.‘স্ট্রোক’ হলো একটা ঘাতক ব্যাধি। বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকেরা বলেন স্ট্রোক প্রাণঘাতীতে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে আছে। স্ট্রোক সম্পূর্ণ মস্তিষ্কের রোগ বুঝায়। বাংলায় এর অর্থ হল আঘাত। এই রোগটা হঠাৎই হয়। স্ট্রোক সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের কিছু জ্ঞান থাকা দরকার। কারণ সাধারণ মানুষ হার্ট এ্যাটাককেও স্ট্রোক মনে করেন। স্ট্রোকে মানুষ হঠাৎ চৈতন্য হারিয়ে ফেলে এবং এটা সংঘটিত হয় যখন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় বা রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত চলাচলের ব্যাঘাত ঘটায়। স্ট্রোক সম্বন্ধে বিস্তারিত বলার আগে ব্রেইন বা মস্তিষ্ক সম্বন্ধে কিছু জানা দরকার। ব্রেইন হল মাথার খুলির ভেতরে থাকা নরম স্নায়ুকোষ দ্বারা গঠিত একটা ঙৎমধহ বা অঙ্গ। তার প্রধান কাজ দেহের প্রতিটা অঙ্গের সাথে সংবেদনশীলতার সমন্বয় সাধন করা। মানুষের ভালো মন্দ জ্ঞান, বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি, দৃষ্টিশক্তি, কৌশল, শারীরিক যোগ্যতা, মানসিক উন্নয়ন সব কিছুর নিয়ন্ত্রক মস্তিষ্ক। সাধারণত দুধরনের স্ট্রোক হয়। ১) মস্তিষ্কে ধমনী ও শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে যে স্ট্রোক হয় তাকে বলা হয় ওংপযধবসরপ ঝঃৎড়শব অর্থাৎ ইৎধরহ এর একটা অংশে রক্ত যাচ্ছে না। এটা ৮০% লোকের হয়। ২) রক্তক্ষরণ স্ট্রোক বা ঐধবসড়ৎৎযধমরপ ঝঃৎড়শব অর্থাৎ ধমনী শিরা থেকে রক্ত বাহির হয়ে জমাট বেঁধে রক্ত চলাচল বন্ধ করে দেওয়া। এটা মারাত্মক আকার ধারন করে। স্ট্রোক বয়স্কদের দীর্ঘস্থায়ী পঙ্গু অবস্থা ঘটায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে করোনা সংক্রমণে স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। প্রতি চার জন কোভিড- ১৯ এ মৃত্যুর মধ্যে একজন স্ট্রোকে মারা গেছেন। বিশেষ করে মাঝ ও বৃদ্ধবয়সী লোক যাদের কো-মরবিডিটি রয়েছে যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগ হাঁপানি, সিওপিডি, হৃদযন্ত্রের রোগ, ওপেন হার্ট সার্জারী, ক্রনিক কিডনি সংক্রমণ, ক্যানসার, স্ট্রোক ইত্যাদি।
করোনা যখন প্রথম শুরু হয় বিজ্ঞানীদের এবং চিকিৎসকদের ধারনা ছিল করোনা ভাইরাস শুধু ফুসফুসকে আক্রমণ করে। কিন্তু পর্যায়ক্রমে আরও গবেষণায় দেখা গেল করোনা রোগীরা অনেকেই স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। করোনা ভাইরাস নার্ভাস সিস্টেমকে আক্রমণ করে। নার্ভ এর মায়ালিনসিতকে আক্রমণ করে নষ্ট করে দেয় এবং স্নায়ুকোষে ঢুকে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে মেনিনজাইটিস ও মেনিনগোএনকেফালাইটিস রোগে আক্রান্ত করে। যতদিন যাচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে যে, করোনা ভাইরাস মানুষের মস্তিষ্কে এবং স্নায়ুতন্ত্রে নানা রকম সমস্যা সৃষ্টি করছে যেমন-মানসিক বিকার, প্রলাপ, বিভ্রম, ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা, আতংক প্রভৃতি। বিজ্ঞানীরা দেখছেন করোনা ভাইরাস জনিত নিউরোলজিক্যাল সমস্যায় স্ট্রোকের শিকার যারা হয়েছেন তাদের অবস্থা ভীতিকর। একটা দৃষ্টান্তে দেখা যায় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়য়ের যোগাযোগ সংক্রান্ত পরিচালক পিল-মিলারি ‘করোনা’ সংক্রমণের পর দুবার স্ট্রোকের শিকার হন। আত্মীয়রা ভেবেছেন বাঁচবেনা। তার ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি, তিনি শুধু একপাশ দেখতে পাচ্ছিলেন। স্মৃতি ভ্রষ্ট ছিলেন। ২য় বার স্ট্রোকে মস্তিষ্কের একটা অংশে রক্ত পৌঁছাতে পারছিল না। রক্ত জমাট বাঁধার পরিমাপ মাপার সূচক ডি-ডাইমার পরীক্ষা করে দেখলেন মিলারের ক্ষেত্রে ৮০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে অথচ যেখানে একজন সুস্থ মানুষের থাকে মাত্র ৩০০ রাত্ত।
স্ট্রোকের কারণ সমূহঃ ১) উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানুষের স্বাভাবিক রক্তচাপ ১২০/৮০ (প্রাপ্ত বয়স্কদের)। ১৪০/৯০ বা তার উর্ধ্বে হলে উচ্চ চাপ ধরা হয়। যে কোন বয়সেই উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের স্ট্রোকের ঝুঁকি থাকে। স্ট্রোক সংঘটিত হওয়ার শক্তিশালী পূর্বসংকেত হচ্ছে উচ্চ রক্ত চাপ। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার এন্ড স্ট্রোক এর মতে আমেরিকানদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ এবং নানাবিধ শারীরিক অক্ষমতার কারন স্ট্রোক। সুতরাং সবাই উচ্চ রক্তচাপ সম্বন্ধে সচেতন থাকা উচিত। বিশেষভাবে বলতে চাই উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা নিয়মিত ওষুধ সেবন করুন এবং ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ নিজে বন্ধ করবেন না। নিয়মিত ব্লাড প্রেসার চেক করুন।
২) ডায়াবেটিস- রোগীদেরর রক্ত চাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অবশ্যই ১৪০/৯০ এর নীচে, এটা ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বেশী প্রযোজ্য। তাতে তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি ৮৫% এবং হৃদরোগের ঝুঁকি ৫০% রোধ করা যায়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়বেটিস রোগীদের বৃহৎ ও ক্ষুদ্র রক্তনালীগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ধীরে ধীরে সংকীর্ণ হয়ে উচ্চ রক্ত চাপ দেখা দেয় এবং স্ট্রোক ঘটতে পারে। ৩) ধুমপান- ধোঁয়ায় থাকে নিকোটিন জাতীয় বিষাক্ত অ্যালকালয়েড রক্তনালীকে ধীরে ধীরে সংকীর্ণ করে দেয়। ফলে রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
৪) হৃদস্পন্দন চ্যুতি (এট্রিয়াল ফেব্রিলেশন) স্ট্রোকের একটা কারণ।
৫) লবণ- আমেরিকার মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজিস্ট ‘ব্যালক স্যাকো’ খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে লবনকে আসামি করেছেন। প্রাত্যহিক জীবনে আমরা দেখছি যারা পাতে লবণ/ কাঁচা লবণ খান তারা হাই ব্লাড প্রেসারে ভোগেন। আর উচ্চ রক্তচাপ মানে স্ট্রোকের ঝুঁকি। সব প্রক্রিয়াজাত খাবার নুনে ভরপুর। তাই আমেরিকান-আফ্রিকানদের স্ট্রোক ঝুঁকি বেশি। ফাস্টফুড/ জাঙ্ক ফুড ইহার জন্য দায়ী। সুতরাং পরিহার করুন।
৬) দৈহিক ওজন- স্থূলতা একটা অভিশাপ। তাতে অনেক ধরনের রোগ শরীরে জন্মায়। বাড়তি ওজনের জন্য রক্তনালীগুলোকে বাড়তি খাটতে হয় যাদের মধ্যদিয়ে হৃদপিন্ডকে রক্ত পাম্প করতে হয়। ফলে উচ্চ রক্ত চাপে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। স্থূলতা মানে চর্বি। হাই কোলেস্টরেল।
৭) মদ্যপান- যারা মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করে তাদের স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুঁকি বেশী।
৮) খাদ্যভ্যাস- বিশেষ করে বয়স পঞ্চাশের পর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা দরকার। কিন্তু আপনি দাওয়াতে, বিবাহ অনুষ্ঠানে দেখবেন ঠিক উল্টো মানুষ হুমরি খেয়ে পড়ছে কাচ্চি বিরিয়ানী খাওয়ার জন্য। তাতে বাড়ছে ব্লাড প্রেসার, বাড়ছে কোলেস্টেরল। ঘটছে হার্ট এ্যাটাক এবং স্ট্রোক। উচ্চ মাত্রায় সম্পৃক্ত চর্বি দেহকে বেশি পরিমানে কোলেষ্টেরল উৎপাদনে বাধ্য করে যা রক্তনালীর দেয়ালে জমে স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। স্ট্রোকের ও হৃদরোগের সঙ্গে কোলেস্টেরলের সম্পর্ক সুনিশ্চিত। উচ্চ মাত্রার লো-ডেনসিটি কোলেষ্টেরল এবং নীচু মাত্রার হাই ডেনসিটি কোলেস্টেরল স্ট্রোকের ও হার্ট এ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।
৯) স্লিপ এপনিয়া- অর্থাৎ ঘুমের মধ্যে কারো কারো শ্বাস প্রশ্বাস হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া। দেখবেন ঐ লোকটি হঠাৎ চেতন হয়ে পুনরায় শ্বাস নিতে থাকে। যদি এটা চলতে থাকে তবে হঠাৎ স্ট্রোক হতে পারে। সুতরাং ডাক্তারের নিকট গিয়ে চিকিৎসা করান।
১০) স্ট্রোকের একটা বংশগত কারণও আছে। যাদের বংশে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া বা মারা যাওয়ার ইতিহাস আছে তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি থাকতে পারে। আমার তিন পুরুষ স্ট্রোকে মৃত্যুর ইতিহাস আছে।
১১) এদিকে দেখুন আমাদের জীবনে চলার পথে আমরা মিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছি। কিন্তু সেগুলি আমরা বুঝে উঠতে পারিনা বা পাত্তা দিইনা। মাঝ বয়সীরা, বৃদ্ধরা এটাতে ভোগেন। যেহেতু মিনি স্ট্রোক ক্ষনিকের জন্য রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটায় তাই আমরা বুঝিনা। কিন্তু পরবর্তীতে এটা বড় স্ট্রোকে পরিণত হতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া ভাল।
স্ট্রোকের লক্ষণ সমূহ: হঠাৎ করে অবসন্নতা, হঠাৎ বিহবল হয়ে যাওয়া, শরীরের কোন একদিকে অবশ বোধ করা, চোখে ঝাপসা দেখা, হঠাৎ করে কথা বলতে বা কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়া, প্রচন্ড মাথা ব্যথা, হঠাৎ মাথা ঘুরে মেঝেতে বা বাথরুমে পড়ে যাওয়া, হাঁটতে না পারা এবং তার সাথে অন্যান্য শারীরিক উপসর্গ।
স্ট্রোক নিয়ন্ত্রণের উপায়: নিয়মিত বিশ্রাম ও সুনিদ্রা একান্ত প্রয়োজন। দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা, মানসিক উত্তেজনা থেকে বিরত থাকা, খারাপ চিন্তা না করা। সব বিষয়ে সন্তুষ্ট থাকা। নিয়মিত ব্লাড প্রেসারের, ডায়াবেটিসের এবং হৃদরোগের ঔষুধ সেবন করা। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষুধ বন্ধ না করা। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, মদ্যপান ও ধুমপান থেকে বিরত থাকা। ব্যায়াম- স্ট্রোকের এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। জোরে হাঁটুন-স্ট্রোকের ঝুঁকি কমান। প্রতিদিন ৬ কিলোমিটারের বেশি ৩০মি: হাঁটুন। নিয়মিত ব্যায়াম করলে রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের স্তর নীচে নেমে আসে এবং ঐউখ এর মাত্রা বেড়ে যায়। বোস্টন হার্ভাড মেডিক্যাল স্কুলের গবেষক ‘জেকব সেটলম্যার’ বলেন স্ট্রোক প্রতিরোধে শরীর চর্চা হলো বড় উপাদান। খড় িফড়ংব অংঢ়রৎরহ ৭৫সম/ফধু সেবনের কথা ডাক্তাররা বলে থাকেন। এটা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। তবে ডাক্তারের পরামর্শ একান্ত প্রয়োজন। খাদ্যে তৈল, চর্বি, মিষ্টি কম খেতে হবে। প্রচুর শাক সবজি, ফল, সামুদ্রিক মাছ খেতে হবে। যাদের ব্লাড প্রেসার ও কোলেস্টেরল লেভেল হাই তারা কলিজা, মাথা, গরুর ও খাসীর মাংস খাওয়া বন্ধ করতে হবে। ভাতের পরিবর্তে লাল আটার রুটি উপকারী।
চিকিৎসাঃ মনে রাখতে হবে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার তিন ঘন্টার মধ্যে রোগীর অব্যাহত জরুরি চিকিৎসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্ট্রোকের চিকিৎসায় আধুনিক মেডিক্যাল সায়েন্স অনেক এগিয়ে। আমাদের দেশও এই প্রযুক্তিতে পিছিয়ে নেই। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিউরোসাইন্স ইনস্টিটিউট। নতুন নতুন প্রযুক্তি যেমন ঈঞ ঝপধহ, গজও এর মাধ্যমে মস্তিষ্কের ঘটে যাওয়া স্ট্রোক নির্ণয়ে সক্ষম হচ্ছে। সরকারী জেলা হাসপাতালেও এগুলির ব্যবহার হচ্ছে। ক্রেনিওটমির মাধ্যমে নিউরোসার্জনেরা তাৎক্ষনিক স্ট্রোকের রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে আসল কথা হল প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। মানুষের জীবনকাল সীমিত। স্বাস্থ্যসম্মত ও সচেতনতামূলক জীবন-যাপন করুন, দীর্ঘায়ু লাভ করুন।
লেখক : প্রাক্তন চীফ এনাসথেসিওলাজিস্ট,
বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।