সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে চট্টগ্রামের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের সাবেক এক এএসপি ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেছে দুদক। এতে বলা হয়েছে, মো. আবুল হাশেম নামের ওই পুলিশ কর্মকর্তার অবৈধ আয়ের অর্থ দিয়ে নগরীর পাঁচলাইশে পলিটেকনিক্যাল কলেজ রোডের রূপসী হাউজিংয়ে তার স্ত্রী চার তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। স্বামীর অবৈধ আয়কে বৈধতা দিতে স্ত্রী তাহেরিনা বেগম নিজেকে বুটিক্স ব্যবসায়ী দাবি করেছেন। দুদক যাচাই করলে দেখা যায়, তার বুটিক্স ব্যবসা সংক্রান্ত লাইসেন্স বা কোনো রেকর্ডপত্র নেই। কোনো রেকর্ডপত্র তিনি সরবরাহ করতে পারেননি। ব্যবসার প্রারম্ভিক মূলধন বাবদ প্রথম ট্যাক্স ফাইলে প্রদর্শিত ৯ লাখ টাকার উৎসেরও কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তাছাড়া সম্পদ বিবরণী দাখিল ফরমেও অস্থাবর সম্পদের ছকে ব্যবসার মূলধন বাবদ কোনো টাকার ঘোষণা দেননি। অর্থাৎ, তার কোনো বুটিক্স ব্যবসা নেই। সে হিসাবে তার ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো আয় গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া তিনি ২০০৮–০৯ থেকে ২০১৯–২০ করবর্ষ (সম্পদ বিবরণী দাখিল পর্যন্ত) ব্যবসার সাথে টিউশনি বাবদ মোট ১৬ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ টাকা আয় দেখিয়েছেন। যাচাই করলে দেখা যায়, টিউশনি আয়ের সপক্ষে কোনো রেকর্ডপত্র তিনি সরবরাহ করতে পারেননি। গতকাল দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম–১ এ মামলা দুটি দায়ের করেন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম–২ এর সহকারী পরিচালক মুসাব্বির আহমেদ। দুই মামলার মধ্যে একটিতে শুধু পুলিশ কর্মকর্তা মো. আবুল হাশেমকে ও অপর মামলায় পুলিশ কর্মকর্তার পাশাপাশি স্ত্রী তাহেরিনা বেগমকে আসামি করা হয়েছে। কার্যালয়–২ এর উপপরিচালক মো. আতিকুল আলম আজাদীকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, মামলা তদন্তে অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে আমলে নেওয়া হবে।
আবুল হাশেমের বিরুদ্ধে করা মামলার এজাহারে বলা হয়, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবুল হাশেম ও তার স্ত্রী তাহেরিনা বেগমকে সম্পদ বিবরণী দাখিলের জন্য বলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর এ দম্পতি সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। এতে আবুল হাশেম ১ কোটি ৭ লাখ ১৭ হাজার ৬১২ টাকার স্থাবর সম্পদ অর্জনের ঘোষণা দেন। কিন্তু যাচাই করলে তার নামে পাওয়া গেছে ১ কোটি ১০ লাখ ৬৩ হাজার ৫৭৪ টাকার স্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য। এছাড়া ৯ লাখ ৮৩ হাজার ২৫৬ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদ অর্জনের ঘোষণার বিপরীতে দেখা গেছে, তার নামে ৯ লাখ ৬৩ হাজার ২৫৬ টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি চার লাখ ৪৫ হাজার ৯৬২ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করেছেন। সম্পদ বিবরণীতে কোনো সঞ্চয়পত্রের ঘোষণা না দিলেও তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক ১ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের তথ্য পাওয়া গেছে বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়। এজাহারে বলা হয়, আবুল হাশেম ১৯৮৮ সালে এসআই পদে চাকরিতে যোগদান করেন। ২০২২ সালের অক্টোবরে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার হিসাবে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। ১৯৮৮–৮৯ অর্থ বছর থেকে ২০১৮–১৯ অর্থ বছর (সম্পদ বিবরণী দাখিল) পর্যন্ত বেতন ভাতাদি ও তার প্রবাসী ভাই থেকে উপহার বাবদ রেমিট্যান্স, গৃহ সম্পত্তি থেকে আয়, ব্যাংক সুদ ও অন্যান্য আয় বাবদ সর্বমোট ৮৭ লাখ ৭৭ হাজার ৩৫৬ টাকা আয় করেছেন। তার দায় রয়েছে ৩১ লাখ ৮ হাজার ৩৪১ টাকা। এটি বাদ দিলে তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ হচ্ছে ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৪৮৯ টাকা। একই সময়ে তিনি ১৭ লাখ ১৯ হাজার ১৬১ টাকা পারিবারিক ব্যয়সহ অন্যান্য ব্যয় করেছেন। সেই হিসাবে তার মোট সম্পদের পরিমাণ দেখা যায়, ১ কোটি ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৬৫০ টাকা। সেখান থেকে গ্রহণযোগ্য ৮৭ লাখ ৭৭ হাজার ৩৫৬ টাকা বাদ দিলে বাকী ১৮ লাখ ৬০ হাজার ২৯৪ টাকা তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ। অর্থাৎ তিনি ১৮ লাখ ৬০ হাজার ২৯৪ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। যা দুদক আইনের ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
স্ত্রী তাহেরিনা বেগমের বিরুদ্ধে (আবুল হাশেমকেও আসামি করা হয়) করা পৃথক মামলার এজাহারে বলা হয়, তাহেরিনা বেগমের বাড়ি ভাড়া, ভাইদের থেকে উপহার বাবদ নগদ অর্থ, ব্যাংক সুদ, টিউশনি ও অন্যান্য আয় বাবদ গ্রহণযোগ্য আয় ৬০ লাখ ৫৮ হাজার ৬৬৮ টাকা। তিনি ২০০২–২০০৫ সাল পর্যন্ত সান মেরন স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। ২০০৫–০৬ থেকে ২০১৯–২০ করবর্ষ (সম্পদ বিবরণী ফরম দাখিল পর্যন্ত) পর্যন্ত বুটিক্স ব্যবসার আয় বাবদ ২২ লাখ ৭৩ হাজার টাকা ট্যাক্স ফাইলে প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু যাচাই করলে দেখা যায়, তার বুটিক্স ব্যবসা সংক্রান্ত লাইসেন্স বা কোনো রেকর্ডপত্র নেই। কোনো রেকর্ডপত্র তিনি সরবরাহ করতে পারেননি। ব্যবসার প্রারম্ভিক মূলধন বাবদ প্রথম ট্যাক্স ফাইলে প্রদর্শিত ৯ লাখ টাকার উৎসেরও কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তাছাড়া সম্পদ বিবরণী দাখিল ফরমেও অস্থাবর সম্পদের ছকে ব্যবসার মূলধন বাবদ কোনো টাকার ঘোষণা দেননি। অর্থাৎ, তার কোনো বুটিক্স ব্যবসা নেই। সে হিসাবে তার ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো আয় গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি ২০০৮–০৯ থেকে ২০১৯–২০ করবর্ষ (সম্পদ বিবরণী দাখিল পর্যন্ত) ব্যবসার সাথে টিউশনি বাবদ মোট ১৬ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ টাকা আয় দেখিয়েছেন। যাচাই করলে দেখা যায়, টিউশনি আয়ের সপক্ষে কোনো রেকর্ডপত্র তিনি সরবরাহ করতে পারেননি। তবুও তার ট্যাক্স ফাইলে প্রদর্শিত টিউশন ফি বাবদ আয় গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা হয়েছে।
এজাহারে আরো বলা হয়, নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন পলিটেকনিক্যাল কলেজ রোডের রূপসী হাউজিংয়ে ২০১৩–১৫ সালের মধ্যে যে চার তলা ভবন তার ও তার স্বামীর যৌথ নামে নির্মাণ করা হয়েছে তখন তাতে বিনিয়োগ করার মত তার যথেষ্ট বৈধ আয়ের কোনো উৎস ছিল না। স্বামী আবুল হাশেম পুলিশে চাকরিরত অবস্থায় যে অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জন করেছেন সে অর্থের সহযোগিতায় বা তা ব্যবহার করেই তাহেরিনা বেগম তার ও তার স্বামীর যৌথ নামে চার তলা ভবন নির্মাণের ব্যয়ভার বহন করেছেন। চাকরিরত অবস্থায় স্বামীর অসাধু উপায়ে অর্জিত অর্থ দিয়ে স্ত্রী তাহেরিনা বেগমের নামে সম্পদ অর্জন এবং উক্ত সম্পদ স্ত্রীর ভোগ দখলে রাখতে সহযোগিতা করে আবুল হাশেম দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এজাহারে এও বলা হয়, তাহেরিনা বেগম ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৩৬৬ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন ও ৪৩ লাখ ৩২ হাজার ৪৫৬ টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে ভোগ দখলে রেখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।