স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে স্বাধীন মাতৃভূমির পরিপূর্ণতা

ডঃ ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ৭ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সাল শুধু বাংলাদেশ নয়; বিশ্ব ইতিহাসে শোক-গৌরবের অনুপম অধ্যায়। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ-২৬ মার্চ-বিপুল রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি-১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জন একইভাবে বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতার বিশাল ক্যানভাসে পবিত্রতম একটি দিন। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামসসহ সকল স্বাধীনতা বিরোধী অন্ধকারের শক্তিকে পরাস্ত করে দেশ শত্রুমুক্ত হলেও; দেশের মানুষ স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করতে পারেনি। যে মহান নেতার নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও কঠিন শোকাবহ বিশ্বের বিরল রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশ মুক্তির আনন্দে জাতি আলোড়িত হতে পারে নি। অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর অবস্থান সম্পর্কে অজ্ঞাত জাতি এবং তাঁর সশরীরে উপস্থিতি ব্যতীত মুক্তির আনন্দগাথা কোনভাবেই বাঙালির হৃদয়ে প্রশান্তির ভিত নির্মিত করেনি। বস্তুত ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনই প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীন অস্তিত্ব পরিপূর্ণতা লাভ করে। সমগ্র জাতির অশ্রুসজল বিরোচিত আনন্দ-মঙ্গল অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল স্বাধীনতার নবতর সংস্করণ। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ প্রয়োগিক অর্থে একই সূত্রে বাঁধা এবং সম্পূরক-পরিপূরক রূপেই প্রতিভাত।

১৯৭১ সালে বিজয় মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ দীর্ঘ নয় মাসের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বের সমাপ্তি ছিল বটে। কিন্তু মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি এত আত্মবিসর্জনে বাঙালি শৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীনসত্তার অনন্য অনুভূতি অনুধাবনে পরিপূর্ণ অপরাগ ছিল। গভীর কাতরতার আর্তনাদে অধীর আগ্রহে প্রাণপ্রিয় নেতাকে তাঁরই নেতৃত্বে মুক্ত মাতৃভূমিতে স্বমহিমায় ফেরার উদ্দেশ্যে সেদিন এমন কোন বাঙালি বা বাঙালি পরিবার ছিল না; যারা মসজিদ-মন্দির-প্যাগোডা-গীর্জাসহ প্রত্যেক ঘরে ঘরে মহান স্রষ্টার কাছে আকুল প্রার্থনা নিবেদন করেনি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে ২৯০ দিন বন্দি থাকার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বীয় নেতৃত্বে সদ্য স্বাধীন দেশের মাটিতে পদার্পণ করেই ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে অগণিত বাঙালির অশ্রুসিক্ত জনসমাবেশে নতুন করে উচ্চারণ করলেন; “আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু এসে থাকে যদি, আমি হাসতে হাসতে যাব। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান। আজ আমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছি। আমার ভাইদের কাছে, আমার মা’দের কাছে। আমার বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন। বাংলার মানুষ আজ আমার স্বাধীন।”

বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত যুদ্ধোত্তর দেশকে পুনর্গঠনের পরিকল্পনা এবং দেশকে এগিয়ে নিতে জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্তরিকতা-গতিময়তায় শক্তি যোগানোর অঙ্গীকারে আবদ্ধ করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার চারস্তম্ভকে প্রতিষ্ঠিত করার নিরবচ্ছিন্ন ও নিরলস কর্মযজ্ঞে নিজেকে নিবেদন করলেন। গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন নবোম্মেষ পরমাত্না তবে সংযমিত কন্ঠে সাবধান করেছেন গণতন্ত্রকে যেন উচ্ছৃঙ্খলতার মোড়কে কলুষিত করা না হয়। বঙ্গবন্ধুর জীবন-সমাজ-রাষ্ট্র-শিক্ষা-উন্নয়ন দর্শনের ন্যায়ালয় ছিল বাংলার মাটি-মানুষের ন্যায্য সুদৃঢ়তা। হৃদয় নিঙড়ানো বাঙালি জাতিসত্তাই ছিল এর নয়নাভিরাম ভিত্তি। আধুনিক চীনের জনক ‘সান ইয়াত সেন’ যেমন রাষ্ট্র ও জনকল্যাণে জাতীয়তা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ত্রয়-নীতি (Three Principle of the People) ধারণ করে দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার চারস্তম্ভকে প্রতিষ্ঠিত করার নিরবচ্ছিন্ন ও নিরলস কর্মযজ্ঞে নিজেকে নিবেদন করলেন।

১০ জানুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁও বিমানবন্দরে লাখো জনতা তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে বিশাল জনস্রোতের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যান এবং সেখানে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনায় উল্লাসিত লাখো বাঙালির উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদান করেন। সেদিন জনতার মহাসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে স্বীয় অঙ্গীকারের কথা ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘গত পঁচিশে মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এসব কুকীর্তির বিচার করতে হবে।’ ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকা প্রকাশ করে যে, ‘তাঁহার এই মুক্তি বাংলাদেশকে বাঁচার সুযোগ দিয়াছে। ইহার আগে দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানের কারাপ্রকোষ্ঠে অন্তরীণ থাকাকালে তাঁহার জীবন নাশের উপক্রম হইয়াছিল। প্রহসনমূলক বিচারের রায় অনুযায়ী তাঁহার ফাঁসি নিশ্চিত করার জন্য কবরও খনন করা হইয়াছিল। এই সময় তিনি বীরের ন্যায় বলিয়াছিলেন, আমার লাশটা বাংলার মানুষের কাছে পাঠিয়ে দিও। কোনো প্রলোভন ও ভয়-ভীতিই তাঁহাকে বাঙালির জনদাবী ও গণতান্ত্রিক আদর্শ হইতে বিচ্যুত করিতে পারে নাই।’

বঙ্গবন্ধুর অত্যুজ্জ্বল সামাজিক-রাজনৈতিক অভিযাত্রায় (১৯৩৪-১৯৭৫) সপ্তম শ্রেণি থেকে প্রতিটি দিনক্ষণ জীবনপ্রবাহের এক একটি অধ্যায়ের নবতর সংস্করণ। ‘বেরিবেরি’ ও ‘গ্লুকোমা’ নামক হৃদ-চক্ষুরোগে আক্রান্ত বঙ্গবন্ধু শৈশবকাল থেকেই স্বদেশী আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে নেতাজী সুভাষ বসুর আদর্শিক চেতনায় প্রক্ষিপ্ত হলেন। গৃহ শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ, এমএসসি মহোদয়ের সান্নিধ্যে গরিব শিক্ষার্থীদের সহযোগিতাকল্পে ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হলেন এবং অকপটে সহপাঠীদের নিয়ে মুষ্টি ভিক্ষার চাল সংগ্রহ করতেন। ফুটবল, ভলিবল, হকি খেলায় পারদর্শিতা প্রদর্শনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অকুতোভয় খেলোয়াড়। পাশাপাশি প্রিয় পিতার মতোই আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত পত্রিকার নিয়মিত পাঠক। পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জে বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ও শ্রমমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী সাহেবের আগমনকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু নির্ভীক রাজনীতিকের উপচীয়মান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ঋদ্ধ হলেন। সূচনায় যেন জয় করলেন নিজেকে এবং ব্রতী হলেন দেশমাত্রিকার মুক্তির স্বপ্নে বিভোর আত্নত্যাগের মহান দৃষ্টান্ত স্থাপনে বৈদগ্ধ চারণ। মিঞা মুজিবুর রহমান রচিত ‘জাতির জনকের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা’ গ্রন্থে ১৯৭০ সাল থেকে ২০ বছর বাংলাদেশে বসবাসকারী জেমস জে নোভাক রচিত পুস্তকের উদ্ধৃতি প্রণিধানযোগ্য – “শেখ মুজিব রাজনৈতিক পরিবেশে এক ধরনের তাৎক্ষণিতা নিয়ে আসেন। সূক্ষ কূটচাল অথবা খাপছাড়া পদক্ষেপ নিয়ে তিনি জনগণকে ক্লান্ত করতেন না। সরকারি পদের প্রতি তাঁর কোনো মোহ ছিল না। তাঁর উত্থানের সময় থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর দিনে তাঁকে গ্রেফতার করা পর্যন্ত সবাই জানত এবং বুঝত তিনি স্বাধীনতার পক্ষেই কথা বলেছেন।’

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সংস্কৃতির অবগাহনে বঙ্গবন্ধু অকৃত্রিম ধারণ করেছেন রবিঠাকুর, নজরুল, জসিমউদ্দীনসহ সকল শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-সংস্কৃতি কর্মীদের। নির্মাণ করেছেন নতুন এক কাব্যিক-শৈল্পিক কৌশল এবং বাঙালির মনস্তত্ত্ব উপলব্ধির উদ্দীপ্ত বোধ। বঙ্গবন্ধু যথার্থই আবিষ্কার করেছেন গান-কবিতা ব্যতিরেকে কোন আস্থা বা বিশ্বাস দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী রবীঠাকুরের গান ও সাহিত্যকে নিষিদ্ধ করে প্রতিটি বাঙালি পরিবারেই তাঁকে স্থাপিত করেছেন। একইভাবে নজরুলের দ্রোহ, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ও মানবমুক্তির গান ও কবিতায় প্রাণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির প্রাণস্পন্দন। নজরুল সম্পর্কে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যেমন বলেছেন, ‘জীবনে ও শিল্পে তিনি সকলকে জাগাতে চেয়েছেন মঙ্গলের জন্যে, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে, মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রাণপণ বিদ্রোহ ঘোষণার জন্যে’। একইভাবে নির্দ্বিধায় বলা যায় বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ করেছিলেন আরাধ্য মানব-বুদ্ধির মুক্তি, শোষণ-বঞ্চনা, ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত আধুনিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় অমিত সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মই আগামী দিনের পথপ্রদর্শক। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়ে নিয়ে ২০৪১ সালে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ অভিধায় উন্নত বিশ্বের মহাসড়কে পদার্পণের অভিষ্ট লক্ষ্যে জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মযোগী হতে হবে। তরুণ কর্মবীরদের সততা-নিষ্ঠা-মেধা-প্রজ্ঞা-দেশপ্রেম মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী আদর্শিক চেতনায় ঋদ্ধ করে নিজেদের সোনার মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্য বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত মুক্তির সংগ্রাম সার্থক ও সফলভাবে দৃশ্যমান করতে হবে। সহযাত্রী হিসেবে অগণিত নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোর-যুবকদের অন্তরে ‘চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ-প্রেরণায় বঙ্গবন্ধু’, ‘জয় বাংলা’ জয়ধ্বনি, সভ্যতার সূচক সচকিত সত্য-সুন্দর-কল্যাণ-আনন্দধারাকে অপরাজিত করার মনীষায় ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস এক অবিস্মরণীয় প্রেরণার ব্যঞ্জনা যুগিয়ে যাবে- নিঃসন্দেহে এই প্রত্যাশা অত্যন্ত যৌক্তিক ও অখন্ড বিবেক প্রসূত।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধনগরীতে এক বছরে ৫২৬ জনের আত্মহত্যার রেকর্ড