টানা বৃষ্টিপাতের কারণে নগরবাসী উদ্বিগ্ন। একদিকে এতে জলাবদ্ধতার সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে, অন্যদিকে পাহাড় ধসের আশঙ্কা থাকে চট্টগ্রামে। পাহাড় ধস মানে প্রাণহানির আশঙ্কা। পাহাড় ধস রোধে এ পর্যন্ত কোনো টেকসই ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে প্রতিবছরই পাহাড় ধসের আশঙ্কা বাড়ে এবং বাড়তে থাকে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও। জানা গেছে, পাহাড়ে বসবাসরতদের বেশিভাগই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ। বিকল্প উপায় না পেয়ে বছরের পর বছর তারা এখানে বসবাস করছে। মৃত্যু ঝুঁকি জেনেও বাধ্য হয়ে পাহাড়ে তারা বসবাস করছে। প্রতি বছর বর্ষা এলে পাহাড়ে বসবাসরতদের মাঝে আতঙ্ক বেড়ে যায়। এ সময় পাহাড় ধস রোধে প্রশাসনও তৎপর হয়ে ওঠে। বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসের ঘটনা মোকাবেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নিলেও তা মূলত সাময়িক। তবে বসতবাড়ি স্থাপন ছাড়াও বিভিন্ন অজুহাতে পাহাড় কাটা থেমে থাকে না। গত দুই দশকে বনবৃক্ষ কাটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পাহাড় কর্তন। চট্টগ্রাম ছাড়াও পার্বত্য এলাকায় চলে উন্নয়ন যজ্ঞ। পাহাড়ের উন্নয়ন দর্শন মানেই পাহাড় কেটে সাবাড় করা। সড়ক নির্মাণ বা স্থাপনা নির্মাণের জন্য ব্যাপকহারে পাহাড় কর্তন করা হয়। পাহাড় কেটে রাস্তা বানানোর কারণে ওখানে পাহাড়ে নিচে ধস নামছে।
পাহাড় কর্তনের পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ ছাড়া পাহাড় কেটে যাচ্ছে উন্নয়ন সংস্থাগুলো। এসব কারণে মূলত পাহাড় ধস রোধ করা যাচ্ছে না। এখানে উল্লেখ করতে হয়, ২০১৭ সালে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটিসহ পার্বত্য এলাকায় পাহাড় ধসে প্রায় ১৬৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। পাহাড়ে অপরিকল্পিত চাষাবাদ, অবৈধ বসতি স্থাপন ও অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের কারণে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের নামে পাহাড় কাটা হলেও তাতে উন্নত প্রযুক্তি ও প্রকৌশল মানা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া অবৈধভাবে পাহাড় কাটা রোধে প্রশাসনের নির্বিকার ভূমিকারও অভিযোগ আছে। পরিবেশবিদরা বলেন, বাণিজ্যিক কারণে নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে পাহাড় প্রাকৃতিকভাবে ধস প্রতিরোধের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এছাড়া অতি বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড় ধসের ঘটনাতো ঘটছে।
পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ও পাহাড় ধসে মৃত্যুর আশঙ্কা রোধে জেলা প্রশাসন এবার আগে থেকে প্রস্তুতি রেখেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। গত ৭ জুন দৈনিক আজাদীতে ‘১৯ আশ্রয়কেন্দ্রে ৬শ মানুষকে স্থানান্তর,পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস’ শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, নগরীর ১৮টি পাহাড়ে একযোগে মাইকিং করেছে জেলা প্রশাসন। এসব পাহাড় থেকে দেড়শ পরিবারের প্রায় ৬০০ লোককে ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তাদের জন্য সেখানে থাকার ব্যবস্থার পাশাপাশি পর্যাপ্ত শুকনো খাবার ও খিঁচুড়ির ব্যবস্থা করা হয়। ছিল চিকিৎসা ব্যবস্থাও। এদিকে সন্ধ্যার পর বৃষ্টি কমে আসার সাথে সাথে দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। প্রতিবারের মতো এবারও প্রশাসনের কর্মকর্তারা চলে যাওয়ার পর অনেক লোক আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে পাহাড়ে ফিরেছেন বলে জানা গেছে। জেলা প্রশাসন জানায়, ঝুঁকিপূর্ণ এসব পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় ১৬০০ পরিবারের বসবাস রয়েছে। রোববার দেড়শ পরিবারের লোকজনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ঝুঁকিতে থাকা অন্যদেরও সরিয়ে নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান।
আসলে প্রতি বছর বৃষ্টির আগে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ অভিযান চালায় প্রশাসন। স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকায় এসব অভিযানের পরপরই পাহাড়ে আবার ফিরে যায় বসবাসকারীরা। আর বর্ষা মৌসুমে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস রোধে প্রশাসনের তোড়জোড় থাকলেও বর্ষার পরপরই বিষয়টি চোখের আড়ালে চলে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাহাড় কাটা ও দখলের সঙ্গে জড়িতরা চিহ্নিত হলেও কখনোই প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। দখলকারীরা তাদের অবস্থানেই বহাল আছে। উল্টো প্রতিবছর নতুন পাহাড় কেটে আরও বসতি স্থাপন করছে। এভাবে চলতে থাকলে এক দশক পরে শহর ও আশেপাশের এলাকায় একটি পাহাড়ও আর অবশিষ্ট থাকবে না। তখন আর পাহাড় রক্ষার দাবিও জানাতে হবে না। সব পাহাড় শেষ হওয়ার আগেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ বসতি চিহ্নিত করা ও তাদের স্থায়ীভাবে উচ্ছেদের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।