যা পর্যটকদের আকর্ষণীয় দৃশ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্সের মতে আধুনিক বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি হলো এই সানফ্রান্সিসকো শহরের ‘দ্য গোল্ডেন গেট ব্রিজ’। পুরো সানফ্রান্সিসকো শহরে এরকম প্রায় বারোটির মত ব্রিজ দিয়ে শহরটাকে একসাথে যুক্ত করে রেখেছে। বারোটি ব্রিজের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আকর্ষণীয় ব্রিজ হলো এই গোল্ডেন গেট ব্রিজ, তবে দীর্ঘতম নয়, এর চেয়েও একটি দীর্ঘ সেতু রয়েছে, যেটির নাম বে–সেতু বলে পরিচিত, এটি সানফ্রান্সিসকো এবং অকল্যান্ডকে যুক্ত করা ১২ মাইল দীর্ঘ ১২ লাইন বিশিষ্ট, সানফ্রানসিসকো অকল্যান্ড সমুদ্র সেতু নামে পরিচিত। গোল্ডেন গেট ব্রিজটি আমেরিকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বিরাট অবদান রেখে চলেছে। ব্রিজটির প্লেকার্ডে টোল ভাড়া লেখা আছে প্রতিটি কার গাড়ি ৭.২৫ ডলার। তবে পিক আওয়ার এবং নন পিক আওয়ারে টোল আদায়ে ভিন্নতা রয়েছে। আমাদের গাড়ি পাস হতে বোর্ডে ১০ ডলার উঠেছে তাই ১০ ডলার দিয়েই আমরা আসা যাওয়া করলাম।
মেরিন যোগাযোগের অন্য সব সেতুর মধ্যে দ্য গোল্ডেন গেট ব্রিজের অবস্থান, এক অত্যাশ্চর্য স্থানে অবস্থিত বলেই হয়ত পর্যটকদের প্রথম পছন্দ। এটি সুউচ্চ পাহারের মাঝখানে এবং সারিবদ্ধভাবে সন্নিবিষ্ট পর্বতমালা দ্বারা বেষ্টিত আর দুপাশে প্রশান্ত মহাসাগরের বিপুল দিগন্ত জোড়া নীল জলরাশির সমাহার, যেদিক থেকেই দেখা হোক না কেন; মনে হবে এক অপার্থিব সুন্দরের স্বর্গরাজ্য। পাহাড়ের উপড় থেকে এই অনবদ্য স্থাপনা পরিদর্শনের জন্য পুরো পাহাড়গুলোকে ‘কোণ আইস্ক্রিমের’ আকৃতির মত করে প্রায় বিশ স্তরে সজ্জিত পাহাড়ি রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে সরকার। প্রতি দিন অনবরত লাখ লাখ মানুষের গাড়ি নিয়ে আনাগোনা তো আছেই, রয়েছে সুশৃঙ্খল পুলিশের কড়া নিরাপত্তা সহ তত্ত্বাবধান। মানুষেরা সারিবদ্ধ করে রাখা গাড়ির পিছনে যার যার গাড়ি রেখেই বাকি রাস্তা যতটুকু থাকুক সেই রাস্তাটুকু পায়ে হেঁটে চূড়ায় উঠতে থাকে।
আমাদের পাহাড়ের চূড়ায় উঠার সময়টা ছিল দুপুরের পর। প্রচণ্ড বাতাস, নিজেদেরকে সামলে রাখা কষ্টকর, হাঁড় কাপানো শীত, তবে রোদ থাকাতে তেমন অসুবিধা লাগে নি। প্রাকৃতিক পরিবেশ ’বর্ণনাতীত সুন্দর, যেন ত্রিবেণী সঙ্গমে প্রস্তুত দুদিকের দুটো পাহাড় চূড়া, নিচে জলরাশি আর চারদিকে পর্বতগুলো মালা রূপে আচ্ছাদিত। চূড়ায় রয়েছে একটা বেশ বড়সড়ো লোহার জাল। ঐ জালে আটকে আছে অসংখ্য তালা। বিশ্বের সব মানুষেরা এখানটায় পৌঁছে আমাদের বাংলাদেশিদের মতো মনের আকুতি জানিয়ে তালা বন্ধ করে রেখে যায়, মনষ্কামনা পূরণ হলে, এসে নাকি তালা খুলে প্রশান্ত মহাসাগরের জলে বিসর্জন দেয়। ভাবুন, যত মতের মানুষ থাকুক না কেন; সবাই কিন্তু একই পথের দিশারী। আমার দেখে খুব ভালো লাগল। অবশ্য আমাদের এখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সূতো বাঁধে, এরা তো ধনী দেশ, তাই হয়তো তালার ব্যবস্থা, আমেরিকা বলে কথা।
চূড়ার উপর থেকে নিচে থাকালেই দেখা যায়, ব্রিজের উপর হাজার হাজার গাড়ির চলায়মান দৃশ্য যেন স্বপ্নপূরী। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে ছয় লাইন বিশিষ্ট এই সোনালী সেতু দিয়ে দিনে এক লাখ আঠারো হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করে। বেশির ভাগ গাড়িই হলো পৃথিবীর নানা জায়গার ভ্রমণ পিপাসু মানুষের আসা যাওয়াজনিত গাড়ি। উইকিপিডিয়ায় আরো পেয়েছি, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ছবি তোলার জায়গার মধ্যে এই ব্রিজটি অন্যতম। আমরা নিজেরাও নানা দৃশ্যের অসংখ্য ছবি তুলেছি। পাহাড়ের চূড়া থেকে তোলা প্রায় সব ছবিতে ব্রিজটি ধরা পড়ে। ক্যালিফোর্নিয়ার এই ব্রিজটি সব মানুষের সবচেয়ে আগ্রহের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
দ্য গোল্ডেন গেট ব্রিজটির সবচেয়ে নেতিবাচকতা হলো, এটিকে আত্মহত্যার সেতুও বলা হয়। কারণ বিভিন্ন আমেরিকান জরীপের ফলাফল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে আত্মহত্যার স্থান হিসেবে এক নম্বর স্থানটি দখল করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের সানফ্রান্সিসকো শহরের ঝুলন্ত সেতু’, ‘দ্য গোল্ডেন গেট ব্রিজ’।
আমাদের ফেরার সময়ও অনেকখানি পাহাড়ি রাস্তা হেঁটে গাড়ির জায়গায় এসে গাড়িতে উঠলাম। গাড়িচালক, আমার পুত্র অনেকবার এসেছে এপথে, তাই তেমন সময় লাগলো না নামতে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঘেঁষে হাজার হাজার গাড়ি নামছে তো নামছে। আমি স্বাভাবিক ভাবেই ভয়ে কাঠ হতে হতেই শেষ। ঈশ্বরকে বিরক্ত করতে মনোযোগ দিয়েছি, এর মধ্যেই গাড়ি সরলপথে চলে আসলো এবার নগরীর সৌন্দর্য দেখার পালা, এবং কিছু জলযোগ করারও সময় হলো। দু’ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পরেই পৌঁছবো আমাদের বাসায়। এভাবেই শেষ হলো ল্যান্ডমার্ক সেতু ‘দ্য গোল্ডেন গেট সেতু’ দেখার অভিজ্ঞতা।
লেখক
প্রাবন্ধিক; সাবেক অধ্যক্ষ, হুলাইন ছালেহ–নূর ডিগ্রি কলেজ