স্বজনের চোখে ভাস্বর : ভাস্কর নভেরা

জাহিদ সারোয়ার নিজাম | সোমবার , ২৯ মার্চ, ২০২১ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

ভাস্কর নভেরা, রানীদিকে প্রথম যখন দেখি সেটা সম্ভবত ১৯৫৬ সাল। আমার তখন বালক বয়স, আনুমানিক সাত চলছে। মা-বাবার সাথে ৫৮-ডি, আজিমপুর স্টেটে থাকতাম। রানীদির তখন ছাব্বিশ-সন্দেহাতীতভাবে তিনি আমার ক্ষুদ্র জীবনে দেখা সবচেয়ে রূপবতী নারী। তিনি কেবল সুরূপাই ছিলেন না, চলতেনও খুব পরিপাটি। আমার মনে স্থায়ীভাবে দাগ কেটেছিলেন তিনি। সেবার তিনি অল্প ক’দিনই আমাদের সাথে ছিলেন। পরের বার এসে ছিলেন বেশ কিছুদিন তাঁর বড় বোন ঝুনুদির (কুমুম হক) সাথে পরের বিল্ডিং এ থাকতেন তখন, আজিমপুর স্টেটে। কাছাকাছি দূরত্বে থাকার কারণে প্রায়শই আসতেন। আমরা তাঁর কাজ দেখতে পাবলিক লাইব্রেরী ও শহীদ মিনারে যেতাম, তাঁকে দেখতে তেজগাঁওয়ের বাসায়ও যেতাম আমার এই সাক্ষাতগুলোর অস্পষ্ট স্মৃতি আছে। বিস্ময়াভিভূত হয়ে ভাবি, ঢোকার মুখে বাম দেয়ালে তাঁর করা রিলিফ ম্যুরালের কথাও মনে আছে আমার। সম্মুখ অংশে এবং সম্ভবত ডান দেয়ালেও পেইন্টিং ছিল। হামিদ ভাই সবসময়ই তাঁর সাথে থাকতেন। আমাদের ফ্ল্যাটেও তিনি আসতেন এবং আমরা তাঁকে বড় ভাই গণ্য করতাম। ১৯৫৮ সালে মার্শাল’ল ঘোষণার পর, সাব. ডিভিশনাল অফিসার হিসেবে আব্বা মরহুম বি.আর.নিজাম সুনামগঞ্জ বদলী হয়ে যান, সম্ভবত ১৯৫৯ সালে। প্ল্যানিং কমিশনে কাজ করার জন্য আব্বা করাচীতে বদলী হলে আমরা আবার সেন্ট্রাল গভ: অফিসার্স কোয়ার্টারের একটি ফ্ল্যাটে চলে আসি। আমাদের অনেক আত্মীয়ই বাংলাদেশ থেকে ঘুরতে আসতেন, এসে থাকতেন।
সম্ভবত ১৯৬২ বা ১৯৬৩ সালের দিকে রানীদি কয়েকদিনের জন্য আসেন। এই সময়ে তাঁর কাছ থেকে আমরা ফো্লরেন্স-এর অনেক গল্প শুনতাম। ভাস্কর্য বিষয়ে পড়াশুনা করতে তিনি এবং পেইন্টিং বিষয়ে পড়াশুনা করতে হামিদ ভাই ও আমিনুল ইসলাম ফ্লোরেন্স গিয়েছিলেন।
কিছু বিষয় এখনও মনে দাগ কেটে আছে। তিনি এবং অন্যান্য শিল্পীরা তখন অর্থাভাবে দু’বেলা আহার পেতেন না। ‘শিল্পী পাড়া’তে রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার তাঁদের ডিনারের জন্য ফ্রি ব্রেড দিতেন, কেননা, তিনি জানতেন তার অনেক ক্রেতাই আরেক বেলা খাবার জোটাতে পারেন না। তিনি বলতেন, যদিও তিনি ও হামিদ ভাই আর্থিক অনটনে ছিলেন কিন্তু তিনি কখনোই তাঁর শিল্প-শুদ্ধতার সাথে আপোষ করেননি। তিনি অনুতাপ করতেন যে, আমিনুল ইসলাম ‘কলসী কাঁখে’ মেয়ে এঁকে অভিনব পণ্য হিসেবে এটি পর্যটকদের কাছে বিক্রি করতেন। ঐ সময়ে তিনিও অন্য শিল্পীদের মডেল হিসেবে কাজ করে অর্থ উপার্জন করেন। তিনি আমাদের জানান সকাল বেলায় কফি কেনার সামর্থ্য ছিল না বলে তার বদলে গরম পানি চিনি মিশিয়ে পান করতেন-যাকে তিনি বলতেন ‘গরম শরবত’! তিনি যখন আমাদের সাথে থাকতেন আমার মনে পড়ে চাদরমুড়ি দিয়ে শরীর-মুখ ঢেকে জানালায় উঁকি দিয়ে ভয় দেখাতাম তাঁকে। ওভাবে রাতের বেলা পথচারীদেরও ভয় দেখাতাম। তাঁর জীবনের অন্য দিকগুলো বোঝার বয়স তখনও আমার হয়নি। আমার মনে পড়ে মরহুম এস.এম. আলী তাঁর সাথে দেখা করতে আসতেন এবং আমাদের বলতে হ’তো ‘তিনি বাড়ি নেই’। ঐ সময় এটমিক এনার্জি কমিশনের প্রধানও তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হতেন কখনো-তিনি তাঁর সাথেও দেখা করতেন না।
আমি ভাস্কর নই, শিল্পীও নই। তাই শিল্পীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর কাজগুলোকে মূল্যায়ন করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। কিন্তু পৃথিবীর অনেক ভাস্কর্য দেখেছি বলে এটুকু ধারণা আছে কোনটি শৈল্পিক, কোনটি নয়। যেমন কোন পরিমাপকেই রূপসী বাংলা হোটেলের সামনে ঘোড়া-টানা গাড়ির কাজটি শৈল্পিক নয় এবং রানীদির ‘পরিবার’ বা ‘চাইল্ড ফিলোসফার’ নি:সন্দেহে শৈল্পিক উৎকর্ষে অনন্য।
শহীদ মিনারের বেসমেন্টে প্যাস্টেল রঙে রিলিফ ম্যুরালটি চমৎকার। বস্তুত: তাঁর প্রতিটি সৃজনই শিল্পগুণ সমৃদ্ধ। হতে পারে আমি পক্ষপাতদুষ্ট। শহীদ মিনারের নকশা কে করেছেন এটা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে। অনেক বক্তার সাথে কথা বলে এটাই প্রতীতি জন্মেছে, কাজটা রানীদি’র। শহীদ মিনারের মূল নকশাটি তাঁর ঐ সময়ের শিল্প ক্যারিয়ারের মূল ভাবের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। এখানে মূল তিনটি স্তম্ভের মূল থিম ছিল ‘মা এবং দুই সন্তান’। একই থিমে ঐ সময়ে তিনি অনেকগুলো কাজ করেছেন।
অনেকেই উল্লেখ করেছেন যে হামিদ ভাই-যাকে শহীদ মিনারের নির্মাতা বলা হয় ত্রিমাত্রিক কোন কাজ কখনোই করেন নি অর্থাৎ তিনি ভাস্কর ছিলেন না। কাজেই তিনি শহীদ মিনারের নকশা করতে পারেন না। রানীদি ও হামিদ ভাই যৌথভাবে কাজ করেছেন বলেই হামিদ ভাইয়ের স্বজনদের পক্ষে এটা মেনে নেয়া কষ্টকর যে, দেশের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা স্মৃতিস্তম্ভের নকশা বাস্তবে তিনি করেন নি। এক্ষেত্রে দেশের স্বনামধন্য কিছু শিল্পীর পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীও লক্ষ্য করা যায়।
আমি জ্ঞাত ছিলাম যে, আমার বাবা ও ফুফাতো বোন জুনুদি হাসনাত আবদুল হাইয়ের বইটির কড়া সমালোচক ছিলেন। কিন্তু, আমার অভিমত, কিছু তথ্য বিভ্রাটের জন্য তাঁকে দায়ী করা চলে না-তিনিতো সাক্ষাৎকারদাতাদের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন মাত্র। অধিকাংশ মানুষ তাই বলেছেন যা তারা সত্য বলে জেনেছেন। সবসময় এমনই কি হয় না?
যে মানুষটি মানব সংশ্রব এড়িয়ে চলেন, তাকে নিয়ে বিভ্রান্তি থাকবেই। ১৯৬২ (বা ১৯৬৩)-এ পাকিস্তান ছাড়ার পর পরিবার ও বন্ধুদের সাথে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। অগ্রজা মনুদি (শরীফা আলম পেয়ারী) একাধিকবার নানা উপলক্ষে যোগাযোগ করতে চেয়েছেন কিন্তু রানীদি বিমুখ ছিলেন। ঝুনুদি শাড়ি ও টাকা পাঠালে তিনি টাকা রেখেছেন, শাড়ি নেন নি। এরপর তিনি ঝুনুদির সাথে আর যোগাযোগ রাখেন নি। আমার বড় বোনের কাছে শুনেছি ঝুনুদি তাঁকে ‘বোহেমিয়ান জীবনধারা’ এবং পুরুষদের সাথে স্বাধীন মেলামেশার জন্য তিরস্কার করতেন। আমার মেয়ে আরীবাও তার স্বামী তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিল, কিন্তু সে রানীদির স্বামীর সাথে দেখা করতে পেরেছে-তাঁর সাথে নয়। তিনি আর নেই, তাঁর সাথে কেউ আর দেখা করতেও যাবে না। কেবল প্রত্যাশা, যেমন ছিল তার যাপিত জীবন সেভাবেই যেন খুঁজে পান প্রশান্তিময়তা।
ইংরেজি থেকে ভাষান্তর : রুহী সফদার

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনা : প্রয়োজন সচেতনতা সাবধানতা আর সহযোগিতা
পরবর্তী নিবন্ধসাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি