ভারতের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়া ৯০ জেলে ও নাবিক তাদের পরিবারের কাছে ফিরেছেন। গতকাল তাদেরকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে কোস্ট গার্ড। স্বজনদের কাছে ফিরে নাবিক ও জেলেদের অনেককে আবেগে আপ্লুত হতে দেখা গেছে। এ সময় নাবিকরা বলেন, আমরা কোনো কষ্টে ছিলাম না। শুধু একটি কষ্টই আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল, তা হচ্ছে পরিবার থেকে দূরে থাকা। কবে নাগাদ ফিরতে পারব সেই অনিশ্চয়তা কষ্ট দিয়েছে। তবে হাউজ এরেস্টের মতো আমরা জাহাজেই ছিলাম। কারাগারের কষ্ট সইতে হয়নি, খাবারের সমস্যাও হয়নি।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে নগরীর পতেঙ্গায় কোস্ট গার্ডের জেটিতে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা ৯০ জনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ সময় তাদের কোম্পানির মালিকসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রায় এক মাসের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়া নাবিকেরা সোমবার রাতে চট্টগ্রামে পৌঁছান। দুটি ফিশিং ভ্যাসেলে বন্দরের বহির্নোঙরের কাছে রাখা হয় তাদের। গতকাল সকাল সোয়া ৯টার দিকে তারা পতেঙ্গার কোস্ট গার্ড জেটিতে পৌঁছান।
তারা যখন জাহাজ থেকে নেমে আসছিলেন জেটিতে স্বজনদের পেয়ে অনেকে আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠেন। তারা স্বজনদের বুকে জড়িয়ে কান্না করতে থাকেন। দ্রুত ফিরে আসতে পারায় তারা সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া এবং সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। জেলে এবং নাবিকেরা জানান, এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে পারব আশা করিনি। সরকারের প্রষ্টোয় দ্রুত স্বজনদের কাছে ফিরে আসলাম। এ সময় কোস্টগার্ড পূর্ব জোনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশি ফিশিং কোম্পানি এস আর ফিশিংয়ের মালিকানাধীন এফভি লায়লা–২ এবং সিঅ্যান্ডএফ অ্যাগ্রো লিমিটেডের মালিকানাধীন এফভি মেঘনা–৫ জাহাজ দুটিকে ৯ ডিসেম্বর বঙ্গোপসাগরের হিরণ পয়েন্টের কাছ থেকে ধরে নিয়ে যায় ভারতীয় কোস্ট গার্ড। তাদের অভিযোগ ছিল, জাহাজ দুটি ভারতীয় জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ শিকার করছিল। জাহাজ দুটিতে ৭৮ জন নাবিক ও জেলে ছিলেন।
এর আগে ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশি মাছ ধরার নৌকা এফভি কৌশিক প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ডুবে যায়। ওই সময় ভারতীয় একটি ফিশিং ভ্যাসেল ১২ জন নাবিক ও জেলেকে সাগর থেকে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করে। পরে তাদেরকে ভারতীয় কোস্ট গার্ডের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। এরও আগে গত অক্টোবর ও নভেম্বরে বাংলাদেশের জলসীমায় মাছ শিকারের সময় ৬টি ভারতীয় ট্রলার আটক করে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। ওই ট্রলারগুলোতে ৯৫ জন ভারতীয় জেলে ও নাবিক ছিল।
বাংলাদেশের দুটি ফিশিং ভ্যাসেল ৭৮ জন নাবিকসহ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ভারতের কাছে জেলে ও নাবিকদের ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। উভয় দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলোচনা করে। পরে বন্দি প্রত্যার্পণের আওতায় বাংলাদেশ ভারতীয় ৯৫ জন জেলে ও আটককৃত নৌযান ফেরত দিতে সম্মত হয়। ভারতও আটক করা ৯০ নাবিক ও দুটি ফিশিং ভ্যাসেল ফেরত দিতে সম্মত হয়। উভয় দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টির দায়িত্ব দেওয়া হয় কোস্ট গার্ডকে। এরই প্রেক্ষিতে কোস্টগার্ড গত বোরবার বিকালে দুই দেশের বন্দি বিনিময় করে। যার ফলশ্রুতিতে গতকাল জেলে ও নাবিকেরা স্বজনদের কাছে ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছে।
গতকাল নাবিকরা জানান, বঙ্গোপসাগরে আন্তর্জাতিক যে জলসীমা সেখানে তারা জিপিএস ব্যবহার করে মাছ শিকার করেন। অনেক সময় একুট এদিক–ওদিক হয়ে যায়। ওইদিন এমন কিছু হতে পারে। ভারতীয় কোস্টগার্ডের হাতে আটক ৯০ জন জেলে ও নাবিকের মধ্যে ডুবে যাওয়া এফভি কৌশিকের ১২ জন জেলে ও নাবিককে কোস্ট গার্ড পশ্চিমবঙ্গের কাকদ্বীপে নিয়ে যায়। তবে এফভি মেঘনা–৫ ও এফভি লায়লা–২ এর ৭৮ জেলে ও নাবিককে কারাগারে দেয়নি। আটকের পরদিন তাদের উড়িষ্যার প্যারাদ্বীপের কাছে প্যারাদ্বীপ মডেল থানায় নিয়ে যায়। সেখানে সবার নাম তালিকাভুক্ত এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর তাদেরকে আবারো জাহাজে নিয়ে আসা হয়। এরপর থেকে তারা জাহাজেই ছিলেন। তবে তাদেরকে জাহাজ থেকে নামতে দেওয়া হয়নি। খাবার ফুরিয়ে গেলে কোস্ট গার্ড চাল– ডালসহ প্রয়োজনীয় রসদের যোগান দিয়েছে। তাদের সাথে খারাপ আচরণ করা হয়নি।
স্বজনদের কাছে নাবিকদের হস্তান্তরকালে কোস্টগার্ড পূর্ব জোনের কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ জহিরুল হক বলেন, ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশি ফিশিং বোট এফভি কৌশিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে ডুবে যায়। বোটটির ১২ জন জেলেকে উদ্ধার করে ভারতীয় কোস্ট গার্ড। পরে তাদের ভারতে নিয়ে যায়। ৯ ডিসেম্বর এফভি লাইলা–২ ও এফভি মেঘনা–৫ নামে দুটি জাহাজ ধরে নিয়ে যায় ভারতীয় কোস্ট গার্ড। তাদের অভিযোগ ছিল ভারতীয় জলসীমায় মাছ ধরছিল জাহাজ দুটি। ওই দুই জাহাজে নাবিক ও জেলে মিলে ৭৮ জন ছিল।
তিনি বলেন, পরবর্তী সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ফেরাতে উদ্যোগ নেয়। দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার মাধ্যমে বন্দি বিনিময়ের সিদ্ধান্ত হয়। বন্দি বিনিময়ের দায়িত্বটি বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডকে দেওয়া হয়। সে প্রেক্ষাপটে ৫ জানুযারি বাংলাদেশ–ভারত আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা এলাকায় বাংলাদেশে অবস্থানরত ৯৫ জন ভারতীয় জেলে ও ৬টি বোটসহ ভারতীয় কোস্টগার্ডে হস্তান্তর করা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক মনোয়ার মোকাররম বলেন, সরকারের আন্তরিক চেষ্টা ছিল নাবিক ও জেলেদের ফিরিয়ে আনার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছে। নাবিকদের সকলকে সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনার পেছনে যারা কাজ করেছেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
এফভি মেঘনা–৫ জাহাজের নাবিক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, ৯ ডিসেম্বর সকাল ৭টার দিকে আমরা মাছ শিকার করছিলাম। ওই সময় ভারতীয় কোস্ট গার্ড আমাদের ট্রলার দুটি আটক করে। ভারতীয় কোস্ট গার্ড প্রথমে এফভি লায়লা–২ জাহাজের কাগজপত্র এবং জাহাজের ভিতরে তল্লাশি করে। পরে এফভি মেঘনা–৫ জাহাজেও একইভাবে তল্লাশি চালায়। কয়েক ঘণ্টা পর আমাদের আবার হিরণ পয়েন্টে নিয়ে আসে। রাত ৯টার দিকে ট্রলারটি পুনরায় ভারতে নিয়ে উড়িষ্যার প্যারাদ্বীপ বন্দরে আটকে রাখে।
তিনি জানান, তারা আমাদের মোবাইল ফোনগুলো নিয়ে নেয়। এছাড়া কোনো খারাপ আচরণ করেনি। আমরা ট্রলারেই ছিলাম। আমাদের সুবিধা–অসুবিধার কথা জেনে নিত। খাওয়ার শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা আমাদের ট্রলারে খাবারও দিয়েছে। কারো কোনো ওষুধ লাগলে সেটাও দিত। কিন্তু ২৬ দিন পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। সেটাই ছিল কষ্টের।
তিন সন্তানের জনক গিয়াস বলেন, আমার তিন সন্তান পড়াশোনা করে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আমি। তাই দেশে ফেরার আকুতি ছিল। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না কখন ফিরতে পারব। দেশে ফেরার অনিশ্চয়তায় নাবিক ও জেলেদের অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। কেউ কেউ সাগরে ঝাঁপ দিতে চেয়েছিলেন। অন্যরা তাদেরকে বুঝিয়ে শান্ত রাখেন।
এফভি লায়লা–২ জাহাজের নাবিক আবুল কালাম বলেন, ভারতীয় কোস্ট গার্ডের সদস্যরা জাহাজ আটকের পর কাগজপত্র এবং নানারকম যন্ত্রপাতি নিয়ে জাহাজের মাছ রাখার স্থান তল্লাশি করে। দুই ঘণ্টা পর ছেড়ে দেয়। আমরা আমাদের জলসীমায় এসে পুনরায় জাল ফেলি। কিন্তু ভারতীয় কোস্ট গার্ড থেকে আমাদের ক্যাপ্টেনকে জানানো হয়, তাদের একজনের একটি আইফোন জাহাজে ফেলে গেছে। তাই যেন পুনরায় সেখানে যায়। সেখানে গেলেই আমাদের আটক করে রাখে।
ফোন ফেলে যাওয়ার বিষয়টি ভারতীয় কোস্ট গার্ডের কৌশল ছিল দাবি করে এফভি লায়লা–২ এর ক্যাপ্টেন রাজীব চন্দ্র শীল বলেন, আমরা যাওয়ার পর বলা হয়, তাদের ৯৫ জন জেলে বাংলাদেশে আটক আছে। তাই ঊর্ধ্বতনদের আদেশে আমাদের ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তারা বলেছে, আমাদের বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগ নেই।
ভারতীয় কোস্ট গার্ডের অধীনে থাকা অবস্থায় সবার মোবাইল ফোন নিয়ে নেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে আমাকে মালিকপক্ষের সাথে দুইবার যোগাযোগ করতে দিয়েছিল।
এফভি মেঘনা–৫ এর প্রধান প্রকৌশলী শরিফুল আলম বলেন, বন্দি থাকা অবস্থায় কখন ফিরতে পারব তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। পরিবারের কাছে ফিরে আনন্দ লাগছে।
মুক্তি পাওয়া নাবিকদের অধিকাংশের বাড়ি নোয়াখালী, ভোলা, সাতক্ষীরা, কিশোরগঞ্জ ও ফেনীতে। কঙবাজারের মহেশখালী এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীরও কয়েকজন নাবিক ও জেলে রয়েছেন।